রবিবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

ছিনতাই হওয়া দুই জঙ্গির হদিস নেই দুই মাসেও

সাখাওয়াত কাওসার

প্রায় দুই মাস পেরিয়ে গেছে, তবুও গ্রেফতার হয়নি ঢাকার নিম্ন আদালত থেকে পালিয়ে যাওয়া দুই জঙ্গি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের ভাষ্য অনুযায়ী, তারা নজরদারিতেই আছে। কিন্তু বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন নেই। একদিকে ছিনতাই হওয়া জঙ্গিরা গ্রেফতার না হওয়া, অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের গহিন অরণ্যে জঙ্গিদের সংগঠিত হওয়া নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে রাষ্ট্রের সবগুলো সংস্থা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাহাড়ে সংগঠিত হওয়া জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া জঙ্গিদের হাতে রয়েছে ভারী আগ্নেয়াস্ত্র। সম্প্রতি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির একটি ক্যাম্প থেকে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা হয়েছে তিনটি দেশি পিস্তল, ছয়টি একনলা বন্দুকসহ ১৫০ রাউন্ড গুলি।

ছিনতাই হওয়া দুই জঙ্গি গ্রেফতারের অগ্রগতি সম্পর্কে গতকাল সন্ধ্যায় জানতে চাওয়া হয় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকের কাছে। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে এখনো বলার মতো কোনো অগ্রগতি নেই।

যদিও কয়েকদিন আগে তিনি বলেছিলেন, জঙ্গি ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। পলাতক জঙ্গিদের নজরদারিতে রাখার পাশাপাশি জঙ্গি ছিনতাইয়ে যারা জড়িত, তাদের অনেককে শনাক্ত করা হয়েছে। আশা করছি অতি দ্রুতই তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হবে।

জানা গেছে, গত ৫৪ দিনে একাধিক বিশেষ অভিযান চালানোর পরও ছিনতাই হওয়া মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ও মোজাম্মেল হোসেনের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেনি গোয়েন্দরা। তারা দেশেই আত্মগোপন করেছে, নাকি সীমান্ত দিয়ে অন্য দেশে পালিয়ে গেছে- সে বিষয়েও কোনো তথ্য নেই। পালিয়ে যাওয়া দুই জঙ্গি প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন ও ব্লগার অভিজিত রায় হত্যা মামলার মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি। তবে দুই জঙ্গিকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করার অভিযোগে ওমর ফারুক নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে বলে দাবি করেছেন সিটিটিসি কর্মকর্তারা। 

বহুল আলোচিত দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনার তদন্তে সাবেক রেলমন্ত্রী  প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সাবেক এপিএস ওমর ফারুক তালুকদার ও তার স্ত্রী তানজিলার নাম আসায় তাদের গত ২০ ডিসেম্বর গ্রেফতার করে সিটিটিসি। ওমর ফারুক পালিয়ে যাওয়া জঙ্গি আবু সিদ্দিক সোহেলের বোন তানজিলার স্বামী। দুর্নীতির মামলায় ২০১২ সালে ওমর ফারুক যখন কারাগারে ছিলেন, তখন তিনি জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। কারাগারে আবু সিদ্দিকের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে। কারাগার থেকে বের হওয়ার পর ওমর ফারুক আবু সিদ্দিকের বোনকে বিয়ে করেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ঘটনার মাস্টারমাইন্ড বা প্রধান পরিকল্পনাকারী সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়া। নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের প্রতিটি অপারেশন বা কার্যক্রমই শুরা বোর্ড এবং জিয়ার কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হয়। তবে আদালত এলাকা থেকে সরাসরি জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার মিশনে নেতৃত্ব দিয়েছেন আইমান নামে আনসার আল ইসলামের এক নেতা। তার আসল নাম মশিউর রহমান। গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে। তিনি ২০১৬ সালে সরকারি কর্মকমিশনের রংপুর অঞ্চলের সহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় জঙ্গিবাদে জড়িয়ে ঘর ছাড়েন। বর্তমানে তিনি আনসার আল ইসলামের আসকারি বা সামরিক শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

পাহাড়ে সংগঠিত হচ্ছে জামাতুল আনসার : জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া তৎপরতা নিয়ে কাজ করছেন এমন কর্মকর্তারা বলছেন, গত ডিসেম্বরে পাহাড়ের জঙ্গি ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসা সাইফুল ইসলাম তুহিন ও নাঈম নামে দুই তরুণকে গ্রেফতারের পর অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দারা বলছেন, ক্যাম্পে জঙ্গিদের কাছে তিন থেকে চারটি একে-৪৭, চারটি একে-২২ রাইফেল, ১০টি পাইপগান, ৬০০ রাউন্ড বুলেট, ১ হাজার ৩০০টি কার্তুজ, ১৫টির মতো হাতে তৈরি গ্রেনেড রয়েছে। তারা পাহাড়ের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের কাছ থেকে আরও অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, শুরুর দিকে ডা. আহমেদ নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী সংগঠনের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করত জামাতুল আনসার। কয়েক মাস আগে জঙ্গি ক্যাম্পের আশ্রয়দাতা কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সঙ্গে স্থানীয় সন্ত্রাসী সংগঠন জেএসএসের গোলাগুলিতে ডা. আহমেদ মারা যান। এরপর তারা কবীর নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করেন। সম্প্রতি বান্দরবন থেকে অস্ত্র ব্যবসায়ী কবীরকে গ্রেফতার করার পর জামাতুল আনসারের অস্ত্র সংগ্রহের বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায় সিটিটিসি। পরে জামাতুল আনসারের দুই সক্রিয় সদস্য ইয়াসিন ও আবদুর রহমানকেও গ্রেফতার করে তারা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জামাতুল আনসারের প্রধান উপদেষ্টা শামীন মাহফুজ একে-৪৭-সহ অত্যাধুনিক অস্ত্র সংগ্রহের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি পাহাড়ি এলাকায় আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন আল-কায়েদার প্রয়াত নেতা ওসামা বিন লাদেনের মতো করে চলাফেরা করেন। একে-৪৭ অস্ত্রগুলো ভারতের মিজোরাম থেকে কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের শীর্ষ নেতা নাথান বমের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রায় ১০ লাখ টাকা দিয়ে তিনটি একে-৪৭ সংগ্রহ করেছে। একে-২২-গুলোও পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে সংগ্রহ করা। দেশীয় পাইপগান সংগ্রহ করা হয়েছে মহেশখালী থেকে। আর স্থানীয় সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর কাছ থেকে ছোট অস্ত্রগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে।

সূত্র আরও বলছে, জামাতুল আনসারের নিজস্ব বোমা তৈরির কারিগর রয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বোমা তৈরির উপাদান সংগ্রহ করে কৌশলে তা পাহাড়ি জঙ্গি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বোমা তৈরির পাশাপাশি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অংশ নেওয়া তরুণদেরও হাতে-কলমে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সিটিটিসির প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার উপদেষ্টা শামীন মাহফুজকে ধরতে পারলেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যাবে। এ জঙ্গি সংগঠন কিছু অস্ত্র সংগ্রহ করেছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। প্রশিক্ষণের সময় ডামি অস্ত্র ব্যবহার করলেও মাঝে-মধ্যেই আসল অস্ত্র দিয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।

সর্বশেষ খবর