বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) নীতিমালা অনুযায়ী মোটরযানের ফিটনেস সনদ প্রদানে ইঞ্জিন, রং, বডির কন্ডিশন, ধোঁয়া, হেডলাইট ও বিভিন্ন ধরনের সিগন্যাল লাইটসহ ৬১টি বিষয় দেখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে বাস্তবে চিত্র ভিন্ন। শুধু বিআরটিএর ঢাকা মেট্রো সার্কেল-১ (মিরপুর) কার্যালয় ছাড়া দেশের কোথাও যথাযথ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যানবাহন পরীক্ষার সক্ষমতা নেই সংস্থাটির। সঠিক পদ্ধতিতে একটি গাড়ি পরীক্ষায় অন্তত ১৫ থেকে ২০ মিনিট লাগার কথা থাকলেও প্রতি মিনিটে তিন থেকে চারটি যানবাহনের পর্যবেক্ষণ সমাপ্ত করেন মোটরযান পরিদর্শকরা। অন্যদিকে রাজধানী ঢাকায় গণপরিবহন হিসেবে সেবা দেওয়া অধিকাংশ বাসই মেয়াদোত্তীর্ণ। ফিটনেস সনদ না থাকলেও ট্রাফিক পুলিশের কেইস স্লিপ (মামলার স্লিপ) দিয়ে অবাধে চলাচল করছে এসব বাস। বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে মোটরযানের ফিটনেস নিয়ে এমন দুরবস্থাই উঠে এসেছে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব বিআরটিএর। কিন্তু তারা উদাসীন ভূমিকা পালন করেন। যে প্রক্রিয়ায় ফিটনেস সনদ দেওয়া হয় এটি সঠিক পদ্ধতি নয়। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পরীক্ষা ছাড়া মোটরযানের ফিটনেস সনদ দেওয়ায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। আজ ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। দেশে অষ্টমবারের মতো দিবসটি পালিত হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘ছাত্র-জনতার অঙ্গীকার, নিরাপদ সড়ক হোক সবার’। দিবসটি উপলক্ষে বিআরটিএ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। প্রধান অতিথি থাকবেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। বিশেষ অতিথি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন।
সরেজমিন বিআরটিএ : গত ১৭ অক্টোবর বিআরটিএর ঢাকা মেট্রো সার্কেল-৪ (পূর্বাচল) কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, কার্যালয়টির সামনের সড়কে সারিবদ্ধভাবে রাখা আছে ফিটনেস সনদ নিতে আসা যানবাহন। সড়কের এক পাশ থেকে এসব গাড়ি দেখছেন মোটরযান পরিদর্শক নজরুল ইসলাম। তার সঙ্গে আরেকজন সহায়ক কর্মচারী আরএফআইডি স্ক্যানার দিয়ে যানবাহনের নম্বর যাচাই করছেন। তিনি যানবাহনের সঙ্গে থাকা কাগজপত্রে চোখ বুলিয়েই ছেড়ে দিচ্ছেন। ওই সময় গাড়ির বডি, ইঞ্জিন, হেডলাইট, ধোঁয়া বা অন্য কোনো বিষয় পর্যবেক্ষণ করতে দেখা যায়নি তাকে। এক মিনিটে তিনি চারটি যানবাহনের ফিটনেস পর্যবেক্ষণ শেষ করেন।
এ বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে বলেন, ইঞ্জিন পরীক্ষা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সে পরিমাণ মেশিনারিজ নেই। শুধু বিআরটিএ মিরপুর সার্কেলে ডিজিটাল মেশিন রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিআরটিএর উপপরিচালক (ইঞ্জি-২) মো. ফারুক আহমেদ বলেন, বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখব। ফিটনেস পরীক্ষায় ৬১টি বিষয় যাচাই-বাছাই করতে হয়। তবে আমাদেরও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। নিজস্ব ভবন নেই। এ ছাড়া জনবল সংকট ও ডিজিটাল মেশিনারিজের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এগুলো দূর করা গেলে বিআরটিএ আরও এগিয়ে যাবে।
সেন্সর নষ্ট একমাত্র ভিআইসিতে : দেশের একমাত্র ডিজিটাল মোটরযান পরিদর্শন কেন্দ্র রয়েছে বিআরটিএর মিরপুর কার্যালয়ে। তবে এখানে অনেক সেন্সর নষ্ট থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছর ১৮ অক্টোবর উদ্বোধন হয় বেহিকেল ইন্সপেকশন সেন্টার (ভিআইসি)। এই সেন্টারের বেশকিছু সেন্সর নষ্ট।
ঢাকার বাইরের চিত্র ভয়াবহ : ঢাকার চার বিআরটিএ কার্যালয়ে ফিটনেস সনদ প্রদানে অন্তত আরএফআইডি স্ক্যানার দিয়ে আরএফআইডি ট্যাগ স্ক্যান করে যানবাহনের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়। তবে ঢাকার বাইরের চিত্র ভয়াবহ। গত ২১ আগস্ট ঢাকা মেট্রো-ট-১৪-৭৮৫৮ রেজিস্ট্রেশন নম্বরযুক্ত ট্রাকের ফিটনেস সনদ দেয় বিআরটিএর ব্রাহ্মণবাড়িয়া কার্যালয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, যেদিন ফিটনেস সনদ দেওয়া হয়, সেদিন ওই ট্রাক বিআরটিএর ব্রাহ্মণবাড়িয়া কার্যালয়ে উপস্থিত হয়নি। গাড়িটি গত ৭ জুলাই থেকে ২১ আগস্টের পর পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিয়াবাজার হাইওয়ে থানায় আটক ছিল। গাড়িটি পরিদর্শন না করেই ওই ট্রাকের ফিটনেস সনদ দেওয়া হয়। বিআরটিএর সদর কার্যালয়ের তথ্য বলছে, ২১ আগস্ট ৬০টি মোটরযানের ফিটনেস সনদ দেওয়া হয়। ৩০টি প্রাইভেট গাড়ি আর ৩০টি বাণিজ্যিক যানবাহন। তবে ঢাকা মহানগরীতে রেজিস্ট্রেশন পাওয়া ৪০-এর অধিক গাড়ি বিআরটিএর এই সার্কেলে কীভাবে গেল সে প্রশ্ন বিআরটিএ সংশ্লিষ্টদের।
কেস স্লিপ দিয়ে চলে অবৈধ যানবাহন : গত ১৪ অক্টোবর নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে রাজধানীর বাড্ডা এলাকায়। ওইদিন সিটি সার্ভিস হিসেবে চলা অন্তত ২০টি বাস আটক করে শিক্ষার্থীরা। সেদিন ট্রাফিক পুলিশের সহায়তায় গাড়ির কাগজপত্র যাচাই করে তারা। অন্তত ১০টি বাস পাওয়া যায়, যেগুলোর ফিটনেস সনদ নেই। এসব বাসের অধিকাংশ চালক দেখান মামলার সনদ। তারা বলেন, ফিটনেস সনদ মামলায় জব্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি গাড়ির নম্বর বিআরটিএতে যাচাই করে জানা যায়, সেগুলোর ফিটনেস সনদ নেই। এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিআরটিএর এক কর্মকর্তা বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির ফিটনেস সনদ দেয় না বিআরটিএ। গাড়ির মালিকরা পুলিশের সঙ্গে মাসিক চুক্তি করে বাসগুলো রাস্তায় চালান। পুলিশ টাকার বিনিময়ে কেস স্লিপ দিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে কেস স্লিপগুলো জব্দ করে পুনরায় কেস স্লিপ দেয়।
বিআরটিএ তথ্যমতে, ১৯ অক্টোবর ২০২৪ তারিখ পর্যন্ত ফিটনেসবিহীন মোটরযানের মোট যানবাহনের সংখ্যা ৪ লাখ ৪৪ হাজার ৬৯৩টি। এর মধ্যে বাসের সংখ্যা ২৪ হাজার ২৬টি, মিনিবাস ১১ হাজার ৭৮৮টি, ট্রাক ৬৬ হাজার ২৬টি, কার্গো ভ্যান ২ হাজার ২৩৪টি, কাভার্ডভ্যান ১০ হাজার ৯১২টি, হিউম্যান হলার ১৪ হাজার ৫৫০টি, পিকআপ ৮২ হাজার ৮০৫টি, স্পেশাল পারপাস ভেহিক্যাল ৬ হাজার ১১৮টি, ট্যাঙ্কার ২ হাজার ৩৬৮টি, প্রাইভেট কার ৭৬ হাজার ৫৮টি, জিপ ১৬ হাজার ১৫৩টি ও মাইক্রোবাস ৩২ হাজার ১৫৬টি।
যা বললেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ : পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গত সরকার টাকার বিনিময়ে চালক ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি সড়কে যেভাবে নামিয়েছে এটা খুব ন্যক্কারজনক। এ অবৈধ চালকরা রাস্তায় অনেক দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। এগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিল বিআরটিএর একদল দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। যানবাহনের যোগ্যতা যাচাইয়ে ৬১টি বিষয় যাচাই-বাছাই করতে হয়। বডি দেখে ছেড়ে দেওয়া বড় ধরনের অনিয়ম। তিনি আরও বলেন, বিআরটিএ যদি বলে জনবলের সংকট তাহলে এটার দায়িত্ব কেন নিল? ২০১১ সালে আউট সোর্সিংয়ে যাওয়ার কথা ছিল, ওই সময় বিআরটিএ দেয়নি। বিআরটিএ যোগ্যতার প্রমাণ দিতে চাইলে লাইসেন্স পরীক্ষা ও ফিটনেস পরীক্ষার স্থানে সিসি টিভি লাগাক। তিনি বলেন- বর্তমান পরিস্থিতে এসব সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু উপদেষ্টার ওপর বেশি চাপ থাকায় তারা ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না। কিন্তু পরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে এখনই উপযুক্ত সময়।