জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র কয়েক মাস বাকি। এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবের চেয়ারে বসতে চাচ্ছেন না কেউ। জনপ্রশাসনের সচিবের চেয়ার ১৫ দিনের বেশি সময় ফাঁকা রয়েছে যা দেশের ইতিহাসে রেকর্ড। এর আগে এই চেয়ারটি এত লম্বা সময় কখনোই ফাঁকা ছিল না। রুটিন দায়িত্বে চলছে কার্যক্রম। পূর্ণ সচিবের পদ শূন্য থাকায় প্রশাসনিক কার্যক্রমে ধীরগতি দেখা দিয়েছে। কে আসছেন এই চেয়ারে তা নিয়ে কর্মকর্তাদের রুমে রুমে চলছে ফিসফিস। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মতো অতিগুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে দুই সপ্তাহ ধরে পূর্ণ সচিব না থাকা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন অনেকে। জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন দ্রুত সময়ে সচিব নিয়োগ দিতে না পারা সরকারের দূরদর্শিতার ঘাটতি। প্রশাসনের ‘শেকড়’ বলা হয় মাদার মিনিস্ট্রিখ্যাত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে। প্রশাসনে নিয়োগ পদোন্নতি বদলি এই মন্ত্রণালয় দেখে থাকে। ক্ষমতার দিক থেকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মুখ্য সচিবের পরই এই পদটিকে বিবেচনা করা হলেও এখানে সিনিয়র সচিবরা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না বলে জানা গেছে। বিভিন্ন রদবদল ঘিরে বাণিজ্য, নানা তদবির, ডিসি কেলেঙ্কারিসহ নানা কারণে এই মন্ত্রণালয়ের সুনামকে সংকটে ফেলেছেন সদ্য বিদায়ী সচিব মোখলেসুর রহমান। সে কারণে এক সময় এই চেয়ারে যাওয়ার প্রতিযোগিতা থাকলেও এবার বিতর্কিত হওয়ার ভয়ে এই চেয়ারে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন সরকারের সিনিয়র কর্মকর্তারা। প্রশাসনের বাইরেও বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে কে হবেন প্রশাসন নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়ের সচিব। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, তিনটি অন্যতম রাজনৈতিক দলও পছন্দের কর্মকর্তাকে এ পদে বসাতে নানামুখী তদবির চালিয়ে যাচ্ছে। গত ২১ সেপ্টেম্বর নানা বিতর্কের কারণে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমানকে সরিয়ে দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। ১৫ দিন পার হলেও নতুন সচিব দিতে পারেনি সরকার। রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন ১৮তম ব্যাচের কর্মকর্তা ড. আবু শাহীন মো. আসাদুজ্জামান।
প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন। মাঠ প্রশাসন সাজানো, নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বিভিন্ন চাপ সামলানোর মতো বিষয় আছে। ইতোমধ্যেই মন্ত্রণালয়ের একটা বদনাম হয়েছে নানা অনিয়ম কেলেঙ্কারির কারণে। এখন নতুন করে এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে জনপ্রশাসন সচিব হয়ে কেউ দুর্নাম কুড়াতে চাচ্ছেন না। এটি অনেকের না আসার কারণ হতে পারে বলেন কর্মকর্তারা। সরকারের একাধিক সিনিয়র সচিব ও সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, এই চেয়ারে সিনিয়র কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে সরকারের আস্থাভাজন কাউকে বসানো হয় সবসময়।
দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগকৃত সপ্তম ব্যাচের কর্মকর্তা ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এ এস এম সালেহ আহমেদ, ৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. এহছানুল হক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনি, ৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তা নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদকে এই পদে বিবেচনা করা হলেও তারা এ পদে যেতে রাজি হয়নি বলে জানা গেছে। আরও কয়েকজন সিনিয়র সচিবকে জনপ্রশাসনে আসার কথা বললেও তারা অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন। কেন এই পদে যেতে চাচ্ছেন না অনেকে- এ নিয়ে একজন দায়িত্বশীল সিনিয়র সচিব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নির্বাচন হলেই অন্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের চেয়ে জনপ্রশাসন সচিবের ওএসডি হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। এ ছাড়া অনেকের বিরাগভাজন হতে হয়, দুর্নাম এসে ভর করে- এসব কারণে এবার কেউ যেতে চাচ্ছেন না। একাধিক সূত্র জানায়, একটি রাজনৈতিক দল স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব রেজাউল মাকছুদ জাহেদী বা গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নজরুল ইসলামকে জনপ্রশাসনে দায়িত্ব দিতে দৌড়ঝাঁপ করছেন।
তবে তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অন্যান্য রাজনৈতিক দল তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে বলে গুঞ্জন রয়েছে। জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র সচিবকে জনপ্রশাসনে দিয়ে স্থানীয় সরকার বা গণপূর্ত সচিবকে স্বরাষ্ট্রে দেওয়ার চিন্তাও ছিল সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের। কিন্তু ভোটের আগে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার ঘনিষ্ঠ সচিব স্বরাষ্ট্রের মতো জায়গায় বসা নিয়ে বড় একটি দলের আপত্তি রয়েছে। ভোটের সময় প্রভাব বিস্তার করাসহ ওই চেয়ারের নিরপেক্ষতা হারাতে পারে এমন বিবেচনায় আপত্তি রাজনৈতিক দলের। নানা কারণে এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি সরকার। তবে ১১ বিসিএসের কর্মকর্তা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সচিব মো. সাইফুল্লাহ পান্নাকে বা একই ব্যাচের কর্মকর্তা যুব ও ক্রীড়া সচিব মাহবুব আলমকে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে বলেও আলোচনা রয়েছে। মাহবুব আলম এর আগে জনপ্রশাসনের প্রশাসন বিভাগে থাকায় সে হিসেবে তার অভিজ্ঞতার কথাও বিবেচনায় নিচ্ছে। সূত্র জানায়, গতকাল জনপ্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে বিভিন্ন কর্মকর্তাকে নিয়ে আলেচনা হয়েছে। গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে কোনো সামারি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠানো হয়নি বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেন। এ সপ্তাহের মধ্যেই পদটি পূরণ হবে বলেও জানায় সূত্রগুলো।