শনিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

ভেজাল তেলে আয়ু কমছে যানবাহনের

শামীম আহমেদ

ভেজাল তেলে আয়ু কমছে যানবাহনের

চলতি পথে মোটরসাইকেলের জ্বালানি কমে আসায় মঙ্গলবার রাজধানীর খিলক্ষেতের একটি খোলা দোকান থেকে ১ লিটার অকটেন নেন সাখাওয়াত হোসেন। নিকুঞ্জে পেট্রোল পাম্পে গিয়ে নেন আরও ৫ লিটার। ১০-১৫ কিলোমিটার চালানোর পরই বিগড়ে যায় বাইকটি। পথেই বারবার স্টার্ট বন্ধ হতে থাকে। এভাবেই চালান দুই দিন। একপর্যায়ে একেবারেই স্টার্ট নেওয়া বন্ধ করে দেয় বাইকটি। ২ কিলোমিটার বাইকটিকে ঠেলে গ্যারেজে নিলে তেলের সমস্যা বলে জানানো হয়। পুরো তেল ফেলে দিয়ে কার্বরেটর পরিষ্কার করানোর পর আবার ঠিক হয় বাইকটি।

শুধু মোটরসাইকেল নয়, ভেজাল তেলের কারণে হামেশাই বিপাকে পড়তে হচ্ছে চার চাকার যানবাহন চালকদেরও। অন্য গাড়ির পেছনে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যেতে হচ্ছে কয়েক কিলোমিটার দূরের গ্যারেজ পর্যন্ত। এতে শুধু ভোগান্তিই নয়, যানবাহনের আয়ুও কমে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবদুস সালাম আকন্দ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রতিটি ইঞ্জিন ডিজাইন করা হয় নির্দিষ্ট জ্বালানির জন্য। সেই জ্বালানি না দিলে ইঞ্জিনের পারফরম্যান্স কমে যাবে। কম শক্তি উৎপন্ন করবে। এতে জ্বালানি খরচ বাড়বে। যানবাহনের আয়ু কমে যাবে। সার্ভিস লাইফ শেষ হওয়ার আগেই বদলাতে হবে নানা যন্ত্রাংশ। যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বেড়ে যাবে। বিলাসবহুল অনেক গাড়ি নির্দিষ্ট জ্বালানি না দিলে ইঞ্জিনই স্টার্ট নেয় না। এসব গাড়িতে খুবই সতর্কভাবে জ্বালানি ব্যবহার করতে হয়। কম দামি গাড়ি মানহীন তেলে চললেও দ্রুত ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনের জন্য নির্ধারিত জ্বালানির চেয়ে হালকা জ্বালানি ব্যবহার করলে তা দ্রুত পুড়ে অল্প সময়ের জন্য পিস্টনে উচ্চচাপ ও তাপ তৈরি করে। তাপে অন্যান্য লুব্রিক্যান্ট শুকিয়ে যায়। আবার কম দামি ভারী জ্বালানি ব্যবহার করলে তা নির্দিষ্ট সময়ে পুরোপুরি পুড়বে না। অদাহ্য অংশ সাইলেন্সার দিয়ে বেরিয়ে বায়ুদূষণ ঘটাবে। প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপাদন না করায় যানবাহন পারফরম্যান্স কম দেবে। স্টার্ট নিতে চাইবে না। পারফরম্যান্স পেতে এক্সিলেশন বাড়িয়ে রাখতে গিয়ে ইঞ্জিন গরম হবে। উভয় ক্ষেত্রেই ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশের মারাত্মক ক্ষতি হয়।’

সাখাওয়াত হোসেনের বাইক মেরামতকারী ‘বাইক ন্যাশন’ নামের মোটরসাইকেল গ্যারেজের স্বত্বাধিকারী আবদুল কায়কোবাদ বলেন, ‘আমার গ্যারেজে ১০টি মোটরসাইকেল এলে দু-তিনটিতেই তেলজনিত সমস্যা পাই। খোলা তেলের ক্ষেত্রে এ সমস্যা বেশি। কিছু পেট্রোল পাম্পের তেল নিয়েও অভিযোগ আছে গ্রাহকদের। ভেজাল তেল ফেলার সময় দেখেছি তাতে কেরোসিন বা অন্য একটা গন্ধ। অনেক ক্ষেত্রে ঘোলা, এমনকি ময়লাও পাওয়া যায়। হাতে লাগলে পুরোপুরি শুকায় না। কিন্তু ভালো পেট্রোল-অকটেন অল্প সময়েই শুকিয়ে যায়।’

‘এ ওয়ান অটোসেন্টার’-এর স্বত্বাধিকারী মো. আল মামুন বলেন, ‘মাঝেমধ্যেই তেলের সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন গাড়ি আমার কাছে আসে। অনেক সময় দেখা যায় সার্ভিস লাইফ শেষ হওয়ার তিন-চার বছর আগেই বিভিন্ন যন্ত্রাংশ বদলাতে হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ ভেজাল তেল। নিয়মিত সার্ভিসিং না করালেও এ সমস্যা হয়। তেলের মান ঠিক না থাকলে ইনজেক্টরে সমস্যা হয়, গাড়ি শব্দ করে, ইঞ্জিনে কার্বন জমে, কালো ধোঁয়া বের হয়, ইএফআই সিস্টেম নষ্ট হয়ে যায়।’

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) তথ্যানুযায়ী, দেশে জ্বালানি তেল বিক্রির অনুমোদিত ফিলিং স্টেশনের সংখ্যা ২ হাজার ২৭১। এজেন্ট ডিস্ট্রিবিউটর ২ হাজার ৯১৯টি। এ ছাড়া আনাচে-কানাচে প্যাকড পয়েন্ট ডিলার, লাইসেন্সধারী, লাইসেন্সহীন লাখো প্রতিষ্ঠান তেল বিক্রি করছে। বাইরের দোকান থেকে খোলা তেল নিলেই গাড়ি নিয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। অনেক পেট্রোল পাম্পেও একই অবস্থা। গত মে মাসে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল কোম্পানি সারা দেশে ২৭টি পেট্রোল পাম্পে অভিযান চালিয়ে ১৮টিতেই ভেজাল তেল বিক্রি ও ওজনে কম দেওয়ার প্রমাণ পায়। এ ছাড়া মাপে কম দেওয়া ও মানহীন তেল বিক্রির অভিযোগে গত এক বছরে (জুন-২০২১ থেকে জুলাই-২০২২) ৪৯৯টি ফিলিং স্টেশন সিলগালা, ১ হাজার ৩০০ মামলা ও ২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করেছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। তার পরও থামছে না অপকর্ম। এদিকে পেট্রোল পাম্পে অভিযান চালালেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে এলাকাভিত্তিক খোলা দোকান। এসব দোকানে শুধু ভেজাল তেল বিক্রিই নয়, বাতাসে উড়ে যাওয়ার কথা বলে প্রকাশ্যেই প্রতি লিটার তেলে ৫০ থেকে ৭০ মিলি কম দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সরকার অকটেনের দাম ১৩০ টাকা নির্ধারণ করলেও এসব দোকানে রাখা হচ্ছে ১৪০-১৪৫ টাকা।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএসটিআইর সিনিয়র উপপরিচালক মো. রিয়াজুল হক বলেন, ‘ওজনে কারচুপি ও মানহীন তেল বিক্রি বন্ধে আমাদের অভিযান নিয়মিত চলছে। তবে এলাকাভিত্তিক খুচরা দোকানে অভিযান তেমন হয় না। সামনে এসব দোকানেও জোরেশোরে অভিযান চালানো হবে।’

সর্বশেষ খবর