স্থল সীমান্ত চুক্তি পাশ হওয়ার পর ভারতের রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের অপেক্ষায় ছিটমহল বিনিময়। বিনিময় সম্পন্ন হলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১১১ ছিটমহলের ১৭হাজার ১ শ ৫৮ একর জমির বন্টন নিয়ে এরই মধ্যে ছিটমহলগুলোতে আতংক তৈরী হয়েছে। অনেকেই শুরু করেছেন দলিল পত্র সংগ্রহ। নিরাপত্তার অভাবে যারা তৎকালীন বাংলাদেশে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে দলিলপত্র গচ্ছিত রেখেছিলেন তারা সেসব ফেরত নিচ্ছেন।
জানা গেছে ১৯০৫ সালের সি এস রেকর্ডের ভিত্তিতে এইসব ভূমির মালিকানা লাভ করে ছিটমহলবাসীরা। ১৯৪৭ সালে রেডক্লিভের সীমান্ত নকশায় যে ভূখন্ডগুলি বাদ পড়ে যায় সেগুলো ছিটমহল হিসেবে আখ্যায়িত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে যাতায়াতে বাধা না থাকায় ভারতীয় ছিটমহলবাসীরা ভারতে এবং বাংলাদেশী ছিটমহলবাসীরা বাংলাদেশের ভূমি অফিসে জমি বিক্রী বা ক্রয়ের দলিল করতেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ভারতের সীমান্তরক্ষীবাহীনী ছিটমহল বাসীদের ভারতে প্রবেশে বাঁধা দেয়। পরে একই ভাবে বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষীবাহীনীও ছিটমহল বাসীদের বাংলাদেশে প্রবেশে বাধা আরোপ করে। ফলে বন্ধ হয়ে যায় জমি রেজেষ্ট্রি কার্যক্রম। ১৯৭৪ সালে ভারতের হলদিবাড়ি থানার বিমল রায় এনক্লেভ কমিটি করেন। এই কমিটি প্রদত্ত সনদের মাধ্যমে কিছু কিছু ছিটমহল বাসিন্দারা ভারত ও বাংলাাদেশের ভূমি অফিসে জমি রেজষ্ট্রি করতেন। ১৯৮৮ সালের পর যাতায়াত সম্পুর্ণ বন্ধ হয়ে গেলে ছিটমহলের স্থানীয় শান্তিকমিটির ছিল ছাপ্পরে সাদা কাগজে জমি কেনা বেচার বন্দোবস্ত শুরুন হয়। তখন থেকে ক্রেতা, বিক্রেতা এবং দুজন স্বাক্ষীর স্বাক্ষরের মাধ্যমে সাদা কাগজে দলিল করে জমি বিক্রী এবং ক্রয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছিল।
শান্তি কমিটি জমি রেজিষ্ট্রি বাবদ নির্দিষ্ট ফি গ্রহন করতো যা ছিটমহলের রাস্তঘাট, মসজিদ, মন্দির নির্মান এবং অন্যান্য উন্নয়নমুলক কাজে ব্যবহার করা হতো। আতংক দেখা দিয়েছে এইসব সাদা কাগজের দলিলপত্র নিয়েই। এ দিকে ছিটমহলবাসীরা সাদাকাগজের দলিলে অনেক জমিই বিক্রী করেছেন বাংলাদেশীদের কাছে। যারা বাংলাদেশে থেকে সেসময় সাদাকাগজের দলিল দিয়ে জমি কিনেছেন তারাও আতংকে আছেন। অনেকেই আশংকা করছেন সাদা কাগজের দলিলকে অস্বীকার করা হলে ক্রেতারা বিপদে পরবেন। এদিকে ছিটমহলগুলোতে অনেক ভূমিহীন রয়েছেন।
১১১ ছিটমহলের মধ্যে পঞ্চগড়ের ছিটমহল গুলোতে ভূমিহীনের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী। এসব ভূমিহীন মানুষেরা ছিটমহলেরই প্রভাবশালীদের জমিতে বসবাস করে আসছে। অনেকেই বলছেন জমি রক্ষার্থেই এদেরকে থাকতে দেয়া হয়েছে। ছিটমহল বিনিময় হলে এরা যাবে কোথায় এমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এখন। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ভূমি বন্টন কিভাবে হবে?
সরেজমিনে দেখা গেছে স্থল সীমান্ত চুক্তি পাশের খবর শুনে পঞ্চগড়ের গারাতী ছিট মহলের মোহাম্মদ জমিরউদ্দিন (১০০) সাদা কাগজের এইসব দলিল হাতে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন। তিনি জানান, 'মুই টিপ সই দিছু। যতখান জমি দখল করিছে অতখান মুই বেঁচুনি।' বলিনাথ খান (৬০) জানান, 'সাদা কাগজে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের ছিল সই আর দুইজন স্বাক্ষীর মাধ্যমে জমি কেনা বেঁচা হয়েছে। অবৈধ দখলও হয়েছে। তাই জমি বন্টন নিয়ে সমস্যা দেখা দিতে পারে। তিন ভাগের দুই ভাগ জমিই কিনেছেন বাংলাদেশীরা।'
কাজলদিঘী ছিটমহলের ভূমিহীন শহীদুল ইসলাম খোকা পরিবার নিয়ে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলামের জমিতে দীর্ঘকাল বসবাস করে আসছেন। এখন তিনি অনিশ্চয়তায় ভূগছেন। তিনি জানান, 'ছুয়া পুয়া নিয়ে কোথায় যামো। হামাক যাতে সরকার জমি দেয়।'
এদিকে বিভিন্ন ছিটমহলের চেয়ারম্যানরা জানিয়েছেন ছিটমহলগুলোর অভ্যন্তরে অনেক খাস জমি থাকলেও তা দখল করে আছেন প্রভাবসালীরা। ভারত বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১১১ টি ছিটমহলে প্রায় ১৬শ একর খাস জমি রয়েছে। কাজলদিঘী এলাকার ৫টি ছিটমহলেই প্রায় ৩ শত একর খাস জমি রয়েছে। অনেক বাংলাদেশীও এসব খাস জমি দখল করে আছে।
পঞ্চগড় নীলফারী ছিটমহল বিনিময় কমিটির সভাপতি গারাতী ছিট মহলের চেয়ারম্যান বলেন মফিজার রহমান বলেন, 'শান্তিকমিটির পরিচালনায় যেভাবে বেঁচাবিক্রী হয়েছে সেভাবেই বন্টন দখল থাকবে। খাস জমি গুলো ভূমিহীনদের মাঝে বন্টন করা যেতে পারে।
'ভারত বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্নয় ছাত্র আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক ছিটমহল গবেষক এ এস এম ইউনুস বলেন' ১৯০৫ সালের সি এস জরিপে যেভাবে নাগরীকরা ভূমির মালিকানা লাভ করেছেন ঠিক একই ভাবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ছিটমহলের নাগরিদের যার যে পরিমান জমি দখলে রয়েছে তা অতিদ্রুত তার নামে রেকর্ডের ব্যবস্থা করা উচিত। পাশাপাশি সরকারকে বিভিন্ন ছিট মহলে থাকা খাস জমিগুলো ভ্থমিহীনদের মাঝে বন্টন করার উদ্যোগ নিতে হবে।