জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে। গতকাল দুই সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ প্রসিকিউশনের ৫৪তম সাক্ষী হিসেবে নিজের জবানবন্দি দেওয়া শুরু করেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আলমগীর। জবানবন্দির শুরুতেই ১৭টি ভিডিও প্রদর্শন করেন তিনি। এসব ভিডিওতে জুলাই-আগস্টের ওই সময়ে পুলিশের চালানো নানা নৃশংসতার চিত্র উঠে এসেছে। তদন্ত চলাকালে বিভিন্ন হাসপাতাল ও আহত ব্যক্তির কাছ থেকে সংগ্রহ করা ৮৪টি বুলেট ও পিলেট জব্দ করার তথ্যও তদন্ত কর্মকর্তা দিয়েছেন প্রথম দিনের জবানবন্দিতে। তার জবানবন্দির ভিডিও প্রদর্শন অংশ চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজের পাশাপাশি বিটিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে। তার অসমাপ্ত সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আজ পুনরায় দিন ধার্য রেখেছেন ট্রাইব্যুনাল।
শেখ হাসিনা ছাড়াও এ মামলার অন্য দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এর মধ্যে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন দোষ স্বীকার করে এ মামলায় রাজসাক্ষী হয়ে জবানবন্দি দিয়েছেন। গতকালও তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। এ সময় প্রসিকিউশনের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম, গাজী এম এইচ তামীম, বি এম সুলতান মাহমুদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ান প্রমুখ। পলাতক দুই আসামির পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রয়াত লেখক, চিন্তাবিদ ও গবেষক বদরুদ্দীন উমরের দেওয়া জবানবন্দি সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল। প্রসিকিউশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দেন। গতকাল সাক্ষ্য গ্রহণ শুরুর আগে প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামীম ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশে বলেন, কোনো সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দি দেওয়ার পর যদি মারা যান, তার সেই জবানবন্দি সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণের সুযোগ ট্রাইব্যুনাল আইনে রয়েছে। পরে ট্রাইব্যুনাল আদেশ দেন।
অন্যদিকে জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনুর পক্ষে দাঁড়াবেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না। গতকাল ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে তিনি এ তথ্য জানান। যাওয়ার পথে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বলেন, হত্যাযজ্ঞে (জুলাইয়ের) কেউ যদি অপরাধী হয়, অবশ্যই পানিশমেন্ট হওয়া উচিত। যে কোনো হত্যায়, একটাও যদি হয়, সেটায় যে অপরাধী, তার পানিশমেন্ট হবে। কিন্তু প্রমাণ করতে হবে। গায়ের জোরে নয়। সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার তো কোনো গ্যারান্টি নাই যে, এখান থেকে আমি সেইফলি বাসায় যেতে পারব। বাসায় ঘুমাইতে পারব এই গ্যারান্টিটা নাই। রাষ্ট্র তো সঠিকভাবে না, বেঠিকভাবে চলতেসে। উল্টাভাবে চলতেসে।
ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শিত ১৭ ভিডিওতে যা দেখা গেল : প্রথম ভিডিওতে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের ওপর সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। এই প্রামাণ্যচিত্রে অভ্যুত্থানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের গুলি, নির্যাতন, নিহত আন্দোলনকারীদের পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎকার প্রদর্শন করা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শিত দ্বিতীয় ভিডিওটি ছিল গত বছর ১৪ জুলাই গণভবনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনের। ওই ভিডিওতে আন্দোলনকারীদের রাজাকার আখ্যায়িত করা হয়েছে বলে দাবি করে প্রসিকিউশন। এ সময় প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামীম বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পরই শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তৃতীয় ভিডিওটি ১৪ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিলের। প্রদর্শিত চতুর্থ ভিডিওটি প্রথম আলোর একটি ভিডিও প্রতিবেদন। গত বছর ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনার ওপর প্রতিবেদনটি করা হয়েছে। পঞ্চম ভিডিওটি রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে পুলিশের গুলি করার দৃশ্যের। এই ভিডিওতে আবু সাঈদের গায়ে গুলি লাগার পর কয়েকজন আন্দোলনকারী তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখা যায়। ষষ্ঠ ভিডিওতে র্যাবের হেলিকপ্টার থেকে গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার শেল নিক্ষেপের দৃশ্য দেখানো হয়েছে বলে দাবি করে প্রসিকিউশন। এ সময় আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন বিরোধিতা করে বলেন, ভিডিওতে গুলি করতে দেখা যাচ্ছে, এমন কিছুই দৃশ্যমান নয়। এ পর্যায়ে ভিডিওটি পুনরায় চালু করে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করার দৃশ্য দেখানো হয়।
ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শন করা সপ্তম ভিডিওতে দেখা যায়, যাত্রাবাড়ী থানার সামনে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা একটি ভিডিও দেখাচ্ছেন, যেখানে একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন, ‘একটা গুলি করি, একজন মরে, একজনই যায়, অন্যরা যায় না স্যার’। প্রদর্শিত অষ্টম ভিডিওটি যাত্রাবাড়ী এলাকায় একটি শিশুকে পুলিশের নির্যাতন ও অন্য এক আন্দোলনকারীকে গুলি করার দৃশ্যের। প্রদর্শিত নবম ভিডিওটি যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশের গুলিতে মুখমণ্ডল বিকৃত হয়ে যাওয়া খোকন চন্দ্র বর্মণের। ভিডিওতে দেখা যায়, মুখমণ্ডল বিকৃত রক্তাক্ত খোকন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন ও অন্যদের সাহায্য চাইছেন। এই ভিডিও দেখিয়ে প্রসিকিউটর তামীম বলেন, এই খোকন চন্দ্র বর্মণ এই মামলায় প্রসিকিউশনের এক নম্বর সাক্ষী হিসেবে ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দিয়েছেন।
ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শিত দশম ভিডিওতে সাভারে পুলিশের এপিসি থেকে গুলিবিদ্ধ শিক্ষার্থী ইয়ামিনকে ফেলে দেওয়ার দৃশ্য দেখানো হয়।
প্রদর্শিত ১১তম ভিডিওতে আশুলিয়া থানার সামনে পুলিশের পিকআপ ভ্যানে ৬ জন আন্দোলনকারীর লাশ পোড়ানোর দৃশ্যের। এ ভিডিও দেখিয়ে প্রসিকিউটর তামীম ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশে বলেন, এই ৬ জনের মধ্যে একজন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় জীবিত ছিল, তাকে জীবিত অবস্থায় পোড়ানো হয়েছে। এমনভাবে আগুন লাগানো হয়েছে, যেন বোঝা যায় আন্দোলনকারীরাই এই আগুন দিয়েছে। তিনি বলেন, এখানে যেসব পুলিশ সদস্য ছিলেন, তারা এতটাই নৃশংস ও বর্বর ছিলেন, এই মানুষ পোড়ানের আগুনে কাঠ দিয়েছেন জ¦ালানি হিসেবে। আরেকজন হাতে থাকা সিগারেট ছুড়ে দেন আগুনের দিকে।
ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শিত ১২তম ভিডিওতে রাজধানীর চানখাঁরপুলে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের গুলি চালানোর দৃশ্য দেখানো হয়। এই ভিডিওতে দেখা যায়, ডিএমপির পুলিশ ও এপিবিএনের কয়েকজন সদস্য হাঁটু গেড়ে বসে-শুয়ে, যুদ্ধরত স্টাইলে চাইনিজ রাইফেল ও শটগান দিয়ে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি করছে। এ ভিডিও দেখিয়ে প্রসিকিউটর তামীম বলেন, গত বছর ৫ আগস্টের দৃশ্য এটি। সেদিন এখানে ৬ জন আন্দোলনকারী পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন।
প্রদর্শিত ১৩তম ভিডিওতে রাজধানীর রামপুরায় একটি নির্মাণাধীন ভবনের কার্নিশে ঝুলে থাকা এক ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে পুলিশের দুই সদস্যকে গুলি করতে দেখা যায়। এই ভিডিও দেখিয়ে প্রসিকিউটর তামীম বলেন, এখানে যাকে গুলি করা হয়েছে, তার নাম আমির হোসেন। ৮টি গুলি লাগার পরও তিনি জীবিত আছেন। রামপুরার সংশ্লিষ্ট মামলায় প্রসিকিউশনের সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেবেন। ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শিত ১৪তম ভিডিওতে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় পুলিশের গুলির দৃশ্য দেখানো হয়। প্রসিকিউশন জানায়, এখানে পুলিশের গুলিতে গোলাম নাফিস নামে একজন আন্দোলনকারী নিহত হয়েছেন।
প্রদর্শিত ১৫তম ভিডিওতে আগুনে পোড়া একটি ভবন পরিদর্শনে গিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া বক্তব্য দেখানো হয়। ১৬তম ভিডিওতে জাতীয় শুদ্ধাচার পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার বক্তব্য নিয়ে এটিএন নিউজের একটি প্রতিবেদন দেখানো হয়।
গতকাল প্রদর্শিত শেষ অর্থাৎ ১৭তম ভিডিওটি একটি বিদেশি সংস্থার বিশ্লেষণধর্মী প্রামাণ্যচিত্র। ১৪ মিনিটের বেশি এই ভিডিওতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার গত বছর ৫ আগস্ট দিনব্যাপী সংঘটিত নানা ঘটনার দৃশ্য দেখানো হয়। এই ভিডিওতে নির্বিচারে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশকে গুলি করতে দেখা যায়। ভিডিওর একটি অংশে যাত্রাবাড়ী এলাকার একটি গলিতে গুলিবিদ্ধ ও রক্তাক্ত অবস্থায় বেশ কিছু মানুষকে পড়ে থাকতে দেখা যায়। এই ভিডিওর বিষয়ে প্রসিকিউটর তামীম বলেন, চার শতাধিক ভিডিও বিশ্লেষণ করে সময়ের ধারাবাহিকতা অনুযায়ী ফরেনসিক বিশ্লেষণধর্মী এই প্রামাণ্যচিত্রটি তৈরি করেছে ওই বিদেশি সংস্থাটি। ভিডিও প্রদর্শন শেষে বিরতিতে যান ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে সরাসরি সম্প্রচারও সমাপ্ত করা হয়।
দিলেন জব্দ করা ৮৪ বুলেট-পিলেটের তথ্য : বিরতির পর নিজের পরিচয় তুলে ধরে জবানবন্দি শুরু করে তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর বলেন, গত বছরের ২৯ অক্টোবর থেকে আমি এই মামলার তদন্তভার গ্রহণ করি। এরপর পূর্ববর্তী তদন্ত কর্মকর্তার সম্পাদিত ও প্রস্তুতকৃত সিডি পর্যালোচনা করি। তদন্তকালে তদন্ত সংস্থায় সংরক্ষিত বিভন্ন তথ্য-উপাত্ত, পত্রিকার রিপোর্ট এবং ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করি। আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে গ্রেপ্তারের জন্য ট্রাইব্যুনালে আবেদন করি। তিনি বলেন, তদন্তভার গ্রহণের পর থেকেই ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে প্রকাশিত ও প্রচারিত বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্ট, ইলেকট্র্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার খবরসহ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে, তা সংগ্রহ করি। ঘটনা চলাকালীন ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে আদেশ-নির্দেশ ও উসকানিমূলক বিবৃতি লেখা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত পোস্ট ও মন্তব্য সংগ্রহ করেছি।
জবানবন্দিতে তদন্ত কর্মকর্তা বিভিন্ন হাসপাতাল ও একজন আহত ব্যক্তির কাছ থেকে ৮৪টি বুলেট ও পিলেট জব্দ করার বর্ণনা দেন। ইনুর পক্ষে লড়বেন জেড আই খান পান্না : জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর পক্ষে দাঁড়াবেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না। এর জন্য গতকাল তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ গিয়েছিলেন। এদিন এই ট্রাইব্যুনালে মামলাটির ‘আনুষ্ঠানিক অভিযোগ’ দাখিলের দিন ধার্য ছিল। কর্যতালিকা অনুসারে বিষয়টি শুনানিতে উঠলে প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম ট্রাইব্যুনালকে জানান, গত ২৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ ইনুর বিরুদ্ধে মামলার ‘আনুষ্ঠানিক অভিযোগ’ দাখিল করা হয়েছে। আগামীকাল (আজ) এ মামলার বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য আছে। তখন ট্রাইব্যুনাল মামলাটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দেন।