সোমবার, ১১ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভুয়া ডিগ্রির বড় ডাক্তার

মির্জা মেহেদী তমাল

ভুয়া ডিগ্রির বড় ডাক্তার

ডা. মাসুদ রানা। ঢাকার খিলগাঁওয়ে তার চেম্বার। সেখানে প্রাইভেট রোগী দেখেন। তার এক চিকিৎসক বন্ধুর মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন, তার নামে পাবনায় একজন চিকিৎসক রয়েছেন। একই নামের চিকিৎসক থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু বিএমডিসির নিবন্ধন নম্বর হুবহু এক। এমন খবর জানতে পেরে হতবাক ডা. মাসুদ। তিনি ছুটে যান পাবনায়। সেখানে গিয়ে জানতে পারলেন ভয়ঙ্কর তথ্য। দীর্ঘ সাত বছর ধরেই মাসুদ রানা নামে আরেকজন ডাক্তার তার নিবন্ধন ব্যবহার করে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন। একটি  বেসরকারি ক্লিনিকে সেই মাসুদ রানার বেতন এক লাখ টাকারও বেশি। এমন খবর পেয়ে ঢাকার ডাক্তার মাসুদ রানা পুলিশের সাহায্য নেন। তিনি পুলিশকে তার পরিচয় এবং কোথা থেকে পাস করেছেন সেসব তথ্য দেন। এরপর পুলিশ অনুসন্ধানে নামে।  ঘটনা জানাজানি হওয়ায় গা-ঢাকা দেন কথিত চিকিৎসক মাসুদ রানা। পরে পাবনার মাসুদ রানাকে পুলিশ নীলফামারীর সৈয়দপুর থেকে গ্রেফতার করে। মাসুদ রানা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন বিএমএর পাবনা শাখার আজীবন সদস্যও ছিলেন। অন্যের সনদে মাসুদ রানা এভাবে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছিলেন। রাজধানীর ভাটারায় রাসেল মেডিসিন কর্নার নামক চেম্বারে রোগী দেখতেন ডা. শাহাদাত হোসেন আমানউল্লাহ। তার নামের পাশে ডিগ্রি লেখা এমবিবিএস, এফসিপিএস (মেডিসিন) পার্ট-২, সিসিডি (বারডেম), ডিএমইউ (ঢাকা), কনসালটেন্ট সনোলজিস্ট। র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাছে বিশেষজ্ঞ দাবিদার এই ডাক্তার কোনো সনদ দেখাতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত ভুয়া ডাক্তার হিসেবে আদালত তাকে ৬ মাসের কারাদ  ও ১ লাখ টাকা জরিমানা করে। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইল চৌধুরীবাড়ি বাসস্ট্যান্ডে অবস্থিত একটি হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে মোবারক ইসলাম (৪০) নামে এক ভুয়া ডাক্তারকে অপারেশন টেবিলে হাতেনাতে গ্রেফতার করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। ভুয়া ওই ডাক্তার জনস্বাস্থ্য জেনারেল হাসপাতালে হানিফা আক্তার (১৭) নামে এক কিশোরীর এপেন্ডিসাইটিসের অপারেশন করছিলেন। পরে তাকে দুই বছরের কারাদ  দেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট। বিএমডিসির হিসাবে শুধু রাজধানীতে আড়াই সহস্রাধিক ভুয়া ডাক্তার রয়েছেন। সারা দেশে এ সংখ্যা ২০ হাজারেরও বেশি। বাস্তবে বিএমডিসির হিসাবের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি ভুয়া ডাক্তার ঢাকাসহ সারা দেশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। ভুয়া ডাক্তারের পাশাপাশি জাল ডিগ্রিধারী ‘বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের’ সংখ্যাও কম নয়। তারা এমবিবিএস পাসের পর নামের আগে-পিছে দেশ-বিদেশের ভুয়া উচ্চতর ডিগ্রি ব্যবহার করে রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন। বছরের পর বছর রোগী দেখে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অঙ্কের ফি।

র‌্যাব সূত্র জানায়, র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে রাজধানীতে প্রায়ই ভুয়া ডাক্তার গ্রেফতার হচ্ছেন। সম্প্রতি বেশ কয়েকজন ভুয়া ডাক্তারকে রোগীদের চিকিৎসায় ব্যস্ত থাকাবস্থায় আটক করা হয়েছে। এ ছাড়া সিলেট, চট্টগ্রাম, রংপুর ও খুলনা মহানগরীর বিভিন্ন ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ফার্মেসিতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। র‌্যাব সূত্র জানায়, ভুয়া ডাক্তাররা প্রায়ই তাদের ব্যবসার স্থান পরিবর্তন করে এবং কৌশলে সহজ সরল মানুষকে ফাঁকি দিয়ে ব্যবসা চালিয়ে থাকেন। রাজধানীর প্রতিটি থানা এলাকায় এরকম ভুয়া ডাক্তারের অভাব নেই। অনুসন্ধানে জানা গেছে, শতকরা ৯০ ভাগ ভুয়া ডিগ্রিধারী ডাক্তার দ্বারাই বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক-নার্সিং হোমের চিকিৎসাসেবা পরিচালিত হচ্ছে। বাণিজ্যের লক্ষ্যে ভুয়া ডাক্তাররা নামের পেছনে এফআরএসএইচ, এমএসিপি, এফএসিপি, পিজিটি, এমডি ও এফসিপিএস (ইনকোর্স) ও পার্ট-১ অথবা পার্ট-২-সহ বিভিন্ন ডিগ্রির কথা উল্লেখ করে থাকেন। শুধু তাই নয়, ভুয়া ডিগ্রির সঙ্গে লন্ডন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের নামও উল্লেখ করা হয়। এ কারণে সাধারণ রোগীরা এসব ডাক্তারকে বিদেশি  ডিগিগ্রাপ্ত বলে মনে করেন। এত এত ডিগ্রি দেখে সরল মনে ভুয়া ডাক্তারদের দেখানোর জন্য ভিড় জমান। এ সুযোগে ভুয়া ডাক্তাররা রোগী প্রতি ফি নেন পাঁচশ থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, ভুয়া ডাক্তারদের খপ্পরে পড়ে অনেকের জীবন আশঙ্কার মধ্যে পড়ে। অনেকের মৃত্যুও হয়েছে। ভুয়া ডাক্তারদের সমূলে নির্মূল করতে হবে। এতে করে বহু রোগীর জীবন রক্ষা পাবে। তিনি বলেন, ভুয়া ডাক্তারদের নির্মূলের দায়িত্ব যেমন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আবার বিএমডিসিরও দায়িত্ব রয়েছে। সাধারণ মানুষকেও একটু খোঁজ-খবর নেওয়া উচিত। একটু সচেতন হলেই এ ধরনের ভুয়া চিকিৎসকের খপ্পর থেকে নিজেদের রক্ষা পাওয়া যায় বলে মনে করেন তিনি।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর