বাংলাদেশের মূল ভূ-খণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর সদ্য বিলু্প্ত ১১১টি ছিটমহলে উড়ল বহু আকাঙ্খিত মুক্তির পতাকা। শনিবার সূর্যোদয়ের পরপরই এসব ছিটমহলে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উড়ানো হয়। পঞ্চগড় জেলা সদরের গাড়াতি ছিটমহলের ফোরকানিয়া মাদ্রাসা মাঠে শনিবার সকাল ৬টায় আনুষ্ঠানিকভাবে লাল-সবুজের পতাকা উত্তোলন করেন ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. শামছুল আজম, পুলিশ সুপার (এসপি) মো. গিয়াসুদ্দীন আহমদ, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লায়লা মুনতাজেরি দীনা ও বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় কমিটির পঞ্চগড়-নীলফামারী জেলা সভাপতি মো. মফিজার রহমানসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
পতাকা উত্তোলনের সময় বেজে ওঠে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। বিলুপ্ত হওয়া গাড়াতি ছিটমহলের বাসিন্দাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় 'আমার সোনার বাংলা-আমি তোমায় ভালবাসি'।
পতাকা উত্তোলন শেষে ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. শামছুল আজম উপস্থিত জনতার উদ্দেশে বলেন, 'এখন থেকে আপনারা বাংলাদেশের নাগরিক। আজকের এই মুহূর্তটা অত্যন্ত স্বরণীয়। আপনাদের আমি সাদর অভিবাদন জানাই।'
দীর্ঘ ৬৮ বছর নিজভূমে পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দী থাকার পর অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়েছে বাংলাদেশ-ভারতের ১৬২টি ছিটমহলের প্রায় ৫০ হাজার মানুষকে। ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দ্রিরা স্থল সীমান্ত চুক্তি এবং ২০১১ সালের স্বাক্ষরিত প্রটোকল অনুযায়ী শেষ পর্যন্ত শুক্রবার (৩১ জুলাই) রাত ১২টা ১ মিনিটে বিনিময় হয় ছিটমহলগুলো। এর ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতের ১১১টি বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে একীভূত হয়। একইভাবে ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলও একীভূত হয় ভারতের সঙ্গে। এর মাধ্যমে ৬৮ বছরের অধিকার বঞ্চনার অবসান ঘটলো ছিটমহলের বাসিন্দাদের।
বক্তৃতায় জেলা প্রশাসক বলেন, 'আপনাদের ভূমি ও নাগরিক অধিকার ছিল না। জমি রেজিস্ট্রেশন করতে পারতেন না। এখন থেকে আপনাদের সব অধিকার প্রতিষ্ঠিত হল। আর এখানকার (ছিটমহল) যার কাছে যেভাবে জমি দখলে আছে বা ভোগ করছেন সেভাবেই থাকবে। আপাতত এখন যে যত রকম শক্তিশালী কাগজপত্রই নিয়ে আসুক জমির বেদখল নিতে পারবে না। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আপনাদের জন্য ইতিমধ্যে ২শ’ কোটি টাকা বরাদ্ধ হয়েছে। আরও বরাদ্ধ হবে। রাস্তা-ঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হবে। বাংলাদেশের অন্যান্য নাগরিকের মতই আপনারা স্বাধীনতা ও অধিকার ভোগ করবেন। এখন থেকে আর ছিটমহল বলতে কিছু নেই। সবাই একসঙ্গে ভেদাভেদ ভুলে থাকতে হবে।'
বৃটিশ সরকারের কাছ থেকে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামক দু'টি স্বাধীন রাষ্ট্রের জম্ম হয়। ১৯৪৭ সালে রেডক্লিফ মানচিত্র বিভাজন থেকেই উদ্ভব হয় এ ছিটমহলের। এক দেশের ভূখণ্ড রয়ে যায় অন্যদেশে।
২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ছিটমহলে বসবাসকারী লোকের সংখ্যা ৩৭ হাজার। আর ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ছিটমহলে ১৪ হাজার লোকের বসবাস। মোট ২৪,২৬৮ একর জমির মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ১৭,১৫৮ একর, আর ভারত পেয়েছে ৭,১১০ একর। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত ১১১টি ছিটমহলের অধিবাসীদের বেশিরভাগই মুসলিম। ভূখণ্ড ভারতের হলেও সবকিছু কেনাবেচা হতো বাংলাদেশি টাকায়। কুচবিহারে কোচ রাজাদের রাজ্যের কিছু অংশ রাজ্যের বাইরে বিভিন্ন থানা পঞ্চাগড় সদর, বোদা, দেবীগঞ্জ পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, লালমনিরহাট, ডিমলা ফুলবাড়ী ও ভূরুঙ্গামারিতে অবস্থিত ছিল। ভারত ভাগের পর ওই আটটি থানা পূর্বপাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়, আর কুচবিহার যুক্ত হয় পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে।
১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দ্রিরা স্থল সীমন্ত চুক্তির আলোকে ২০১১ সালে উভয় সরকারের মধ্যে প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়। চলতি বছরের ৭ মে ভারতের লোকসভায় বহুল আলোচিত স্থল সীমান্ত চুক্তি বিল পাস হয়। ৬ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় উভয় দেশের পররাষ্ট্র সচিব ছিটমহল বিনিময় হস্তান্তর করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে শুক্রবার রাত ১২টা ১ মিনিটে উভয় দেশের ছিটমহলগুলো নিজ নিজ দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে মিশে গেছে। বিলপ্তি ঘটে ছিটমহল শব্দটির।
বিডি-প্রতিদিন/০১ আগস্ট ২০১৫/ এস আহমেদ