রবিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

থামছেই না পদ্মার দূষণ

কাজী শাহেদ, রাজশাহী

থামছেই না পদ্মার দূষণ

পদ্মা নদীতে ফেলা হচ্ছে আবর্জনা। ছবিটি নগরীর শ্রীরামপুর থেকে তোলা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজশাহীর পাশ দিয়ে তীব্র স্রোতে বয়ে চলা পদ্মা নদী দূষণের কবলে পড়ছে। নদীতে শহরের কঠিন ও তরল দুই ধরনের বর্জ্যই ফেলা হচ্ছে নির্দ্বিধায়। এসব বর্জ্য গিয়ে মিশছে নদীর পানিতে। রাজশাহীতে যারা নদী নিয়ে গবেষণা করছেন তারা শঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, এখনই দূষণ আর দখল থামাতে না পারলে বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপনে এর প্রবল প্রভাব পড়বে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বাড়ি-ঘরের ভাঙা টাইলস, পরিত্যক্ত কংক্রিটের টুকরোর মতো শক্ত আবর্জনাও ফেলা হচ্ছে নদীর পাড় ধরে। এ ধরনের শক্ত উচ্ছিষ্ট জিনিস ফেলার পেছনে কাজ করছে নদী দখলের মনোবৃত্তি। এই দৃশ্য আরও স্পষ্ট শহর রক্ষা বাঁধ জুড়ে। ইতিমধ্যে শহর রক্ষা বাঁধে বেশ কিছু স্থাপনা তৈরি হয়ে গেছে।

শহরের ভিতর পদ্মার পাশের এলাকাগুলোর বাসাবাড়ি থেকে প্রতিদিনের গৃহস্থালি সব ময়লা-আবর্জনা পদ্মা নদীতে ফেলা হচ্ছে। বিশেষ করে বুলনপুর, কেশবপুর, শ্রীরামপুর, কুমারপাড়া, সেখের চক, পঞ্চবটি, তালাইমারী ও শ্যামপুর এলাকা শহর রক্ষা বাঁধ ও নদীসংলগ্ন হওয়ায় বসতবাড়ির গৃহস্থালি সব ময়লা-আবর্জনাই পদ্মা নদীতে ফেলা হয়। এ ছাড়া পাঠানপাড়া, দরগাপাড়া, বড়কুঠি, শ্রীরামপুরসহ শহর রক্ষা বাঁধের নানা স্থানে বিভিন্ন ধরনের রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে। এসব রেস্তোরাঁর সব ধরনের প্লাস্টিক ও পলিথিন এবং বর্জ্য সরাসরি পদ্মা নদীতে ফেলা হয়। এ ছাড়া পাঁচটি স্লুইস গেটের মাধ্যমে শহরের তরল বর্জ্যও পদ্মা নদীতেই পড়ে।

এসব নিয়ে পরিবেশ অধিদফতরের অবশ্য মাথাব্যথা দেখা যায়নি। ‘পরিবেশদূষণের’ একটি ঘটনায় পদক্ষেপ নিতে চাইলেও গত তিন মাসে দুই বোতল পানিও পরীক্ষা করতে পারেনি সরকারি এই দফতরটি। গত আগস্টে কোরবানির ঈদে এক মৌসুমি ব্যবসায়ী চামড়া বিক্রি করতে না পেরে মনের দুঃখে সেই চামড়া পদ্মা নদীতে ফেলে দেন। খবর পেয়ে পরদিন ছুটে যায় পরিবেশ অধিদফতর। চামড়া ফেলে তিনি পরিবেশের দূষণ করেছেন বলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু কতটুকু পরিবেশের ক্ষতি করেছেন তা জানতে ওই দুই বোতল পানি সংগ্রহ করা হয়। পানিটুকু বগুড়ায় পরীক্ষার কথা ছিল। কিন্তু পরিবেশ অধিদফতরের স্থানীয় কর্মকর্তা বারবার জানিয়েছেন, পানি পরীক্ষার সেই ফল তারা এখনো পাননি।

পরিবেশ অধিদফতরের যখন এই অবস্থা তখন শহরের পাশে নানা কারণে পানিদূষণ চলছে। নগরীর কুমারপাড়া এলাকার সুবাসী দাশ বলেন, সিটি করপোরেশনের ভ্যান কোনো দিন আসে সন্ধ্যার দিকে, কোনো দিন আসে রাত ৮টার পর, আবার কোনো কোনো সময় ভ্যান খুঁজেই পাওয়া যায় না। এ ছাড়া গলির ভিতরে সিটি করপোরেশনের ভ্যান না ঢোকায় বাসাবাড়ির সব ময়লা পদ্মা নদীতে ফেলা হয়। কেশবপুর পুলিশ লাইনের সামনের টি-বাঁধেও অবাধে ময়লা ফেলা হয়। বাঁধ জুড়ে পড়ে আছে প্লাস্টিকের কাপ, বোতল ও পলিথিন। ১০ বছর ধরে বাঁধের ওপর পান-বিড়ির দোকান করছেন গোলাম রসুল। তিনি জানান, অনেক দিন ধরেই পদ্মা নদীতে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। এর আগে সিটি করপোরেশন ময়লা পরিষ্কার করত মাঝেমধ্যে। মাস ছয়েক ধরে করপোরেশনের লোকজন আর আসে না। আগে তবু পরিষ্কার করত। এখন প্লাস্টিকের কাপ, বোতল, পলিথিন ও কাগজের ঠোঙা সব পদ্মা নদীতেই ফেলা হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান জানান, শহরের মধ্যে থেকে স্লুইস গেটের মাধ্যমে যে তরল বর্জ্য পদ্মা নদীতে পড়ে এর মধ্যে দরগাপাড়া এলাকায় তরল বর্জ্যরে মধ্যে ক্ষতিকর উপাদান বেশি পাওয়া গেছে। এসব বর্জ্যরে ফলে পদ্মা নদীর পানিদূষণ বাড়ছে। এর ফলে পদ্মায় জলজ জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। কারণ ইতিমধ্যে দেখা গেছে রাজশাহীর পবা উপজেলার বারনই নদীতেও শহরের তরল বর্জ্য পড়ে ওখানকার জলজ জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে গেছে। বহুলাংশে কমে গেছে বারনইয়ের মাছসহ জলজ প্রাণী। সেভ দ্য ন্যাচারের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, ‘পদ্মা নদীর জন্য সবচেয়ে মারাত্মক হচ্ছে প্লাস্টিক বর্জ্য ও পলিথিনের ব্যাগ। এগুলো নদীর পানির দূষণ বাড়াচ্ছে। পদ্মা নদীর জীববৈচিত্র্য কমিয়ে দিচ্ছে। আমরা পলিথিনের ব্যবহার কমানোর আন্দোলন করেও কোনো লাভ হচ্ছে না।’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমি কয়েক বছর আগে পদ্মা নদীতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্লুইস গেটের মাধ্যমে সিটি করপোরেশনের যে তরল বর্জ্য যাচ্ছে তা গবেষণা করে দেখেছি। এতে দূষণের মাত্রা ব্যাপক। আর এটা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এর আগে পদ্মা নদীতে শুশুক দেখা গেলেও এখন আর দেখা যায় না। মাছের পরিমাণও বহুলাংশে কমে গেছে। এ ছাড়া পদ্মা নদীর পানি কৃষিকাজে ব্যবহারে স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়াচ্ছে। কারণ গবেষণায় দেখা গেছে, পদ্মা নদীর পানি কৃষিকাজে ব্যবহারের ফলে কৃষিজমিতে ধাতব পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর