সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল টেশপাড়া এলাকার হাজী বদর উদ্দিনের ৬ ছেলের মধ্যে নূর হোসেন তৃতীয়। ৮০ দশকে সিদ্ধিরগঞ্জের ইকবাল গ্রুপের ট্রাকের হেলপার, পরে চালক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন নূর হোসেন। দীর্ঘদিন দেশের বিভিন্ন জেলায় ট্রাক চালাতে গিয়ে ট্রাক শ্রমিকদের সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। '৮৭ সালের দিকে বাংলাদেশ আন্তঃজেলা ট্রাক চালক শ্রমিক ইউনিয়ন শিমরাইল শাখার কার্যক্রম শুরু করেন দাইমুদ্দিন নামে এক ট্রাক চালক। পরবর্তীতে দাইমুদ্দিনকে সরিয়ে শিমরাইল ট্রাক চালক শ্রমিক ইউনিয়নের দায়িত্ব নেয় নূর হোসেন। ওই সময় তিনি জাতীয় পার্টির রাজনীতি শুরু করেন। পরবর্তীতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে ফেলেন দল। ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসকে নিজের পুঁজি ধরে বাড়তে থাকে নূর হোসেনের অপরাধের সাম্রাজ্য। ১৯৯২ সালে গিয়াসউদ্দিনের আশির্বাদে সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে শহীদুল ইসলাম কন্ট্রাক্টরের (প্যানেল মেয়র নিহত নজরুল ইসলামের শ্বশুর) সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নূর হোসেন বিজয়ী হন। এরপর থেকে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান থাকাবস্থায় ১৯৯৯ সালে ভুয়া প্রকল্প তৈরী করে সোনালী ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ কর্পোরেট শাখা থেকে ১১ টি চেকের মাধ্যমে ১৭ লাখ ৬৫ হাজার টাকা উত্তোলণ করায় তার বিরুদ্ধে একটি মামলা করে দুদক। ১৯৯৮ সালের বন্যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক পানিতে ডুবে গেলে কাঁচপুর থেকে পূর্বাঞ্চলে লঞ্চ চালিয়ে ও লঞ্চে চাঁদাবাজী করে আয় করেন বিপুল পরিমাণ টাকা। এর আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গাড়ি প্রতি ২০ টাকা করে চাঁদা আদায় করতেন নূর হোসেন। এছাড়াও ওই সময় বিভিন্ন গার্মেন্ট ও শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা আদায় শুরু করেন। নজরুল ইসলামসহ ৭ জনকে অপহরণ ও খুনের প্রায় চারমাস আগেও নজরুল এবং তার সহযোগীদের সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের এবং আদমজী ইপিজেডের ব্যবসা ছিনিয়ে নেয় নূর হোসেন ও যুবলীগ নেতা মতিউর রহমান মতি।
মাত্র চার মাসে এ দুই প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা থেকে মতিউর রহমান মতির সাথে ভাগ-বাটোয়ারা করে আয় করেন দেড় থেকে দু'কোটি টাকা। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর বিজয়ী হন বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করে। নূর হোসেনের নিজের কথা, প্রতিদিন সাড়ে তিনশ লোক তার অধীনে কাজ করছে। এই সাড়ে তিনশ লোকের প্রতিজনের দৈনিক পারিশ্রমিক পাঁচশ টাকা। তাদের খাওয়া বাবদ কার্যালয়ের পাশে রয়েছে একটি হোটেল। যেখানে প্রতিমাসে কয়েক লাখ টাকার খাবার পরিবেশন করা হয় তার অনুগতদের।
সিদ্ধিরগঞ্জে আসার কিছু দিনের মধ্যে ২০ লাখ টাকা চাঁদা চেয়ে না পাওয়ায় শিমরাইল মোড়ের এ রহমান সুপার মার্কেটের সামনের জায়গা দখল করে নূর হোসেন বাহিনী। ২০০৯ সালের ১৯ আগষ্ট নারায়ণগঞ্জ সওজের টেন্ডার বক্সে নির্দিষ্ট সময়ের পর টেন্ডার ফেলতে আসায় তার ভাতিজা শাহজালাল বাদলকে বাধা দেয় নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি শফিকুল ইসলাম। কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর তার ভাতিজা শাহ জালাল বাদল ও তার ক্যডার বাহিনী বিচারালয় বসিয়ে এলাকায় নিজের মত করে বিচার শুরু করে। কাঁচপুরের পাথর ও বালু ব্যবসায়ী স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা শহীদুল্লাহর উপর হামলা চালিয়ে বালু মহল দখল করে ভাই জজ মিয়া। শীতলক্ষ্যার তীর দখল করে অবৈধভাবে বালুর ব্যবসা শুরু করে তার ভাই জজ মিয়া ও ভাতিজা শাহজালাল বাদল। ২০০৯ সালের ৯ জুলাই কাঁচপুরের শীতলক্ষ্যার তীরে বিআইডব্লিউটিএ-এর কর্মকর্তারা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে এলে নূর হোসেন ও তার বাহিনী বিআইডব্লিউ কর্মকর্তাদের ধাওয়া করে।
নূর হোসেনের সবচেয়ে বেশি আয়ের উৎস্যস্থল ছিল পরিবহনখাত। নির্বাচিত আন্তঃজেলা ট্টাক চালক ইউনিয়ন শিমরাইল শাখার শ্রমিক কমিটির সভাপতির পদ ছিনিয়ে নিয়ে সভাপতি বনে যান তিনি। কয়েক ধাপে প্রতিমাসে পরিবহন থেকে তার আয় দাঁড়ায় কয়েক কোটি টাকা। হাইওয়ে রোডের উভয় পার্শ্বে প্রায় সাড়ে ৩শ' হকার অস্থায়ী ভিত্তিতে পসরা সাজিয়ে বসে। আর এসব হকারের কাছ থেকে মাসোয়ারা আদায় করত নূর বাহিনী। ফুটপাতে দোকান বরাদ্দ দিতে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দেড় থেকে দু'লাখ টাকা অগ্রীম গ্রহণ করত তার বাহিনী। হকার প্রতি দৈনিক ২০ টাকা হারে মাসে ২ লাখ ১০ হাজার টাকা আয় হত।
কাঁচপুর ব্রিজের নিচে অপরিকল্পিতভাবে বালু ও পাথর ব্যবসা শুরু করেছিলেন নূর হোসেনের ছোট ভাই জজ মিয়া ওরফে ছোট মিয়া। এ স্থান থেকে মাসে তার আয় হত অর্ধ কোটি টাকা। সিদ্ধিরগঞ্জে থাকা ১৭ টি চুনা কারখানার প্রতিমণ চুন থেকে ৩০ টাকা হারে চাঁদা নিতেন নূর হোসেন। এ খাত থেকে প্রতিমাসে তার আয় দাঁড়ায় সাড়ে ১০ লাখ থেকে ১২ লাখ টাকা। ভান্ডারী মৎস্য খামার নামে বিভিন্ন জমিতে পানি আটকিয়ে ও অবৈধভাবে পুকুর দখল করে মাছ চাষ করে মাসে আয় হত ২ লাখ টাকা। শিমরাইলে অবস্থিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদার মাধ্যমে মাসে আয় হত ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা।
তার ভাই নূর সালাম ওরফে বোবা ডাকাত ভূমি জালিয়াতি করে নিরীহদের জমি দখল শুরু করে। ওয়ারিশী অংশ পাওয়ার নাম করে ভূমি জালিয়াতি করতো নূর সালাম। চাঁদাবাজি, জমিদখল থেকে শুরু করে মাদক ব্যবসায় নিজের জাল বিস্তৃত করেন নূর হোসেন। সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল আন্তঃজেলা ট্রাক টার্মিনালকে মাদক পরিবহনের নিরাপদ 'ট্রানজিট পয়েন্ট' হিসেবে নূর হোসেন ব্যবহার করতেন বলে জানিয়েছেন পরিবহন শ্রমিকরা। প্রতিদিন ৫-৭ ট্টাক মাদক এখানে হাতবদল হত। হাতবদল হওয়া মাদকের ধরণ ও দাম অনুপাতে ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নিত নূর হোসেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ট্রাক টার্মিনালে, কাউন্সিলরের অফিসের পেছনে ও ডেমরা আদমজী ইপিজেড রোডে ফজলুর রহমান পেট্রোল পাম্পের পেছনে ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা, মদ, বিয়ারসহ সব ধরনের মাদক প্রকাশ্যেই বিক্রি করতেন নূর হোসেন ও তার লোকজন। কাউন্সিলর অফিসের পিছনে টোকেন দিয়ে প্রকাশ্যেই বিক্রি করা হত ফেনসিডিল। শিমরাইলের ট্রাক স্টান্ডে ছিল তার কার্যালয়। এ ট্রাক স্টান্ডের পাশে এবং নিরালয় সিএনজি পাম্পের পাশে একটি দোতলা ভবনে হাউজি ও জুয়ার ব্যবসা চালাতেন নূর হোসেন ও তার বাহিনী। একইস্থানে যাত্রার নামে অর্ধনগ্ন নৃত্য ও প্রকাশ্যে মাইকিং করে লটারি বিক্রি করত তার বাহিনী। শীতলক্ষ্যা নদীর সাইলোর পাশে তার সহযোগী রিপন বাহিনী ও রতন বাহিনী দ্বারা বিভিন্ন নৌযান থেকে চাঁদা তুলতেন নূর হোসেন। পরিবহন চাঁদাবাজী, নৌ-রুটে চাঁদাবাজী, যাত্রা, মাদকব্যবসা, ভূমি দস্যুতা, বিচারের নামে অর্থ আদায় ও টেন্ডারবাজিতে তার অন্যতম সহযোগী ছিলেন শাহজালাল বাদল ওরফে ভাতিজা বাদল, সাদেকুর রহমান, শাহাজান ওরফে কাইল্যা শাহাজাহান, সানাউল্যাহ সানা, আলী মোহাম্মদ, ফরহাদ দেওয়ান, রতন, উজ্জল, আরিফুল হক হাসান, জামাল, সালাহউদ্দিন, আনোয়ার হোসেন আনু, টিপু, আফাজ উদ্দিন, সামছুদ্দিন আহমেদ ভুইয়া, জাকির হোসেন, শিপন, বরিশাইল্যা মামুন, সেলিম, বিয়ার বাশার, রাসেল, জুয়েল, মোশারফ, নোয়াখাইল্যা কামাল, আমান ওরফে ভেজাল আমান, ড্রাইভার হাফিজসহ অন্যান্যরা।
২০১৩ সালের শেষের দিকে বন্দরের মদনপুর এলাকায় একটি হাউজিং কোম্পানির জমি দখলের জন্য অস্ত্রের মহড়া দেয় নূর হোসেন। পরে ওই হাউজিং প্রকল্পে বালু ভরাটের কাজও পায় সে। মহড়া ও বালু ভরাটবাবদ তার আয় হয় ৪ কোটি টাকা। মোটা অংকের বিনিময়ে অনেক অনৈতিক কাজে ভাড়ায় খাটত নূর হোসেন। টাকার বিনিময়ে উপজেলা নির্বাচনে গজারিয়ায় কিলার নিয়ে ভাড়া খাটতে যায় নূর হোসেন। উপজেলা নির্বাচনে খুন হওয়া শামছু চেয়ারম্যনের স্ত্রী ওই সময় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তার স্বামীর হত্যার পিছনে এক এমপি ও ভাড়াটিয়া ক্যাডার নূর হোসেন দায়ী। যা ওই সময় অধিকাংশ গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়।
বিগত আওয়ামী লীগ আমলে শিমরাইল মোড়ে দৈনিক চাঁদাবাজী, সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে টেন্ডারবাজী, পরিবহন সেক্টর থেকে মাসিক চাঁদা, আন্তঃজেলা ট্রাক টার্মিনাল থেকে চাঁদা, নারায়ণগঞ্জ সওজ বিভাগের শিমরাইল অফিসে টেন্ডারবাজীসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আয় করেন নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন। সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের সব ঠিকাদার জিম্মি হয়ে পড়ে নূর হোসেন ও তার বাহিনীর কাছে। ১৯৯৭ সালের শেষের দিকে নূর হোসেন তার বাহিনী নিয়ে শিমরাইলের সওজ অফিসে হামলা করে নির্বাহী প্রকৌশলী সাহাবুদ্দিনের রুম দখল করা ছাড়াও বিগত আওয়ামী লীগ আমলে প্রকাশ্য দিবালোকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গুলি করে ও বোমা ফাটিয়ে ক্যাডারবেষ্টিত হয়ে গিয়াস উদ্দিনের কাসসাফ মার্কেটের জায়গা দখল করে। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর গিয়াসউদ্দিনের কারণে ভারত পালিয়ে যায় নূর হোসেন। ২০০৭ সালের ১২ এপ্রিল ইন্টারপোল দুর্ধর্ষ এ সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে রেডওয়ান্টে জারি করে।
গত বছরের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ করা হয়। তিন দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীতে ছয়জনের এবং পরদিন আরেকজনের লাশ ভেসে ওঠে। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার পরপরই ভারতে পালিয়ে যান প্রধান আসামি নূর হোসেন। চলতি বছরের ৮ এপ্রিল সাত খুনের মামলায় র্যাব-১১-এর তৎকালীন অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাঈদ, মেজর আরিফ ও লে. কমান্ডার এম এম রানা এবং নূর হোসেনসহ ৩৫ জনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে নারায়ণঞ্জ গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। জানা গেছে, হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে নূর হোসেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে যান। নৃশংস ওই ঘটনার ৪৯ দিন পর সেখানে গ্রেফতার হন নূর হোসেন। তিন সহযোগীসহ পশ্চিমবঙ্গে নূর হোসেন আটক হলেও তার অন্যতম সহযোগী ওয়াহিদুজ্জামান সুমন জামিন পান। এ ছাড়া নূর হোসেনের বিরুদ্ধে ভারতে অবৈধভাবে প্রবেশের অভিযোগে ফরেনার্স অ্যাক্টে মামলা করে বিধান নগর পুলিশ। তাকে ফেরত পেতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতের কাছে আর্জি জানানো হয়। বাংলাদেশ সরকারের আর্জি মেনেই নূরকে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে তৎপর হয় ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানানো হয়। সেই মতো ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩২১ ধারা অনুযায়ী নূর হোসেনের বিরুদ্ধে থাকা সব অভিযোগ তুলে নেওয়ার জন্য চলতি বছরের ২০ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে আদালতে আবেদন জানানো হয়। নূরকে বাংলাদেশ সরকারের হাতে তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করতে ১৬ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে থাকা সব অভিযোগই প্রত্যাহার করে নেন পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা দায়রা আদালত। একই সঙ্গে নূরকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দিতে আদালত উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা প্রশাসনকে দুই মাস সময়সীমা বেঁধে দেন। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে নূর হোসেনকে বাংলাদেশে ফেরত আনা হয়।
বিডি-প্রতিদিন/১৩ নভেম্বর ২০১৫/ এস আহমেদ