শরীরের তীব্র যন্ত্রণায় দাঁতে দাঁত চেপে চিৎকার সামলাচ্ছিলেন ঢাকা কলেজের দর্শন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আবদুল্লাহ আল ইমরান। গত ১৯ জুলাই রাজধানীর কদমতলী এলাকায় বাম পায়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। ২০ জুলাই জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) ভর্তি হওয়ার পর থেকে গতকাল পর্যন্ত নয়বার অপারেশন হয়েছে ইমরানের পায়ে।
পঙ্গু হাসপাতালের কেবিন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ইমরানের পাশে আছেন মামা শান্ত আহমেদ। বাবা আরিফ সরকার গিয়েছিলেন রক্ত পরীক্ষার স্লিপ নিয়ে আসতে। নার্স রক্ত পরীক্ষার জন্য হাতের শিরা খুঁজতে গেলেই ব্যথায় চিৎকার করে ওঠেন ইমরান। বারবার বলতে থাকেন, ‘ম্যাম আপনি রক্ত নেন, আমার হাতে না, পায়ে ভীষণ ব্যথা। দেখেন তো আমার পা ঠিকভাবে রাখা আছে নাকি?’ শান্ত আহমেদ বলেন, ‘গতকাল সারারাত ব্যথায় চিৎকার করেছে ইমরান। দুই চোখের পাতা এক করেনি। ওর পায়ে ৬ ইঞ্চি বুলেট ঢুকে বিস্ফোরিত হয়ে যাওয়ায় হাঁটুর নিচ থেকে গোড়ালি পর্যন্ত হাড় গুঁড়ো হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত নয়বার ওর পায়ে অপারেশন করেছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু নিচে ওয়ার্ডে থাকাকালীন ক্ষতস্থানে ইনফেকশন হয়েছে। এখনো তিনটা আঙুল নাড়াতে পারায় চিকিৎসকরা চেষ্টা করছেন পা যেন কাটতে না হয়।
পরিবারের বিষয়ে জানতে চাইলে শান্ত বলেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে নিজের এলাকাতেই সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালান ইমরানের বাবা আরিফ সরকার। তিন ভাই বোনের মধ্যে ইমরানই বড়। পুরো সুস্থ হয়ে উঠলেও অনেক সময় লাগবে বলে আমাদের জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।’
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে ১৫ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত ৬৩৭ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। এদের মধ্যে ৩৮৬ জন গুলিবিদ্ধ।
জুলাইয়ের শুরুতে আহত হয়েছেন এমন রোগীও চিকিৎসাধীন রয়েছেন এ হাসপাতালে। এই সহিংসতায় আহত হয়ে পঙ্গু হাসপাতালে (নিটোর) ভর্তি রোগীদের সহায়তা করছেন শিক্ষার্থীরা। নিটোর হাসপাতালের সমন্বয়ক নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুহানা ইসলাম বলেন, বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১২২ জন। প্রতিদিনই কেউ ছাড়া পাচ্ছেন, আবার ঢাকার বাইরে থেকে নতুন রোগীও আসছে। আমরা রোগীর স্বজনদের তথ্য এবং কোনো ওষুধ কিনতে হলে বা টেস্ট করাতে হলে সে খরচ দেওয়ার চেষ্টা করছি। কিছু হৃদয়বান মানুষ আহতদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আর্থিক সহযোগিতা করছেন। আরও অনেকের সহযোগিতা পেলে এ রোগীদের সেবা নিশ্চিত করা সহজ হবে।’ বরিশালের দুর্গাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে তামিম (১৪)। দুই ভাই বোনের মধ্যে সে বড়। বাবা নেই, মা তানিয়া বেগম গার্মেন্টে চাকরি করে সংসার চালান। নানার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল তামিম। গত ৫ জুলাই মিরপুর-২ এলাকায় সংঘর্ষে গুলি লাগে তামিমের ডান পায়ে। পঙ্গু হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি-২ ওয়ার্ডে বিছানায় হেলান দিয়ে বসেছিল তামিম। বালিশের ওপরে রাখা ব্যান্ডেজ জড়ানো পা। তামিমের মামা তানভীর আহমেদ বলেন, পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হলে তামিমের পায়ে অপারেশন করা হয়। কিন্তু সে সময় রোগীদের ঠিকমতো ড্রেসিং করানো হতো না। নার্সদের ডেকে আনা যেত না। এভাবে চলতে থাকায় ইনফেকশন হয়ে যায় তামিমের পায়ে। গতকাল অপারেশন করে কেটে ফেলতে হয়েছে তার ডান পা। এই দৌড়ে বেড়ানোর বয়সে ছেলেটা পঙ্গু হয়ে গেল। ওর মা সারা দিন কান্নাকাটি করছেন। ওর ভবিষ্যৎ কী হবে? একই ওয়ার্ডে তামিমের এক বেড পরেই ভর্তি রয়েছেন আতিকুল ইসলাম (১৯)। উত্তরার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সেলসম্যান হিসেবে কাজ করতেন তিনি। বিছানায় কম্বল মুড়িয়ে বসে ছিলেন আতিকুল। কম্বল সরে গেলেই দেখা যায়, কাঁধের নিচ থেকে ডান হাত পুরোটা কাটা পড়েছে তার। আতিকুল বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ সহিংসতার শুরুর দিকে ৫ জুলাই বিকাল চারটায় উত্তরা আজমপুরে গুলিতে আহত হই আমি। ওখান থেকে আমাকে এই হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। জানে বেঁচে গেলেও হাতটা কাটা পড়েছে। এখন হয়তো আমি আর সাইকেল চালিয়ে সেলসম্যানের কাজ করতে পারব না, কিন্তু এই এক হাতেই গর্বের সঙ্গে জাতীয় পতাকা তো তুলে ধরতে পারব।’ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের শিক্ষার্থী তামান্না ইসলাম তন্বীসহ প্রায় ১৫ জন শিক্ষার্থী সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পঙ্গু হাসপাতালে আহতদের সহায়তায় কাজ করে চলেছেন। তন্বী বলেন, ‘এই হাসপাতালে আহত রোগীদের বেশির ভাগেরই ইনফেকশনের কারণে হাত-পা কাটা পড়ছে। এ বিষয়ে নজর না দিলে আরও অনেকের অঙ্গহানি হয়ে যাবে। এসব রোগীর অপারেশনের জন্য প্রচুর রক্তের প্রয়োজন পড়ছে। এ মুমূর্ষু রোগীদের জন্য গ্রুপ মিলিয়ে রক্ত জোগাড় করা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।’