বৃহস্পতিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

আলোচনা সমালোচনায় ইসি

গোলাম রাব্বানী

আলোচনা সমালোচনায় ইসি

কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন বিদায় নেয় ২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে দেশের ত্রয়োদশ সিইসি হিসেবে নিয়োগ দেন সাবেক সিনিয়র সচিব কাজী হাবিবুল আউয়ালকে। তার নেতৃত্বে গঠন করা হয় পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সংবিধানে বর্ণিত আইনের মাধ্যমে প্রথম নিয়োগ পান তারা। এর পর ২৭ ফেব্রুয়ারি শপথ নিয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে  

অফিস শুরু করে নতুন কমিশন। যাদের নেতৃত্বেই আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন পরিচালিত হবে।

২৮ ফেব্রুয়ারি ইসির দায়িত্ব গ্রহণ করেই এক সংবাদ সম্মেলনে রাজনৈতিক সমঝোতার কথা বলেন নতুন সিইসি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে দেশের রাজনৈতিক নেতাদের নিজেদের মধ্যে সমঝোতায় আসার আহ্বান জানান তিনি। সেই সঙ্গে প্রথম সংবাদ সম্মেলনে রাজনৈতিক দলগুলোকে উদ্দেশ করে সিইসি বলেছিলেন, ‘মাঠ ছেড়ে চলে এলে হবে না। মাঠে থাকবেন। কষ্ট হবে। ইউক্রেনের জেলেনস্কি পালিয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু তিনি পালাননি। তিনি রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিরোধ যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সরে এলে হবে না।’ এরপর কাজী হাবিবুল আউয়ালের বক্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ঢাকায় রুশ দূতাবাস। ঢাকায় রুশ দূতাবাস সিইসির বক্তব্যের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে ব্যাখ্যাও জানতে চেয়েছিল। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একে সিইসির ব্যক্তিগত বক্তব্য হিসেবে অভিহিত করেছে। তবে সিইসির প্রথম সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়লেও গত ১০ মাসে বর্তমান নির্বাচন কমিশন বেশি কিছু কাজের জন্য প্রশংসিত হয়েছে। বিশেষ করে সিসিক্যামেরায় গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে অনিয়ম দেখে ভোট গ্রহণ বন্ধ করে দিয়ে নির্বাচনে নতুন ইতিহাস তৈরি করেন তারা। তবে কুমিল্লা-রংপুর সিটিতে ভালো ভোট হলেও রংপুরে ইভিএম বিড়ম্বনা নিয়ে ভোটারদের মধ্যে অস্তিরতা সৃষ্টি হয়েছে। বলা চলে আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে এই নির্বাচন কমিশনের বছর শেষ হয়েছে।

নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্বগ্রহণের পরপরই ১৩ মার্চ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের মাধ্যমে সংলাপ শুরু করে প্রশংসিত হয়েছেন। পরে সেই ধারাবাহিকতায় জুলাইয়ে সর্বশেষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করে ইসি। যদিও বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল সংলাপ বর্জন করেছে। এ ছাড়া অনিয়মের কারণে গাইবান্ধা নির্বাচন বন্ধ করা, নির্বাচনী মাঠে সিসিক্যামেরা, ইভিএম ব্যবহার করে ভালো নির্বাচন উপহারও দিয়েছে এই কমিশন। এ নির্বাচন কমিশন আরপিও সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে, ভোটবন্ধের ক্ষমতা প্রিসাইডিং অফিসারের কাছে দেওয়ার প্রস্তাব করেছে তারা। যদিও এখনো তা ঝুলে আছে। সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে এবং সংসদ নির্বাচনের জন্য একটি রোডম্যাপও ঘোষণা করেছে, সেই অনুযায়ী নির্বাচনী কাজ এগিয়ে নিচ্ছেন তারা। সেই সঙ্গে বিগত কে এম নূরুল হুদা কমিশনের আমলের ভোটারবিহীন নির্বাচনের কলঙ্কের অবসান ঘটেছে। কিন্তু রংপুর সিটিতে ২০১৭ সালের তুলনায় এবার ৩২ হাজারের বেশি ভোটার বাড়লেও ভোটার উপস্থিতি সেই তুলনায় কমেছে। বিগত নির্বাচনে ৭৪.৩০ শতাংশ ভোট কাস্ট হলেও এবার ইভিএমে ভোট কাস্ট হয়েছে ৬৫.৮৮ শতাংশ। এ ছাড়া সিইসির বক্তব্য নিয়ে যেমন বিতর্ক হয়েছে, তেমনি ইভিএমে ত্রুটি ধরতে পারলে ১০ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা দিয়ে একজন নির্বাচন কমিশনার বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। আবার ইসির বৈঠকে ডিসিদের হট্টগোল নিয়েও বিব্রত পরিস্থিতিতে পড়েছিল নতুন ইসি। সব মিলে ভালো-খারাপ মিলেই নতুন ইসির বছর চলে গেল। ইসিতে ১০ মাসের দায়িত্ব পালনের বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান বলেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শপথ নেওয়ার পর থেকেই আমাদের আন্তরিক ইচ্ছা ছিল প্রতিটি নির্বাচনই অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা করা, যা আমরা সফলতার সঙ্গে নিশ্চিত করছি। আমাদের দায়িত্ব গ্রহণের পর ৫৬৫ নির্বাচনের মধ্যে ৪৮০টি ইভিএমে এবং ৮৫টি ব্যালটের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ করেছি। কোনো প্রকার সহিংসতা ও অভিযোগ ছাড়াই নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আমরা  ইভিএম ও সিসি ক্যামেরা ব্যবহারে ব্যাপক সুফল পেয়েছি। সিসি ক্যামেরায় অনিয়ম দেখে গাইবান্ধা উপনির্বাচন বন্ধ করে দিয়েছি এবং পরবর্তীতে তদন্তের মাধ্যম অনিয়মকারীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছি। আশা করছি আসন্ন সব প্রকার নির্বাচনই শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষভাবে হবে।

নির্বাচন কমিশনের কিছু কাজ নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কাজ করলে সমালোচনা হবেই এবং সেই বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনাকে গুরুত্ব দিয়ে আমরা সর্বদাই চেষ্টা করেছি আইনের মধ্যে থেকে সঠিকভাবে সব কাজ করা। আমাদের চেষ্টা থাকবে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সব দলের অংশ গ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করা।

বিগত ১০ মাসের দায়িত্ব পালনে কোনো অতৃপ্তি আছে কি না এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করছি এতে তৃপ্তি বা অতৃপ্তির বিশ্লেষণ করার চেয়ে সুকর্মের মাধ্যমে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জনকে গুরুত্ব দিয়েছি। আমরা সবসময় চেষ্টা করব ভালো কিছু করার এবং ভালো নির্বাচন উপহার দেওয়ার। আমি প্রতিশ্রুতি দিতে চাই যে আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাব ইনশা আল্লাহ যাতে সম্মানিত ভোটারদের কাক্সিক্ষত প্রত্যাশা পূরণ ও আস্থা অর্জন করতে পারি।

এদিকে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নেওয়ার পর সংলাপের সূচনা করলেও প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক করে ৫ এপ্রিল। ওই বৈঠকে তারা কুমিল্লা সিটি নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৬ মের মধ্যে এ নির্বাচন করার আইনিবাধ্যবাধকতা থাকলেও পরে ১৫ জুন সেই নির্বাচন করে ইসি। কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে স্থানীয় এক সংসদ সদস্যকে চিঠি দেওয়া ও এলাকা ছাড়ার নির্দেশনা নিয়ে নানা সমালোচনার মুখে পড়ে ইসি। ইসি প্রথমে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দিলেও পরে সিইসি বলেন- তিনি (এমপি) নির্বাচন কমিশনের কোনো নির্দেশ ভঙ্গ করেননি। আর তাকে ইসিও কোনো নির্দেশ দেয়নি। অবশ্য নির্বাচন সুষ্ঠু হলেও কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার শেষ মুহূর্তের একটি ফোনকল নিয়ে নানা বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। আবার কয়েকটি গণমাধ্যমে একটি ফোনকলে ফলাফল বদলে যাওয়ার খবরও প্রকাশিত হয়। যদিও পরে নির্বাচন কমিশন কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের চার দিন পর ‘নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তি’ এড়াতে ব্যাখ্যা দিয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর