মানবসমাজে পারস্পরিক সম্পর্ক বিনষ্টকারী যতগুলো মারাত্মক আত্মিক ব্যাধি রয়েছে, ‘গিবত’ বা পরনিন্দা তার মধ্যে অন্যতম। এটি সামাজিক সম্পর্কের নির্মল আকাশে এক নীরব বিষের মতো, যা ধীরে ধীরে বিশ্বাস, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার বন্ধন ক্ষয় করে দেয়। চায়ের আড্ডা থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের সোশ্যাল মিডিয়ার নিউজফিড পর্যন্ত সব জায়গায়ই গিবত চর্চা হয় অবলীলায়। খুব স্বাভাবিক সাধারণ আলাপচারিতার ছদ্মবেশে এটি আমাদের জীবনে এমনভাবে প্রবেশ করে যে আমরা প্রায়ই এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারি না। ইসলামে একজন মানুষের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিনা কারণে কারও সম্মানহানি করাকে একটি ভয়াবহ অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। গিবত ঠিক সেই কাজটিই করে- এটি মানুষের অনুপস্থিতিতে তার সম্মান ও ব্যক্তিত্বের ওপর এক নির্মম আক্রমণ। এটি কেবল একটি বদ অভ্যাসই নয়, বরং কবিরা গুনাহও, যা মানুষের আমল নিঃশেষ করে দেয় এবং সমাজে ঘৃণা ও বিভেদ সৃষ্টি করে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে একে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার মতো জঘন্য কাজের সঙ্গে তুলনা করে এর চরম ঘৃণ্য রূপটি তুলে ধরেছেন। কিন্তু এ ধ্বংসাত্মক পাপ থেকে বাঁচতে হলে সর্বপ্রথম এর স্বরূপ ও সংজ্ঞা জানা জরুরি। গিবত শব্দটি আরবি গাইন-ইয়া-বা এ তিন হরফ দিয়ে গঠিত ‘গায়েব’ থেকে গিবত শব্দের উৎপত্তি। গায়েব অর্থ হলো ‘অনুপস্থিত’ ‘অদৃশ্য’ বা ‘আড়ালে থাকা’। আরবি ভাষার বিখ্যাত অভিধান ‘লিসানুল আরব’-এ গিবত শব্দের অর্থ লেখা আছে- কারও অনুপস্থিতিতে তার দোষ বলা বা কারও আড়ালে তাকে নিয়ে মন্দ কথা বলা। এ ছাড়াও গিবতের প্রচলিত অর্থগুলো হলো পরচর্চা, পরনিন্দা, কুৎসা রটনা, পেছনে সমালোচনা ইত্যাদি। শরিয়ত বিশেষজ্ঞরা বলেন, ইসলামি পরিভাষায় গিবত হলো কারও অনুপস্থিতিতে তার এমন দোষ বলা, যা সে মানুষের কাছে প্রকাশ হওয়াকে অপছন্দ করে। গিবতের সবচেয়ে ভালো সংজ্ঞা দিয়েছেন স্বয়ং রসুল (সা.) নিজে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, একদিন রসুসুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের জিজ্ঞেস করলেন, আমার প্রিয় সাহাবিরা! বল তো গিবত কাকে বলে? জবাবে সাহাবায়ে কেরাম বলেন, আল্লাহ ও তাঁর রসুলই ভালো জানেন। নবীজি বলেন, তোমার কোনো ভাই সম্পর্কে এমন কথা বলা, যা সে অপছন্দ করে, তা-ই গিবত। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসুল, আমি যে দোষের কথা বলি, তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে তাহলেও কি গিবত হবে? উত্তরে তিনি (সা.) বললেন, তুমি যে দোষের কথা বল, তা যদি তোমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে; তবে তুমি অবশ্যই তার গিবত করলে। আর তুমি যা বলছ তা যদি তার মধ্যে না থাকে; তবে তুমি তার ওপর মিথ্যা অপবাদ দিয়েছ।’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস নম্বর ২৫৮৯)।
গিবত ইসলামি শরিয়তে হারাম ও কবিরা গুনাহ। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘ধ্বংস তাদের জন্য, যারা সামনে-পেছনে মানুষের দোষ বলে বেড়ায়।’ (সুরা হুমাজাহ, আয়াত ১)। আয়াতটি শুরু হয়েছে ‘ওয়াইল’ শব্দ দিয়ে। ওয়াইল অর্থ ‘দুর্ভোগ’, ‘ধ্বংস’, ‘মহাক্ষতি’ বা ‘কঠিন শাস্তি’। এখানে সাধারণ কোনো দুঃখকষ্টের কথা বলা হয়নি, বরং এটি এক চরম ও ভয়াবহ পরিণতির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন তাফসিরকারকদের মতে, ‘ওয়াইল’ হলো জাহান্নামের একটি বিশেষ উপত্যকা বা কূপের নাম, যা এত উত্তপ্ত যে জাহান্নামের অন্যান্য আগুনও সেখান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে। সুতরাং আয়াতের শুরুতেই আল্লাহতায়ালা এ শ্রেণির মানুষদের জন্য এক চূড়ান্ত ও ভয়ংকর শাস্তির কথা ঘোষণা করছেন। ঘোষণা করেছেন ‘হুমাজাহ’ ও ‘লুমাজাহ’র জন্য। হুমাজাহ শব্দটি আরবি ‘হামজ’ থেকে এসেছে। এর অর্থ হলো আঘাত করা, খোঁচা দেওয়া, ইশারা-ইঙ্গিতে কাউকে অপমান বা দোষারোপ করা। আয়াতে হুমাজাহ বলে এমন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে, যার স্বভাবই হলো অন্যকে হেয় করা। এ কাজটি সে সামনাসামনি করে। আর লুমাজাহ শব্দটি আরবি ‘লামজ’ থেকে এসেছে। এর অর্থ হলো কারও অনুপস্থিতিতে বা আড়ালে তার দোষত্রুটি খুঁজে বের করা এবং তা নিয়ে আলোচনা করা। আয়াতে লুমাজাহ বলে এমন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে, যে অভ্যাসগতভাবে অন্যের পেছনে তার সমালোচনা ও নিন্দা করে বেড়ায়। রসুল (সা.) বলেন, ‘মেরাজের সময় আমাকে এমন এক সম্প্রদায়ের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো, যাদের নখ ছিল তামার। তারা তাদের মুখ ও দেহ ওই বড় বড় নখ দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করছিল। আমি জিবরাইল (আ.)কে জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? তিনি বললেন, এরা নিজ ভাইয়ের গিবত করত এবং সম্ভ্রমহানি করত।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ১৩৩৪০)। শয়তানের ধোঁকায় পড়ে যদি কারও গিবত করে ফেলা হয়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে।
লেখক : প্রিন্সিপাল, সেইফ এডুকেশন ইনস্টিটিউট
বিডি প্রতিদিন/এমআই