বৃহস্পতিবার, ৬ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

ব্ল্যাকমেল অতঃপর খুনোখুনি

মির্জা মেহেদী তমাল

ব্ল্যাকমেল অতঃপর খুনোখুনি

ফাঁদ পেতে অন্ধকারে মিশে আছে ওরা। সংখ্যায় পাঁচজন। আশপাশে আর অন্য কোনো মানুষের দেখা নেই। পাঁচজনের একজন হলো ওহাব। প্রতিশোধের আগুনে পুড়ছে। সে যেন আর অপেক্ষা করতে পারছে না। বারবার উঠে যাচ্ছে। উঁকিঝুঁকি দিয়ে সামনে দেখছে। ফিরে এসে আবারও বসছে। সঙ্গী-সাথীদের জিজ্ঞাসা করছে, ‘কিরে আইবো তো! কী মনে হয়। রাইত কি পার হইবো নাকি?’ ধৈর্য হারিয়ে ফেলছে ওহাব। হঠাৎ দূরে একটা সিগারেটের আগুন দেখা যাচ্ছে। তাদের দিকেই কেউ আসছে। ওই এলাকায় গভীর রাতে তো সাধারণের চলাফেরা করার কথা না। ভাবছে ওহাব। সিগারেটে জোরে জোরে টান দেওয়া দূর থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ওহাব বলছে, ‘ঠিকই আছে। সুমন আইতাছে। জোরে জোরে সিগারেট টানার অভ্যাস ওরই আছে।’ যাকে ফাঁদ হিসেবে রাখা হয়েছে সেই রাজিয়াও প্রস্তুত। রাজিয়া হলো ওহাবের স্ত্রী। ‘ওই সুমন আইছে’ -ওহাবের এমন কথা শুনেই তার বন্ধুরা নিজেদের একটু আড়াল করে নেয়। তাদের পাশ কাটিয়ে সুমন এগোতে থাকে। গুন গুন করে গানও গাচ্ছিল সুমন। ওর পিছু নেয় ওহাবসহ চারজন। সুমন কিছুই টের পায়নি। সে এখন ওহাবের স্ত্রী রাজিয়ার ঘরের দরজায়। সেখানে দাঁড়ানো মাত্রই রাজিয়া দরজা খুলে সুমনের সামনে এসে দাঁড়ায়। দুজন মুখোমুখি। সুমন তাকে দেখে ভীষণ খুশি। বেশ কদিন পর তার প্রেমিকার সঙ্গে দেখা। খুশিতে সুমন সেখানেই তাকে জড়িয়ে ধরতে দুহাত বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু অন্য সময়ের মতো রাজিয়া তার আহ্‌বানে সাড়া দেয় না। কারণ সুমনের ঠিক পেছনেই নীরবে এসে দাঁড়িয়েছে ওহাব। তার দুই পাশে চার কিলার। পাঁচজনে সুমনকে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয়। ওহাবের স্ত্রী রাজিয়া কোনো ধরনের কথাবার্তা ছাড়াই নিজ ঘরে ঢুকে যায়। এরপর নৃশংস খুন ও গুম।

রাজধানীর কদমতলী এলাকার ঘটনা এটি। পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে জীবন দিতে হয়েছে সুমন নামের এই যুবককে। তার প্রেমিকাই ভয়ঙ্কর ফাঁদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এক দিনের ফাঁদেই ধরা পড়ে সুমন এবং পরবর্তীতে নৃশংস খুনের শিকার হন। শুধু তাই নয়, বেওয়ারিশ হিসেবেই তার লাশ দাফনের সব প্রক্রিয়াই শেষ হয়েছিল। কিন্তু একজন হিজড়া এই খুনের ঘটনাটি দেখে ফেলায় অন্তত তার পরিচয়টি খুঁজে পায় পুলিশ। এ ঘটনায় ওহাব ও তার স্ত্রী রাজিয়া গ্রেফতার হয়। তারা এখন কারাগারে।

প্রযুক্তি আমাদের অনেক দিয়েছে আবার কেড়েও নিয়েছে কিছু কিছু। রাজিয়া ও ওহাবের দাম্পত্যে তৃতীয় পুরুষ হয়ে দেখা দিয়েছিল যুবক সুমন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রাণ দিতে হয়েছে তাকে। কারণ ইন্টারনেটে রাজিয়ার সঙ্গে সুমনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কিছু ভিডিও দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি ওহাব। শেষ পর্যন্ত তার হাতে খুন হতে হয় সুমনকে। নিজের জবানীতেই চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকান্ডের কথা স্বীকার করে ওহাব, জানিয়েছেন কীভাবে খুন করা হয় সুমনকে। পুলিশের জেরার মুখে ওহাব বলেছে, ‘আমার স্ত্রীর সঙ্গে সুমন শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। আমি যখন শুনি আর ইন্টারনেটে দেখি, তখন আমার সন্তান নিয়ে আত্মহত্যার পরিকল্পনা করি। কিন্তু আমার এক বড় ভাই আমাকে জানায়, আত্মহত্যা না, প্রতিশোধ নে। আমি প্রতিশোধ নিতে সুমনের গলা কেটে খুন করি। তার আগে রাজিয়াকে ফাঁদ হিসেবে রাখি। জানি রাজিয়ার কথা শুনেই ছুটে আসবে সুমন।’ ২০১৭ সালের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে কদমতলীর ওয়াসার পুকুরপাড় এলাকার একটি ম্যানহোল থেকে অজ্ঞাত এক লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। কিন্তু তার নাম-পরিচয় কিছুই জানা সম্ভব হয় না। কদমতলী পুলিশ জানায়, প্রথম যেদিন সুমনের গলা কাটা লাশ উদ্ধার করা হয়, সেদিন আশপাশের কেউই তাকে শনাক্ত করতে পারেননি। নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ম্যাচিং, ডিএনএ প্রোফাইলিং, সব থানায় নিহতের ছবি পাঠিয়েও যখন তার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন এক হিজড়ার তথ্যে মেলে আশার আলো। ঘটনার পাঁচ দিন পর জানা যায়, খুন হওয়া ব্যক্তি যাত্রাবাড়ীর একজন ব্যবসায়ী। তার নাম সুমন। লাশ শনাক্ত হওয়ার পরও প্রশ্ন থেকে যায়- কী কারণে সুমন খুন হলো? কে তাকে খুন করল? ক্লুবিহীন এই হত্যা মামলার তদন্তে একপর্যায়ে আটক করা হয় ওহাবের শ্যালকসহ কয়েকজনকে। তাদের তথ্যে মুন্সীগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করা হয় ওহাবের স্ত্রী রাজিয়াকে। জিজ্ঞাসাবাদে রাজিয়া জানায়, ওহাব বরিশাল থেকে লঞ্চ কুয়াকাটা-১ এ ঢাকায় আসছে। ওদিকে চতুর ওহাব রাজিয়ার বর্ণিত লঞ্চে না এসে ভোরে ঢাকায় পৌঁছে অন্য একটি লঞ্চে। তবে পুলিশ বাহিনী প্রস্তুতই ছিল। লঞ্চ থেকে নামতেই গ্রেফতার করা হয় ওহাবকে। অন্য একটি মামলায় দীর্ঘদিন ধরে জেলে ছিল ওহাব। জেলখানায় পরিচয় হয় সুমনের সঙ্গে। তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরি হয়। কিছুদিন পর জামিনে বের হয় সুমন। সে সময় ওহাব তার স্ত্রী রাজিয়ার ফোন নম্বর সুমনকে দিয়ে হাজিরার দিন যেন কোর্টে আসে- সেই খবর দিতে বলে। জেল থেকে বেরিয়ে সুমন যোগাযোগ করে রাজিয়ার সঙ্গে। একপর্যায়ে পরকীয়ার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে সুমন ও রাজিয়া। রাজিয়ার সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটানোর সময় সেসব মুহূর্তের ভিডিও রাজিয়ার অজান্তেই ধারণ করে রাখে সুমন। এক সময় ওহাব জেল থেকে বের হয়। কিন্তু সুমন-রাজিয়ার সম্পর্ক থামে না। একপর্যায়ে রাজিয়ার সঙ্গে সুমনের সম্পর্কের টানাপড়েন চলে। সেই সময়ে দুজনের গোপন ভিডিও সুমন ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেন। এর কিছুই জানতেন না ওহাব। ওহাব তার মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে পর্নোভিডিও দেখতে দেখতে ঘটনাক্রমে তার স্ত্রী রাজিয়া ও সুমনের অন্তরঙ্গ ভিডিও দেখতে পান। পরদিন বিষয়টি সুনিশ্চিত হয়ে ঘটনার বিস্তারিত জানতে রাজিয়াকে চাপ দেন ওহাব। রাজিয়া স্বামীর কাছে পরকীয়া সম্পর্কের কথা স্বীকার করে। এরপর একপর্যায়ে ওহাব সিদ্ধান্ত নেয়, তাদের একমাত্র কন্যা সন্তানটিকে মেরে ফেলবে, তারপর নিজেও আত্মঘাতী হবে। বিষয়টি তার এক কথিত বড়ভাইকে জানায় ওহাব। সব শুনে সেই কিলার বড়ভাই বলেন, ‘আত্মহত্যা না করে প্রতিশোধ নে।’ এরপর অনেক খোঁজাখুঁজির পর হত্যার চার দিন আগে ওহাব সন্ধান পায় সুমনের। সুমনকে সে জানায় তার স্ত্রী রাজিয়াকে ছেড়ে দিয়েছে। ওদিকে ওহাব ফাঁদ হিসেবে তার স্ত্রী রাজিয়াকে ব্যবহার করে। রাজিয়াকে শিখিয়ে দেয়, সে যেন সুমনকে ফোন করে নিয়ে আসে। কথা মতো রাজিয়া সুমনকে ফোনে তার কাছে আসতে বলে। সুমন তো আগেই জানত যে, ওহাব তাকে ছেড়ে দিয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতেই সুমন রাজিয়ার কাছে যাওয়ার পরিকল্পনা আঁটে। সুমন আসবে- এমন সংবাদ পেয়ে ওহাব বড় ভাইয়ের দেওয়া লোকজনসহ চাকু ও ব্লেড নিয়ে প্রস্তুতি নেয়। ২৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় তারা পাঁচজন অপেক্ষা করতে থাকেন ওয়াসার গেটে। এক সময় সুমন এসে দাঁড়ান গেটে, রাজিয়াও এসে দাঁড়ান। এরপর সুমনকে সেখান থেকে তুলে নিয়ে যায় ঘাতকরা। অন্যদিকে রাজিয়া চলে যায় বাসার ভিতরে। পরবর্তী সময়ে ওহাবসহ ঘাতক পাঁচজন জেরা শুরু করে সুমনকে। প্রথমে ব্লেড দিয়ে সুমনের গোপনাঙ্গ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় ওহাব, যেন আর কারও সর্বনাশ না করতে পারে সে। কিন্তু বাদ সাধে বাকিরা, সবাই মামলা খাওয়ার ভয়ে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে সুমনকে নৃশংসভাবে জবাই করে লাশ স্লুইস গেটের ভিতর ফেলে দিয়ে পালিয়ে যায় সবাই। পরে স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পেয়ে সুমনের লাশ উদ্ধার করা হয় ম্যানহোল থেকে। তবে এসব দৃশ্য দেখে ফেলে একজন হিজড়া। তার দেওয়া তথ্যেই মেলে খুনিদের সন্ধান।

সর্বশেষ খবর