বৃহস্পতিবার, ৪ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

ইংরেজি অদক্ষতায় সংকুচিত হচ্ছে কর্মক্ষেত্র

বাড়ছে কম ইংরেজি জানা শিক্ষিত বেকার। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি, ফ্রিল্যান্সিং কর্মসংস্থানে দরকার ইংরেজি দক্ষতা

শামীম আহমেদ

ইংরেজি অদক্ষতায় সংকুচিত হচ্ছে কর্মক্ষেত্র

ইংরেজির গুরুত্ব মুখে বললেও সরকারি পর্যায়ে নেই ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা চালুর কোনো উদ্যোগ। হাতেগোনা কিছু বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল মানসম্মত ইংরেজি শিক্ষা দিলেও সে সুযোগ পাচ্ছে দেশের ১ শতাংশেরও কম শিক্ষার্থী। কিন্তু হচ্ছে না কাক্সিক্ষত ইংরেজি শিক্ষা। ফলে বৃহৎ পরিসরে ইংরেজিতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে না ওঠায় সংকুচিত হচ্ছে কর্মক্ষেত্র। বাড়ছে কম ইংরেজি জানা শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি, ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে কর্মসংস্থান কোনো ক্ষেত্রেই আসছে না কাক্সিক্ষত সাফল্য। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের কর্মক্ষেত্রে নিজেদের নিয়োগ করতে না পারায় চাপ বাড়ছে দেশের সংকুচিত চাকরির বাজারে। অন্যদিকে লাগামহীন টিউশন ফি নিয়ে অভিভাবকদের পকেট কেটে নিচ্ছে বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলো। উচ্চ টিউশন ফির কারণে স্বল্প আয়ের অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ইচ্ছা থাকলেও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করাতে পারেন না।

ইংরেজি অদক্ষতার করুণ চিত্র ফুটে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরিক্ষায়। ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ভর্তি পরীক্ষায় ৪০ হাজার ৫৬৫ পরীক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র দুজন ইংরেজি বিভাগে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করে। ২০১৬ সালে গ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ৯০ ভাগ পরীক্ষার্থী ফেল করে ইংরেজিতে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ১৭ বছরের শিক্ষাজীবন শেষেও ইংরেজিতে দক্ষতা অর্জিত হচ্ছে না। বছরে ৫ লাখ তরুণ-তরুণী উচ্চশিক্ষা শেষ করলেও ইংরেজি দক্ষতার অভাবে কর্মক্ষেত্রে প্রতিকূলতার মুখোমুখি হচ্ছে। ৪৭ ভাগ স্নাতক চাকরি পাচ্ছে না। ইংরেজি দক্ষতা থাকলে কর্মক্ষেত্র দেশের বাইরেও বিস্তৃত হতো। সরকারি স্কুলগুলোয় ইংরেজি মাধ্যম চালু করতে পারলে দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী ইংরেজি শিক্ষার আওতায় আসত। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বাংলাদেশের প্রাকপ্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার্থী আছে প্রায় চার কোটি। দেশে নিবন্ধিত ১৪৬টি বেসরকারি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ছে মাত্র ৭৯ হাজার শিক্ষার্থী যা মোট শিক্ষার্থীর দশমিক ২০ শতাংশ। বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে সারা দেশে এ ধরনের স্কুলের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিনশ। শিক্ষার্থী তিন লাখের মতো। সবগুলো বিবেচনায় ধরলেও ইংরেজি মাধ্যমে (বিদেশি ও বাংলাদেশি কারিকুলাম) পড়া শিক্ষার্থীর হার দশমিক ৭৫ শতাংশ। উচ্চ বেতন দিয়েও ১ শতাংশের কম শিক্ষার্থী ইংরেজি মাধ্যমে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। অথচ, সারা দেশে মোট ১ কোটি ৭৩ লাখ প্রাথমিক শিক্ষার্থীর ১ কোটি ৩০ লাখই (৭৫ ভাগ) পড়ছে সরকারি স্কুলে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইংরেজি শুধু একটি ভাষা নয়, এটাকে এখন একটি টেকনোলজি হিসেবে দেখা হয়। আন্তর্জাতিক যোগাযোগে এটা স্বীকৃত মাধ্যম। কিন্তু আমাদের নীতিনির্ধারকরা ইংরেজিকে বিজাতীয় ভাষা বলে এক ধরনের দেশপ্রেমের সংজ্ঞা তৈরি করেছেন। যেন ইংরেজিকে গুরুত্ব দিলে বাংলাকে ছোট করা হবে। এটা দৃষ্টিভঙ্গির কারচুপি। বাংলাকে আমরা নিজ দায়িত্বেই প্রাধান্য দেব। দৃষ্টিভঙ্গির এই কারচুপির কারণে সাধারণ জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে। এলিট শ্রেণি এবং নীতিনির্ধারকরা ঠিকই নিজেদের সন্তানদের সম্পূর্ণভাবে ইংরেজিতে দক্ষ করে গড়ে তুলছে। বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারি স্কুলগুলোয় ক্রমান্বয়ে বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি ভার্সন চালু করতে পারলে গরিব ঘরের মেধাবী শিক্ষার্থীরা পড়তে পারত। তবে এক্ষেত্রে শুধু ঘোষণা দিলেই হবে না। অনেক নতুন শিক্ষক লাগবে। তাদেরকে দক্ষ করতে হবে। এটার জন্য পরিকল্পনা করে যা যা করণীয় সব করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ইংরেজি দক্ষতার অভাবে আমরা আন্তর্জাতিক দেন-দরবারে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইংরেজি ভার্সন চালু করতে পারলে ভালো হতো। তবে বর্তমান বেতন কাঠামো দিয়ে ভালো শিক্ষক পাওয়া যাবে না। আর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া এটা করতে গেলে হিতে বিপরীত হবে। প্রকল্প হবে, টাকা খরচ হবে, লাভ হবে না। প্রশিক্ষণের নামে অনেকে দেশে দেশে ঘুরবেন। প্রশিক্ষণ থেকে ফিরে এসে অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়ে যাবেন। বরাদ্দের ১ শতাংশও শিক্ষায় ব্যয় হবে না। এ জন্য সামগ্রিক শিক্ষা খাত নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাইমারি, দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক ও পরে উচ্চশিক্ষা- এভাবে পরিকল্পনা করতে হবে। অকার্যকর একটা পদ্ধতি কলেজ শিক্ষা। এটা তুলে দেওয়া উচিত। উচ্চশিক্ষার একটা কৌশলপত্র আমি সম্পাদনা করে জমা দিয়েছি। এখন প্রাইমারি, মাধ্যমিকের কৌশলপত্র তৈরি করে সমন্বিতভাবে এগোতে পারলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন সম্ভব। তবে এখানে শিক্ষাবিদরা শিক্ষা খাত চালায় না। এখানেই সমস্যা। যে কারণে ২০১০ সালে হওয়া শিক্ষানীতি ৯ বছর ধরে হিমাগারে পড়ে আছে।

 

সর্বশেষ খবর