বেশ কয়েক দিন ধরে গোটা জাতি অধীর আগ্রহে মন্ত্রিসভায় রদবদলের খবরের আশায় ছিল। নৌ পরিবহনমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এবং খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামকে নিয়ে দেশজুড়ে যে আলোচনা, তাতে নৈতিক কারণেই তাদের সরে দাঁড়ানো উচিত, নইলে সরিয়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু হঠাৎ মঙ্গলবার দেশজুড়ে মন্ত্রিসভায় রদবদল নিয়ে তোলপাড়। অনলাইনের পাতায় পাতায় খবর দায়িত্ব হারাচ্ছেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের স্ক্রলও রক্তাক্ত হলো। মঙ্গলবার সকালে একনেক বৈঠকে সৈয়দ আশরাফের অনুপস্থিতি এবং তাতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াই এ ধরনের খবরের উৎস। শেষ পর্যন্ত দুই দিন পর সে গুজব সত্যি হলো। যে ঘটনা প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষুব্ধ করেছে, তেমন ঘটনা সৈয়দ আশরাফ প্রতিদিনই ঘটান।
ওয়ান-ইলেভেনের সময় থেকেই শেখ হাসিনার বিশ্বস্ততম সঙ্গী সৈয়দ আশরাফ। সাত বছর ধরে দলের সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু দলের কোনো অফিসেই তাকে তেমন দেখা যায় না। সাধারণত দলের সাধারণ সম্পাদকই রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হন। কিন্তু সাত বছর মন্ত্রী থেকে তিনি ক'বার সচিবালয়ে গেছেন, তা হাতে গুনে বলা যাবে। জানি না কোনো অভিমানে কিনা; তিনি দলবিচ্ছিন্ন, কর্মীবিচ্ছিন্ন, আসলে জগতবিচ্ছিন্ন মানুষ। কর্মীরা তাকে অফিসে পায় না, সচিবালয়ে পায় না, বাসায় যেতে পারে না। এসবই সত্যি। সৈয়দ আশরাফ প্রচলিত রাজনীতিবিদদের মতো নন। তিনি অন্যরকম। আমার কিন্তু সৈয়দ আশরাফকে দারুণ পছন্দ। আমার মনে হয়, তিনি ভুল সময়ে জন্ম নেওয়া ঠিক মানুষ। এমনকি তার কাছে কোনো তদ্বির নিয়ে যাওয়া যায় না, এটাও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হিসেবেই দাখিল করা হয়। কিন্তু বাসায় থেকে তিনি কী করেন? আমি যতদূর শুনেছি, তিনি প্রচুর পড়াশোনা করেন। আমরা আসলে চাই এমন সৎ, বিদ্বান, প্রাজ্ঞ, বিচক্ষণ, সংবেদনশীল মানুষরা রাজনীতিতে আরও বেশি করে আসুক। কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী গণমানুষের সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি বড্ড বেমানান। সৈয়দ আশরাফের আগে আওয়ামী লীগের সব সাধারণ সম্পাদকই ছিলেন গণমানুষের নেতা। সৈয়দ আশরাফ আসলে তাত্তি্বক নেতা, গণমানুষের নেতা নন। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়েও তিনি আসলে আনফিট। সৈয়দ আশরাফ অদক্ষ বা অপারগ নন, তিনি আসলে অনিচ্ছুক। আমার ধারণা সৈয়দ আশরাফ মনে করেন, সচিবালয়ে বা দলীয় কার্যালয়ে গিয়ে এই টাউট-বাটপার আওয়ামী লীগারদের তদ্বির, ব্রিজ-কালভার্ট, রাস্তাঘাট- এসব নিয়ে আলোচনা করা মানে সময় নষ্ট। এর চেয়ে একটি ভালো বই পড়া অনেক আনন্দের। সৈয়দ আশরাফ মন্ত্রণালয়ে যান না, তাই বলে কি তার জন্য মন্ত্রণালয়ের কোনো কাজ আটকে আছে? খোঁজ নিয়ে দেখুন কোন মন্ত্রণালয়ের এডিপি বাস্তবায়নের হার সবচেয়ে বেশি। বাসায় বসে যদি সুষ্ঠুভাবে মন্ত্রণালয় চালানো যায় তবে মন্ত্রণালয়ে গিয়ে দলকানা কর্মকর্তাদের তেলবাজি দেখতে হবে কেন?
সৈয়দ আশরাফের দায়িত্ব কেড়ে নেওয়ার দিন দিবাগত রাতে সরকারি দলের প্রভাবশালী একজন ফোন করলেন। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে হাউমাউ কান্নার শব্দ। আমি তো ভড়কে গেলাম। কী হয়েছে? কাঁদতে কাঁদতেই তিনি বললেন, আপনারা লেখেন, সৈয়দ আশরাফ একটা চোর। তারপর আবার কান্না। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই ফোনটা রেখে দিলেন তিনি। আমি অবাক হয়ে গেলাম, সৈয়দ আশরাফের মতো একজন 'জনবিচ্ছিন্ন' নেতার জন্য একই দলের আরেক নেতা এতটা আবেগ পোষণ করেন, এটা আমার ভাবনার বাইরে। আমি নিশ্চিত সৈয়দ আশরাফ সেই নেতার কোনো উপকার করেননি। তাই তার এই নিঃস্বার্থ আবেগ আমাকেও কিছুটা ছুঁয়ে গেল। কিন্তু আমি জানি তার এই কান্না-ভালোবাসা যতটা না সৈয়দ আশরাফের জন্য, তার চেয়ে বেশি আওয়ামী লীগের জন্য। কারণ তিনি জানেন যে সরকার মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের দায়িত্ব কেড়ে নিয়ে রাজাকারের সন্তানকে দেয়, যে সরকারে সৈয়দ আশরাফরা দায়িত্ব হারায় আর মায়া-কামরুলরা বহাল তবিয়তে থাকে; সে সরকার কল্যাণকর নয়। কারণ তিনি আওয়ামী লীগের ইতিহাস জানেন, তিনি জানেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাজউদ্দীনের বিচ্ছেদ, বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসের সবচেয়ে ট্র্যাজিক অধ্যায়ের একটি। তাজউদ্দীন কোনো দিন অব দ্য রেকর্ডেও বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। শেষ পর্যন্ত জীবন দিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি আনুগত্যের প্রমাণ দিয়ে গেছেন। তাজউদ্দীনের ছেলে সোহেল তাজের কাছেও মন্ত্রিত্বের চেয়ে মর্যাদা বড় মনে হয়েছে। তিনি দূরে সরে গেছেন, কিন্তু কোনো দিন দল বা সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। যত অভিমানই থাকুক সৈয়দ আশরাফও কোনো দিন সরকার বা দলের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি বা হয়তো বলবেন না। কিন্তু আওয়ামী লীগের অনেক বাঘা বাঘা মন্ত্রী বা নেতা আছেন যারা প্রকাশ্যে শেখ হাসিনার প্রশংসায় মুখে ফেনা তুলে ফেলেন। কিন্তু আড়ালে ঢেলে দেন বিদ্বেষের বিষ।
যেভাবে দুর্নীতিবাজ আর চাটুকাররা শেখ হাসিনাকে ঘিরে রেখেছে, তাতে সৈয়দ আশরাফদের মতো লোকদের বেশি করে দরকার; যিনি কোনো চিন্তা না করে শেখ হাসিনার মুখের ওপর সত্যি কথাটা বলতে পারবেন; যা দলের জন্য, সরকারের জন্য, দেশের জন্য ভালো হবে। বঙ্গবন্ধু আর তাজউদ্দীনের বিচ্ছেদ যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেছিল। তেমনি আজ বাংলাদেশের উন্নয়নের ট্রেনে গতি দিতে দরকার হাসিনা-আশরাফের যুগলবন্দি।
তবে আওয়ামী লীগের মতো তৃণমূলে ছড়িয়ে থাকা একটি দলের নেতা-কর্মীদের চাহিদা মেটানোর জন্য সার্বক্ষণিক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী এবং জনসম্পৃক্ত সাধারণ সম্পাদক দরকার। কিন্তু আমি মনে করি না, যেভাবে গুজব ছড়িয়েছে, সৈয়দ আশরাফকে সেভাবে সরিয়ে দেওয়া ঠিক হয়েছে। যতই জনবিচ্ছিন্ন হন, সৈয়দ আশরাফের মতো একজন শুধু দলের নয়, দেশের সম্পদ। তার প্রজ্ঞা অবশ্যই দল এবং সরকারের জন্য প্রয়োজনীয়। আপাতত তিনি দফতরবিহীন মন্ত্রী। তাকে বরং বিশেষ মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক ধরনের কোনো পদ দেওয়া যেতে পারে। তা যেন কোনোভাবেই তার আগের মর্যাদা ও গুরুত্বের চেয়ে কম না হয়। দলেও তাকে সাধারণ সম্পাদকের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কোনো দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। দল এবং সরকারে তিনি হতে পারেন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক। দল এবং সরকার ঠিকমতো চলছে কিনা, তা পর্যবেক্ষণ করে এক ধরনের ন্যায়পালের ভূমিকা পালন করতে পারেন তিনি। কিন্তু কোনোভাবেই যেন সোহেল তাজের মতো অভিমান করে সৈয়দ আশরাফও রাজনীতি ছেড়ে না যান। ভালো মানুষেরা রাজনীতি ছেড়ে গেলে, তা শুধু একটি দলের জন্য নয়, দেশের জন্যই ক্ষতির।
সৈয়দ আশরাফ হয়তো দল বা সরকারের জন্য কাজ করছেন না। কিন্তু তিনি তো সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেননি। কিন্তু মন্ত্রিসভায় মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া আর অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের উপস্থিতি সরকারের জন্য অস্বস্তিকর। মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার বিষয়টি পরিষ্কার। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলায় তার ১৩ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। পরে হাইকোর্টে আপিল করে তিনি বেকসুর খালাস পান। কিন্তু সম্প্রতি আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বাতিল করে নিয়মিত আপিল শুনানির নির্দেশ দিয়েছেন। ফলে মায়ার মাথায় এখন নিম্ন আদালতের দেওয়া ১৩ বছরের রায় ঝুলছে। আর সংবিধান অনুযায়ী নৈতিক স্খলনজনিত কারণে দুই বছরের বেশি সাজা হলেই তিনি এমপি হতে বা থাকতে পারেন না। সাংবিধানিক এবং নৈতিক দুই বিচারেই মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী আর এমপি বা মন্ত্রী থাকতে পারেন না। হাইকোর্টের নিয়মিত আপিলে যদি উনি খালাস পান, আবার ফিরে আসুন, তাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে মন্ত্রী বানানো হোক, আপত্তি নেই। কিন্তু দুর্নীতির দায়ে ১৩ বছরের সাজা মাথায় নিয়ে একজন মন্ত্রী ঘুরে বেড়াবেন, এটা দেখতে ভালো দেখায় না। মাঠের তুখোড় সংগঠক, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া অবশ্য বারবার সরকারকে বিব্রত করেছেন। আগেরবার ছেলে আর এবার মেয়ের জামাইয়ের কারণে তিনি বিতর্কিত হয়েছেন। আর এবার নিজের কারণেই বিপাকে ফেলেছেন সরকারকে।
মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া তবুও আপিল বিচারাধীন, এই যুক্তি দিতে পারেন। কিন্তু খাদ্যমন্ত্রী কী যুক্তি দেবেন? আমি বলছি না, ব্রাজিল থেকে আনা গম কেলেঙ্কারির জন্য খাদ্যমন্ত্রীই দায়ী। তবে উনি যতই বলুন, ঘাপলা যে একটা হয়েছে, তা তো অস্বীকার করতে পারবেন না। যদি সব ঠিকই থাকে, তাহলে খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে ওএসডি করা হলো কেন? মাননীয় মন্ত্রী দীর্ঘদিন মাঠে-ময়দানে রাজনীতি করেছেন। তিনি নিশ্চয়ই জানেন, সত্যের চেয়ে ধারণা কখনো কখনো শক্তিশালী। আর সাধারণ মানুষের ধারণা, ব্রাজিল থেকে গম আনার ক্ষেত্রে নয়ছয় হয়েছে। মাননীয় মন্ত্রী গলাবাজি আর চাঁপাবাজি করে বিএনপিকে পচানো যাবে, কিন্তু পচা গম আর ভালো করা যাবে না। আপনাদের পুলিশ, এমনকি আপনার দলের এমপি যে গম নিতে চাইছে না, সে গম আপনি জনগণকে গেলাতে পারবেন না। মন্ত্রী সংসদে স্বীকার করেছেন, ব্রাজিল থেকে আনা গম দেখতে ভালো না, তবে গুণগত মান ভালো। কিন্তু মাননীয় মন্ত্রী আগে দর্শনধারী, তারপর গুণবিচারী। আর যারে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা। তাই দেখতে খারাপ গম তিনি চালাতে পারবেন না। মন্ত্রী বারবার একটা কথা বলেন, ব্রাজিল থেকে আনা গম খাওয়ার উপযোগী। আমি ধরে নিচ্ছি, তার বক্তব্য সত্যি। কিন্তু অভাবে পড়লে মানুষ কচুঘেচুও খায়। তাই 'খাওয়ার উপযোগী' এটুকু সার্টিফিকেটই যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশ এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ। আমরা দেখতে খারাপ, যে কোনো মানের গম খাওয়ার সময় অনেক আগে পার করে এসেছি। খাদ্যপণ্য মান যাচাইয়ের ১০টি ক্রাইটেরিয়া আছে। খাওয়ার উপযোগিতা তার একটি মাত্র। আপনাকে বাজারে পাঠানো হয়েছে, পোলাওয়ের চাল কেনার জন্য। আপনি নিয়ে এসেছেন কাঁকরযুক্ত মোটা চাল। সে চালও খাওয়ার উপযোগী। আমি কি সেটা মানব? আমি এখনো বলছি না, খাদ্যমন্ত্রী দায়ী। কিন্তু সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে তিনি দায়ী। যাই ঘটুক দায় মন্ত্রীকে নিতেই হবে। যত দেরি করবেন, ততই তার নামের সঙ্গে গম শব্দটি জুড়ে যাবে। এরশাদ আমলে কাজী জাফরের নাম 'চিনি জাফর' হয়ে যাওয়ার কথা মানুষ ভোলেনি। সুষ্ঠু তদন্ত এবং দলের স্বার্থেই মাননীয় মন্ত্রীর সরে দাঁড়ানো উচিত। নইলে গমের পোকা ধীরে ধীরে কেটে দেবে সরকারের উন্নয়নের সোনার পালঙ্কের ভিত।
আমরা মন্ত্রিসভায় আরও রদবদলের খবর শোনার অপেক্ষায় থাকলাম।
লেখক : সাংবাদিক।