‘গত বছর ৫ আগস্ট দুপুর আড়াইটার দিকে শুনতে পাই শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। এরপর বিজয় মিছিল করি। তখন আশুলিয়া থানার দিকে গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পাই। আমরা মিছিল নিয়ে থানার সামনে আসি। গুলির শব্দ শুনে আমি এস এ পরিবহন অফিসমুখী রাস্তার দিকে যাই। আমার সামনে একজন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন, তাকে নিয়ে সামনের বাসার গেট খোলা পেয়ে ভিতরে ঢুকে যাই। সেখানে আনুমানিক এক ঘণ্টার মতো গোলাগুলির শব্দ পাই। গুলিবিদ্ধ ব্যক্তি সেখানেই মারা যান। সেখান থেকে বের হওয়ার সময় থানার সামনে পুলিশভ্যানে কয়েকটি লাশ পোড়ানো অবস্থায় দেখি।’ কথাগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন মো. শাহরিয়ার হোসেন সজীব নামে এক সাক্ষী।
গতকাল বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২-এ প্রসিকিউশনের ২২তম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন তিনি। পরে তাকে জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। জেরা শেষে পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আগামী ১২ নভেম্বর দিন ঠিক করেছেন ট্রাইব্যুনাল। এদিকে যশোরের চৌগাছায় গ্রেপ্তারের পর বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজিয়ে ছাত্রশিবিরের দুই নেতাকে গুলি করার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এসআই আকিকুল ইসলামসহ তিন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে আরও তিন মাস সময় দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ আদেশ দেন।
অন্যদিকে, জুলাই-আগস্ট আন্দোলন চলাকালীন ময়মনসিংহের গৌরীপুরে তিনজনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা তানজির আহমেদ রাজীবকে আগামী ২৭ নভেম্বর হাজিরের নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনাল-২ এ আদেশ দেন। প্রসিকিউশন জানায়, এলাকায় আওয়ামী সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত রাজীব। এরই মধ্যে অন্য মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন তিনি। তবে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট আন্দোলন ঘিরে গৌরীপুরে হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট চাওয়া হয়।
আশুলিয়ার মামলায় জবানবন্দিতে ২৩ বছর বয়সি গার্মেন্টকর্মী মো. শাহরিয়ার হোসেন সজীব বলেন, ‘আমরা যখন থানার সামনে যাই, কয়েকজন পুলিশ থানার সামনে অবস্থান করছিল। আমার বন্ধু সাজ্জাদ হোসেন সজল আমার আগেই থানার সামনে চলে যায়। আমি সেখানে গিয়ে দেখি সজলকে একজন ধরে আছে। তার নাম রনি ভূইয়া। তিনি একজন আওয়ামী লীগের নেতা এবং তৎকালীন এমপি সাইফুল ইসলামের সঙ্গে চলাফেরা করতেন। আমি তাকে আমার বন্ধু সজলকে ছেড়ে দিতে বললে রনি ভূইয়া সজলকে ছেড়ে আমাকে ধরে। তারপর আমি দেখি পেছনে একজন বন্দুকের গুলি লোড করছিল। আমি তখন আমার বন্ধু সজলকে সেখান থেকে সরে যেতে বলি। তারপর আমরা একটি গুলির শব্দ পাই।’
জবানবন্দিতে সাক্ষী বলেন, ‘গুলির শব্দ শুনে আমি এস এ পরিবহন অফিসমুখী রাস্তার দিকে যাই। অল্প কিছুদূর যাওয়ার পর আমি উস্টা খেয়ে পড়ে যাই। তখন দেখি আমার পায়ে ছররা গুলি লেগেছে। আমার সামনে একজন গুলিবিদ্ধ হয়েছিল, তাকে নিয়ে সামনের বাসার গেট খোলা পেয়ে ভিতরে ঢুকে যাই। ১০ থেকে ১৫ মিনিট অবস্থান করার পর গুলিবিদ্ধ ব্যক্তির অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাকে বের করার চেষ্টা করি। বের হওয়ার সময় গোলাগুলির শব্দ পেয়ে আবার ভিতরে ঢুকে যাই। এভাবে ৩ থেকে ৪ বার চেষ্টা করি। সেখানে আনুমানিক এক ঘণ্টার মতো গোলাগুলির শব্দ পাই। গুলিবিদ্ধ ব্যক্তি সেখানেই মারা যান। পরে আমরা সন্ধ্যা ৬টার দিকে ওই বাসা থেকে বের হই। বের হওয়ার সময় থানার সামনে একটি পুলিশের পিকআপ গাড়িতে কয়েকটি লাশ পোড়ানো দেখি। সেখান থেকে আমি সরাসরি বাসার উদ্দেশে রওনা দিই।’
জবানবন্দিতে শাহরিয়ার হোসেন আরও বলেন, ‘পরের দিন আমরা খবর পাই আমার বন্ধু সজলের লাশ থানার সামনে পাওয়া গিয়েছে। খবর পেয়ে সেখানে যাওয়ার উদ্দেশে রওনা দেই কিন্তু আমি থানার সামনে পৌঁছার আগেই সজলের বাবা, মা লাশ রিসিভ করেছিলেন। আমিসহ সজলের বাবা, মা লাশ নিয়ে থানার সামনে থেকে নারী ও শিশু হাসপাতালে যাই। সেখানে কিছু কার্যক্রম শেষ করে সজলের বাবা, মা লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। গ্রামের বাড়িতেই তাকে দাফন করা হয়।’ সাক্ষী বলেন, ‘কয়েকদিন পর ফেসবুক ভিডিওতে লাশ গাড়িতে ওঠানোর দৃশ্য দেখি এবং আরেকটি ভিডিওতে দেখি আমি যে গাড়িতে পোড়া লাশ দেখেছিলাম, ওই গাড়িতে আগুন জ্বালানোর দৃশ্য।’ রনি ভূইয়া, তৎকালীন এমপি সাইফুল ইসলাম এবং থানায় কর্মরত পুলিশ সদস্য গুলি করেছেন ও গাড়িতে আগুন দিয়েছেন বলেও জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন সাক্ষী।