রবিবার, ২৪ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা
নদী বাঁচাও ৩৯

তুলসীগঙ্গা এখন কচুরিপানার ভাগাড়

বাবুল আখতার রানা, নওগাঁ

তুলসীগঙ্গা এখন কচুরিপানার ভাগাড়

নওগাঁ শহরের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত তুলসীগঙ্গা নদী এখন মৃতপ্রায়। একসময় দাপট নিয়ে বয়ে চলা নদীটি রূপ নিয়েছে ময়লার ভাগাড়ে। তুলসীগঙ্গা জুড়ে জমে আছে কচুরিপানা। বছরের বছর পর দখল আর দূষণের কারণে নদীটি পরিণত হয়েছে সরু খাল ও কচুরিপানার জঙ্গলে।

বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা দিনাজপুরের শালখুড়িয়া ইউনিয়নের বিলাঞ্চল এলাকা থেকে নদীটির উৎপত্তি। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া নদী পরিচিতিতে এর দৈর্ঘ্য ১০০ কিলোমিটার উল্লেখ করা হয়েছে। এটি সদর উপজেলার চ-ীপুর এলাকায় ছোট যমুনা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। নদীটির প্রায় ২০ কিলোমিটার সদর উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। ১৯৮৭ সালে সদর উপজেলার ছিটকিতলা এলাকায় স্লুইস গেট নির্মাণ করা হয়। ওই এলাকায় তুলসীগঙ্গা থেকে একটি খাল খনন করে এর প্রবাহ ছোট যমুনার সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়। মূলত সেই সময় থেকেই তুলসীগঙ্গা তার নাব্যতা হারিয়ে ফেলে। ৩০ বছর ধরে বর্ষা মৌসুমে দুই-তিন মাস প্রবাহ থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে এটি পানিশূন্য হয়ে পড়ে। নদীর কোথাও কোথাও পানি শুকিয়ে মাঠে পরিণত হয়। ওই সব স্থান দিয়ে পায়ে হেঁটে নদী পার হওয়া যায়। নদীর পাড় জুড়ে চলছে দখলদারি। তীরবর্তী এলাকায় স্থাপিত চাতালের ছাই ফেলা, পৌরসভার পয়োবর্জ্য ও গৃহস্থালিসহ সব ধরনের বর্জ্যে বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়েছে তুলসীগঙ্গা। নওগাঁ পৌরসভার রজাকপুর এলাকায় তুলসীগঙ্গা সেতুর দুই পাশে নদী জুড়ে যেন ময়লার ভাগাড়। সেতুর নিচে প্রচুর বর্জ্য ফেলা রয়েছে। নদীর বুক জুড়ে শুধুই কচুরিপানা। অনেক স্থানে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় পায়ে হেঁটে নদী পারাপার হচ্ছে মানুষ। সেতুর উত্তর দিকে তুলসীগঙ্গার উজানে পশ্চিম পাশে পাড়ে স্থাপিত তিনটি চালকলের উৎপাদিত ছাই ফেলা হচ্ছে নদীতে। ফলে ছাইয়ের স্তূপ জমে রয়েছে নদীতে। পূর্ব পাশে ভাটির অংশে পাড় ঘেঁষে স্থাপন করা হয়েছে দুটি চালকল, দুটি ইটভাটা, চাল-গমসহ বিভিন্ন খাদ্যশস্য ছাঁটাইয়ের কারখানা। সেগুলো থেকেও নদীতে প্রতিনিয়ত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। পৌরসভার ভবানীপুর, কাঁঠালতলী ও রজাকপুর এলাকার বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও কারখানার নর্দমার ময়লা পানি এসে পড়ছে নদীতে। তুলসীগঙ্গার তীরবর্তী নওগাঁ পৌরসভার কাঁঠালতলী এলাকার বাসিন্দা মোশাররফ হোসেন ও আবদুস সামাদ বলেন, এই নদীতে একসময় সারা বছর নৌকা চলত। নৌকায় করে মানুষ কৃষিজাত পণ্য স্থানীয় বিভিন্ন হাটবাজারে নিয়ে যেত। মালামাল পরিবহন করা যেত কম খরচে। কিন্তু এখন বর্ষার সময় দুই-তিন মাস ছাড়া নদীতে পানিই থাকে না। রজাকপুর এলাকার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব জহির উদ্দিন ম-ল বলেন, আগে তুলসীগঙ্গার পানি টলটল করত। এখন এখানে পানিই থাকে না। নদীর নিচু জায়গাগুলোতে একটু করে পানি দেখা গেলেও সেগুলো ময়লা-আবর্জনার কারণে কালো দেখা যায়। পচা দুর্গন্ধ ছড়ায়। তুলসীগঙ্গা ও ছোট যমুনা নদী বাঁচাতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে যাচ্ছে স্থানীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদ। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মেহমুদ মোস্তফা বলেন, একুশে পরিষদ ছোট যমুনা ও তুলসীগঙ্গা নদীর দখল-দূষণ দূর করে প্রবাহ স্বাভাবিক করার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে। একাধিকবার মানববন্ধন করা হয়েছে। সম্প্রতি নদীকে দূষণমুক্ত করতে শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে লিফলেট বিতরণ ও মানববন্ধন করা হয়েছে। তবে শুধু আন্দোলন করলে হবে না, প্রশাসন কিংবা সরকার যদি এই দাবিগুলোর দিকে কর্ণপাত না করে, তাহলে কার্যত কোনো লাভ হবে না। আমাদের দাবি, অচিরেই নদী দখলদারদের চিহ্নিত করে তাদের স্থাপনাগুলো সেখান থেকে উচ্ছেদ করা হোক। পাশাপাশি পুনঃখনন করে প্রবাহ আবারও ফিরিয়ে আনা হোক। নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুধাংশু কুমার সরকার বলেন, তুলসীগঙ্গার পানি প্রবাহ স্বাভাবিক করতে সদর উপজেলার চককুতুব রেগুলেটর থেকে নওগাঁ শহরের তুলসীগঙ্গা সেতু পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার নদী খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে একটি প্রকল্প পাস হয়েছে এবং ঠিকাদারও নির্ধারণ করা হয়েছে। ১০ কিলোমিটার অংশ খননে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ কোটি টাকা।

সর্বশেষ খবর