বৃহস্পতিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

দুই ছাত্রীর স্কুলে যাওয়া বন্ধ

শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে পাশবিক নির্যাতনের শিকার উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের একটি স্কুলের অষ্টম শ্রেণির দুই ছাত্রী ভয়ে বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এদিকে ওই ঘটনার পর স্থানীয়ভাবে নির্ধারণ করে দেওয়া ওই দুই ছাত্রীর ইজ্জতের মূল্য ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা এখনো পায়নি তাদের পরিবার। নির্যাতনের শিকার এক স্কুলছাত্রী ও তার পরিবার গতকাল এই প্রতিবেদককে মোবাইল ফোন করে তাদের আতঙ্কের কথা জানায়। এ সময় ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ওই স্কুলছাত্রী বলে, ১৪ ফেব্রুয়ারি স্কুলে আসার পথে বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সদস্য বকুল মিয়ার ছেলে মো. সাকিব উজ্জামান নাজিম ও কবির মিয়ার ছেলে ফকরুল ইসলাম তাদের সিএনজি অটোরিকশায় তুলে গ্রামের কোদালী ঘাটের স্লুইস গেটের পাশের একটি খালি বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে খারাপ কাজ করে। এ সময় ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল এলাকার দুরুদ মিয়ার ছেলে রাব্বি ও অটোরিকশার চালক আমির মিয়া। এ ঘটনার পর ১৭ ফেব্রুয়ারি বান্ধবীর বাড়ি যাওয়ার পথে নাজিম ও ফকরুল তাদের পথ আটকিয়ে জোর করে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। এ সময় তাদের স্কুলের একজন শিক্ষককে দেখে ছেলেরা পালিয়ে যায়। তখন তাদের সঙ্গে ছিল লামাপাড়া গ্রামের নাজিম উদ্দিনের ছেলে নাছির উদ্দিন, কাশিপুর গ্রামের কাদির মিয়ার ছেলে মাসুম মিয়া, তৈয়ব আলির ছেলে জোবায়ের, বুট্টি মিয়ার ছেলে লিটন মিয়া। পরে ওই শিক্ষক তাদের স্কুলে নিয়ে এলে এ ঘটনাটি তারা স্কুল ম্যানেজিং কমিটি ও মির্জাপুর ইউনিয়ন পরিষদের অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ এসআই ফজলুর রহমানকে খুলে বলে। মির্জাপুর উচ্চবিদ্যালয়ের অফিস সহকারী সমীরণ কুমার দত্ত বলেন, ‘আমি ওই দুই ছাত্রীকে রাস্তা থেকে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসি। পরে ঘটনাটি এলাকায় জানাজানি হয়ে গেলে বিষয়টি মিটমাট করার জন্য বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মো. ফিরোজ মিয়ার সভাপতিত্বে বিদ্যালয়ে শালিস বৈঠক বসে। ওই বৈঠক থেকে সাত সদস্যের একটি বোর্ড গঠন করে দেওয়া হয়।’

বিদ্যালয়ের দফতরি মুহিবুর রহমান বলেন, ‘ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মো. ফিরোজ মিয়া ছাড়া ওই শালিস বোর্ডে ছিলেন মির্জাপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই ফজলুর রহমান, স্থানীয় মেম্বার আইন উদ্দিন, ম্যানেজিং কমিটির সদস্য আজাদ মিয়া, বকুল মিয়া, ওয়াজেদ মিয়া। দিনভর চেষ্টার পর ফখরুলের পিতা কবির মিয়া ওই বোর্ডের রায় না মানায় সন্ধ্যার পর ছেলে-মেয়েদের থানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’

ওইদিন রাতেই এলাকার লামাপাড়া গ্রামের আকাব আলী মেম্বারের ছেলে শফিক ও বাজারের ব্যবসায়ী জামাল আহমেদের মধ্যস্থতায় দুই স্কুলছাত্রীর পরিবারকে ৭০ হাজার করে মোট ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে থানায় কোনো অভিযোগ না করে তাদের নিয়ে বাড়ি যাওয়া হয়। পেশায় মত্স্যজীবী এক স্কুলছাত্রীর পিতা বলেন, ‘রাতে গ্রামের আকাব আলী মেম্বারের ছেলে শফিক তাকে বলে মামলা করে কী হবে? তোমাকে মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য ৭০ হাজার টাকা দেওয়া হবে। তবে আমি এখনো টাকা পাইনি। আমাকে ১৫ দিন পর টাকা দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। আদৌ টাকা পাব কিনা এ নিয়ে আমি এখন সংশয়ে আছি। আমার মেয়েটি এখন ভয়ে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।’

আরেক ছাত্রীর পিতা স্থানীয় বাজারের চা দোকানি বলেন, ‘বাজারের ব্যবসায়ী জামাল মিয়া আমাকে দুই মাস পর ৭০ হাজার টাকা দেবে বলেছে।’ আকাব আলী মেম্বারের ছেলে শফিক বলেন, ‘আমি শুরু থেকে ছিলাম না। আগে স্কুল ম্যানেজিং কমিটি ও এলাকার কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি বিষয়টি সমাধানের জন্য বিদ্যালয়ে বসেছিলেন। কিন্তু সমাধান হয়নি। রাতে ওই ছেলেরা ও তাদের অভিভাবকরা আমার কাছে এলে আমি সবাইকে বুঝিয়ে থানায় গিয়ে শেষ করে দিই। তবে আমরা টাকা দিয়ে শেষ করিনি। যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে, যা যাওয়ার তা তো গেছে। মানসম্মানের বড় তো ৭০ হাজার টাকা নয়।’ ব্যবসায়ী জামাল বলেন, ‘আমি রাতে থানায় এসেছিলম এটা ঠিক। তবে বিষয়টি কীভাবে শেষ হয়েছে তা জানি না। আমি ৭০ হাজার টাকার কারও জামিন হইনি।’ ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মো. ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘আমি চেষ্টা করেছি বিষয়টি স্থানীয়ভাবে শেষ করে ফেলার জন্য। ওই দুই ছেলের অভিভাবককে ২ লাখ টাকা দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু একটি পক্ষ আমার কথা শোনেনি। পরে শুনেছি তারা থানায় গিয়েছে।’ এসআই ফজলুর রহমান শালিস বৈঠকে উপস্থিত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি পুলিশ, আমি শালিসে যাব কেন! বিষয়টি জানার পর আমি সবাইকে থানায় নিয়ে যাই। পরে কী হয়েছে তা ওসি সাহেব জানেন।’ ওসি এ কেএম নজরুল বলেন, ‘ওই দুই স্কুলছাত্রীর পরিবার মামলা করতে রাজি হয়নি। তারা মামলা করবে না বলে থানায় লিখিত দিয়ে গেছে।’

সর্বশেষ খবর