সোমবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

কৃষকের সার নিয়ে চার সিন্ডিকেট

শঙ্কায় বোরো আবাদ

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

কৃষকের সার নিয়ে চার সিন্ডিকেটের খোঁজ পেয়েছে সরকারের একটি বিশেষ সংস্থা, যে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সার চুরি, ডিলারের কাছে সময়মতো সার পৌঁছাতে বাধা সৃষ্টিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে এসেছে। সার আমদানি, পরিবহন ও ডিলারশিপের অসাধু সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে আগামীতে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছে বিশেষ সংস্থাটি। গত সপ্তাহে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো একটি প্রতিবেদনে সরকারের ওই বিশেষ বাহিনীটি বেসরকারি খাতের ৪টি সার পরিবহন ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের নাম উল্লেখ করে বলেছে, এসব পরিবহন ব্যবসায়ী সার পরিবহনের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সময়ক্ষেপণ, পরিবহনকালে সার চুরি, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে সার পরিবহন করতে না দেওয়াসহ বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে সময়মতো ডিলারের কাছে সার পৌঁছাতে বাধা সৃষ্টি করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়াতে ভূমিকা রাখছে।

বিশেষ সংস্থার তদন্তে উঠে আসা এই চার সিন্ডিকেট হচ্ছে- বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, তাইবা সাইফুল্লাহ জিএল, টোটাল শিপিং এজেন্সি এবং পোটন ট্রেডার্স।

সংশ্লিষ্টরা জানান, চলতি অর্থবছরে বিসিআইসি কর্তৃক ওপরের ৪টি প্রতিষ্ঠানকে ৫ লাখ ৩৩ হাজার ৩৪৩ মেট্রিক টন সার পরিবহনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে টোটাল শিপিং এজেন্সি ছাড়া বাকি ৩টি প্রতিষ্ঠান গুদামে পুরো সার পৌঁছাতে পারেনি।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ১ লাখ ৫৯ হাজার ৬৭৫ মেট্রিক টনের মধ্যে ৯৩ হাজার ৪৫১ মেট্রিক টন, তাইবা সাইফুল্লাহ জিএল ১ লাখ ৮৫ হাজার ৩৭৮ মেট্রিক টনের মধ্যে ১ লাখ ১৫ হাজার মেট্রিক টন এবং পোটন ট্রেডার্স ১ লাখ ৫৯ হাজার ৬৯২ মেট্রিক টনের মধ্যে মাত্র ৪৪ হাজার মেট্রিক টন সার গুদামে পৌঁছাতে পেরেছে।

বিশেষ সংস্থার পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, সার পরিবহন ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে  বেসরকারি খাতের নিয়ন্ত্রণে। মাত্র ৪টি প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেট তৈরির মাধ্যমে এই ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে। চলতি অর্থবছরের অর্ধেক সময় অতিবাহিত হলেও মাত্র একটি প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ সার পরিবহনে সক্ষম হয়েছে। সার পরিবহন ব্যবস্থায় অধিক সংখ্যক প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ করা না গেলে সিন্ডিকেটের এ দৌরাত্ম্য ভাঙা সম্ভব হবে না বলে ধারণা করছে ওই বিশেষ সংস্থাটি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, পরিবহনে সময়ক্ষেপণ ছাড়াও গুদাম ও সার কারখানা থেকে সার চুরি ও গায়েবের ঘটনাও ঘটেছে। চলতি বছরের মার্চে খুলনার বিএডিসির গুদাম থেকে ৭২৮ মেট্রিক টন এবং ২ ডিসেম্বর জামালপুরের সরিষাবাড়ী যমুনা সার কারখানা থেকে ২০ হাজার মেট্রিক টন ইউরিয়া সার গায়েবের ঘটনা ঘটেছে। সরকারি গুদাম থেকে সার গায়েবের ঘটনাটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে বিশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ অবস্থায় এই ৪ কোম্পানির সিন্ডিকেট ভাঙতে বিআরটিসির মাধ্যমে সার পরিবহন বাড়ানো এবং আরও বেশি প্রতিষ্ঠানকে সার পরিবহনে নিয়োগের সুপারিশ করেছে সরকারের বিশেষ সংস্থাটি। সূত্র জানায়, সার নিয়ে কৃত্রিম সংকটের বিষয়টি কৃষি মন্ত্রণালয় অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে মনিটর করছে। সার সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে এবং কৃষকের কাছে প্রয়োজনীয় সার পৌঁছাতে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্প্রতি বৈঠকও করেছেন। কৃষক পর্যায়ে সারের পর্যাপ্ত সরবরাহ ও সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে যাতে সার বিক্রি না হয়- তা নিশ্চিত করতে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কঠোর নজরদারি ও তদারকির নির্দেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া সরকারের বিশেষ সংস্থার প্রতিবেদন আমলে নিয়ে সার পরিবহনে সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিসিআইসিকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতেও বলা হয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিসিআইসির মহাব্যবস্থাপক (মার্কেটিং) মনজুর রেজা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, বিশেষ সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লিখিত ৪টি কোম্পানি ছাড়াও তারা আরও কয়েকটি কোম্পানির মাধ্যমে সার পরিবহন করে থাকে। এমনকি সরকারি সংস্থা বিআরটিসির গাড়িতেও তারা সারা দেশে সার পরিবহন করে। তবে আবাদ মৌসুমে সারা দেশে সার পরিবহনে প্রতিদিন যে পরিমাণ পরিবহনের প্রয়োজন তা বিআরটিসির নেই বলে জানান বিসিআইসির এই কর্মকর্তা। আর সে কারণেই বেসরকারি খাতের পরিবহনের ওপর নির্ভর করতে হয়। মনজুর রেজা আরও বলেন, উৎপাদন মৌসুমে প্রতিদিন ১৬ হাজার  মেট্রিক টন সার পরিবহন করার চাহিদা তৈরি হয়। সে লক্ষ্যে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে বেসরকারি পরিবহন ঠিকাদার সংস্থা নিযুক্ত করা হয়। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সেভাবেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, সম্প্রতি জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় যে পরিবহন ধর্মঘট হয়েছিল, সে কারণে কয়েক দিন সার পরিবহন করা যায়নি। এর এ পরিপ্রেক্ষিতে সার নিয়ে সাময়িক সংকট দেখা দিয়েছিল। তবে দ্রুতই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়েছে। এখন আর সার সরবরাহে পরিবহনজনিত কোনো সংকট নেই বলে তিনি দাবি করেন।

সর্বশেষ খবর