শিরোনাম
বুধবার, ৩১ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

গোপন প্রেমের ভয়ঙ্কর পরিণতি

মির্জা মেহেদী তমাল

গোপন প্রেমের ভয়ঙ্কর পরিণতি

নাটোরের সিংড়ার একটি শান্ত গ্রাম গটিয়া। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই কৃষিকাজ করেন। কাক ভোরে কৃষকরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায় দল বেঁধে। সন্ধ্যার পরপরই নীরব হয় পুরো গ্রাম। একদিন ভোর বেলাতেই পুরো গ্রাম জেগে ওঠে। গ্রামের একটি আইলের পাশে মিলল গলা কাটা লাশ। একজন নারীর। ওই পথেই যাচ্ছিলেন কয়েকজন কৃষক। তাদের চোখে পড়ে লাশটি। আঁতকে ওঠেন তারা। রক্তাক্ত লাশের কাছে গিয়ে নারীর চেহারা দেখে চেনার চেষ্টা করেন। একজন বলে ওঠেন, আরে এ তো হোসেন আলীর বউ শাপলা। তারে মারল কে? নিজেরাই বলাবলি করছে। ভয়ও পান। তারা এবার চিৎকার করতে থাকেন। কে কোথায় আছ। তাড়াতাড়ি আস। চিৎকার চেঁচামেচিতে একজন দুজন করতে করতে মানুষের ভিড় লেগে যায়। এক ঘর থেকে আরেক ঘর। এক পাড়া থেকে আরেক পাড়া। গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম। মানুষ ছুটে আসছে দেখতে। পুলিশ আসে খবর পেয়ে। পুলিশ লাশটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখে। ঘাতক ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলা কেটে হত্যার পর ফেলে রেখে গেছে। কিন্তু কারা করল এমন কা । দুই সন্তানের জননী শাপলাকে এভাবে নৃশংস কায়দায় কে মারতে পারে, কারও মাথায় ঢুকছে না। পুলিশও ভীষণ চিন্তিত। শাপলার স্বামী আলী হোসেন আছেন মধ্যপ্রাচ্যে। ডাকাতি বা অন্য কোনো ঘটনাও ঘটেনি। বাসা থেকে বেশ খানিকটা দূরে লাশ পড়ে আছে। পুলিশ একটা বিষয় নিশ্চিত যে, রাতেই ঘটনাটি ঘটেছে। ঘটনাস্থলের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, অন্য কোথাও নয়, সেখানেই তাকে হত্যা করা হয়েছে এবং তা পরিকল্পিতভাবেই। শাপলার ভাই এ ঘটনায় মামলা দায়ের করেন। পুলিশ তদন্ত শুরু করে। পুলিশ নানা দিক তদন্তের পাশাপাশি শাপলার সঙ্গে কারও কোনো সম্পর্ক ছিল কিনা, তাও মাথায় রেখেছে। কিন্তু সেরকম কোনো কিছু পাচ্ছে না পুলিশ। শাপলা শ্বশুর বাড়িতেই থাকতেন। শ্বশুরবাড়িতে থেকে পরকীয়ায় জড়িত হওয়ার কোনো তথ্য-প্রমাণও খুঁজে পায় না পুলিশ। স্বামী বিদেশ থাকার কারণে শাপলার আর্থিক অবস্থাও ছিল ভালো। বিষয়টি গ্রামের অনেকেই জানত। তবে কি টাকা পয়সার জন্য খুন হলো? সেদিকেও কিছু পায় না পুলিশ। শ্বশুরবাড়িতে দুই সন্তান, শ্বশুর-শাশুড়ি ছাড়াও থাকে তার এক দেবর। ২০-২২ বছরের দেবর বাবুকে সন্দেহ করলেও জোড়ালো কোনো তথ্য নেই পুলিশের হাতে।

পুলিশের পর্যবেক্ষণে দেবর বাবুর গতিবিধি কেমন যেন সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। যদিও ঘটনার সময় বাবু এলাকাতেই ছিল না। এ বিষয়টি পুলিশ পড়ে মাথায় নিয়েছে। বাবু কোথায় ছিল সেই রাতে। ততদিনে বাবু পালিয়ে যায়। দীর্ঘ চার মাস পরে ধরা পড়ে বাবু। পুলিশ বাবুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যায়। তাকে জেরা করে পুলিশ। কিন্তু বেশি সময় লাগেনি পুলিশের। বাবুর কাছ থেকে বেরিয়ে আসে খুনের রহস্য। বাবু পুলিশের কাছে পুরো ঘটনা খুলে বলে।

বড় ভাই হোসেন আলী মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানে চলে যান। এই সুযোগে ছোট ভাই বাবু তার ভাবী শাপলা খাতুনের সঙ্গে গড়ে তোলেন প্রেমের সম্পর্ক। ভাইয়ের অনুপস্থিতি প্রেমের সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকে বাবু আলী এবং শাপলা খাতুন। তাদের সেই প্রেম গড়ায় শারীরিক সম্পর্কে। দুই সন্তানের জননী শাপলা খাতুন গর্ভবতী হয়ে পড়েন। দেবর বাবু আলীকে বিয়ে করার প্রস্তাব  দেন ভাবী শাপলা খাতুন। এতে বাবু ভীষণ চিন্তায় পড়ে যান। একপর্যায়ে বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয় বাবু। ভাবীকে বলে, বিয়ে করলে তো আমরা এখানে থাকতে পারব না। তাই টাকা পয়সা যা আছে নিয়ে নাও। বিয়ে করে বাসা ভাড়া করে অন্য কোথাও থাকব। আর ফিরব না কোনোদিন। প্রেমিক দেবরের কথা শুনে শাপলা ভীষণ খুশি। সে প্রস্তুতি নেয়। সব ফেলে প্রেমিকের হাত ধরে পালাবে সুখের সন্ধানে।

একদিন রাত ১২টায় শাপলা দুটি বাচ্চা রেখে প্রেমিক বাবুর মোটরসাইকেলে চেপে বসেন। তাদের সঙ্গে ছিল বাবুর বন্ধু রহিম। তারা বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে অজানার উদ্দেশে। কিন্তু বেশিদূর তারা যায়নি। শালৈ নামক এলাকায় বাবু মোটরসাইকেল থামায়। নির্জন যায়গা। শাপলা তাকে বলে, বাবু, মোটরসাইকেলের স্টার্ট বন্ধ করলে কেন। বিপদ হতে পারে, তাড়াতাড়ি চলো। কেউ যেনে ফেললে বিপদ হবে। বাবু বলে, বিপদ যেন না হয়, সে জন্যেই তো স্টার্ট বন্ধ করেছি। তুমি নামো সাইকেল থেকে। শাপলা মোটরসাইকেল থেকে নামে। শাপলা কিছুই বুঝতে পারল না। বাবুর বন্ধু রহিম পেছন থেকে শাপলাকে হঠাৎ ধরে শুইয়ে দেয়। বাবু ধারালো অস্ত্র বের করে মুহূর্তেই শাপলার গলায় চালিয়ে দেয়। ফিনকির মতো রক্ত বেরোতে থাকে। শাপলা তাদের বাধা দেওয়ারও সুযোগ পায়নি। সেখানেই তার মৃত্যু ঘটে। বাবু আর রহিম শাপলার ব্যাগ হাতিয়ে পায় এক লাখ টাকা আর মোবাইল ফোন। সেটি নিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে দুজনই হাওয়া। সুখের সন্ধান করতে যেয়ে ভয়ঙ্কর পরিণতির শিকার শাপলার রক্তাক্ত দেহ পড়ে থাকে সেখানেই। শাপলা খাতুনকে হত্যার মধ্য দিয়ে অসম প্রেমের এক ভয়ঙ্কর পরিণতি ঘটে।

পুলিশ জানায়, শাপলা চেয়েছিল তার বয়সের ছোট প্রেমিক বাবুর সঙ্গে পালিয়ে যাবে। সুখের সংসার গড়বে। কিন্তু সেই আশা তার পূরণ হয়নি। সুখের জন্যে যে প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়েছিল, সেই প্রেমিকই তাকে জবাই করে হত্যা করে। পরিণতি হয় ভয়ঙ্কর ভাবে। শাপলার ভুল সিদ্ধান্তে নিজের প্রাণ শুধু যায়নি, মা হারা হয়েছে তার অবুঝ দুই সন্তান। স্বামী হারিয়েছে তার স্ত্রীকে। সংসার ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। অপরদিকে বাবু ভেবে ছিল শাপলাকে হত্যা করে সে নিজে ফ্রি হয়ে যাবে। টাকা নিয়ে ভালো থাকবে। কিন্তু আইনের হাত অনেক লম্বা। সে বুঝতে পারেনি। খুনের পরিণতি ফাঁসির দড়ি। এমন ঘটনার রায় সর্বোচ্চ সাজা। আর সর্বোচ্চ সাজা হওয়ার আগে তাকে কাটাতে হবে অন্ধকার কারাগারে। সংসার ভেঙে পরকীয়ায় কখনো সুখ খুঁজে পাওয়া যায় না। এসব ঘটনার পরিণতি হয় ভয়ঙ্কর। যা শাপলা আর বাবুর জীবনে ঘটে গেছে।

সর্বশেষ খবর