সম্প্রতি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফকে দফতরবিহীন মন্ত্রী করা হয়েছে, যা সঠিক এবং সৌজন্যমূলক হয়নি। প্রধানমন্ত্রী যা করেন তা সবই ঠিক, এ ধরনের ভাবনা কিন্তু সবসময় সঠিক হয় না। হয়তো ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কারণে তাৎক্ষণিক কেউ প্রতিবাদ করে না বা মুখ ফুটেও কিছু বলে না। কিন্তু ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীরা যে রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত নেন তার ভূরি ভূরি প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায়। সৈয়দ আশরাফকে মন্ত্রিত্ব থেকে বাদ দেওয়ার গুঞ্জনটি শুরু হয় ৭ জুলাইয়ের একনেকের একটি বৈঠকে। উক্ত বৈঠকে নাকি সৈয়দ আশরাফের অনুপস্থিতিতে গ্রামীণ সড়ক উন্নয়নে ৬ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প পরিকল্পনামন্ত্রী উপস্থাপন করলে অর্থমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী কেউ বৈঠকে উপস্থিত না থাকার কারণে প্রকল্পটি পাস না করার পক্ষে যুক্তি দেখান। অর্থমন্ত্রী নাকি তার আপত্তিতে আরও বলেন 'মন্ত্রী মনিটরিং না করলে প্রকল্প কিভাবে বাস্তবায়ন হবে? তাই এ বিশাল প্রকল্প নিয়ে চিন্তা করতে হবে।' ঘটনাটির সত্য-মিথ্যা আমরা জানি না। যেটুকু জেনেছি তা পত্র-পত্রিকার লেখা থেকে জেনেছি।
আমি সৈয়দ আশরাফের বিপক্ষের রাজনৈতিক ঘরানার লোক। তার রাজনৈতিক পতনের খবর স্বাভাবিকভাবেই আমার কাছে সুখবর। কিন্তু যেভাবে এবং যে পটভূমিকায় সৈয়দ আশরাফকে অসম্মান করা হয়েছে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে নিম্নলিখিত কারণে আমি তাতে ক্ষুব্ধ এবং এর প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
১। একনেক একটি রাষ্ট্রীয় কমিটি বা পরিষদ কিন্তু মন্ত্রী পরিষদের উপরে নয় এবং একনেক কোনো সাংবিধানিক কমিটিও নয়। যে কোনো মন্ত্রী একনেকের সদস্য হতে পারেন কিন্তু একনেকের সভায় উপস্থিত না থাকা কোনো মন্ত্রীর অপরাধ হতে পারে না। একনেক ১৯৮২ সালে স্বৈরশাসক এরশাদ প্রথম শুরু করেন যার বর্তমান প্রয়োজনীয়তা পুনঃমূল্যায়নের দাবি রাখে।
২। অর্থমন্ত্রী নিজে একনেকের একজন সদস্য হিসেবে অন্য সদস্যদের ব্যাপারে মন্তব্য করতে পারেন না।
৩। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী অর্থমন্ত্রীর ভাষ্যমতে কোনো প্রকল্পের মনিটরিংয়ের দায়িত্ব নিতে পারেন না। কোনো মন্ত্রীই কোনো মন্ত্রণালয়েরই মনিটর নন। মন্ত্রীর কাজ মনিটরিং করা নয়। মন্ত্রীরা নীতি-নির্ধারণমূলক সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন।
৪। ৬ হাজার কোটি টাকার যে প্রকল্পটি নিয়ে অর্থমন্ত্রীর মাথাব্যথা তার কিন্তু কোনো কেন্দ্রীয় কাঠামো বা নিয়ন্ত্রণ সিস্টেম নেই। পুরোটিই সংসদ সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে উপজেলা কাঠামো থেকে নিয়ন্ত্রিত হবে যেখানে সৈয়দ আশরাফের কোনোই নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। জনশ্রুতি আছে সৈয়দ আশরাফ দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতিবিদ হিসেবে এ ধরনের লুটপাট প্রকল্পের বিরোধী ছিলেন কিন্তু দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সরকারের গৃহীত নীতি মেনে নেওয়ার বাধ্যবাধকতায় তিনি নীরবে নিজেকে এ প্রকল্পের বাইরে রাখার মানসিক সিদ্ধান্ত নাকি নিয়েছিলেন যা তার মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের কাছে স্বাভাবিক কাম্য।
৫। সৈয়দ আশরাফ শুধু একজন মন্ত্রীই নন, তিনি একজন নিবেদিত রাজনীতিবিদ ও সরকারের রাজনৈতিক দলের সাধারণ সম্পাদক। তার সম্মন্ধে এত হালকাভাবে আলোচনা করা শোভনীয় হয়নি।
সংবিধানের ৫৫(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যে মন্ত্রিসভা সেখানে কে থাকবে না থাকবে তা সম্পূর্ণ প্রধানমন্ত্রীর একক এখতিয়ার। তবে একজন মন্ত্রীকে তার মানসম্মানের চিন্তা না করে ক্ষমতা আছে বলেই শীতের পরে ছিঁড়া কাঁথার মতো ছুড়ে ফেলে দেওয়ার মানসিকতা মেনে নেওয়া যায় না। হয়তো পদ-পদবি হারানোর ভয়ে আমরা অনেকেই তা মেনে নেই, চূড়ান্ত বিচারে কিন্তু প্রধানমন্ত্রীদের এর জন্য মূল্য দিতে হয়। এমনিতেই আমাদের সৎ, নিবেদিত, বিশ্বস্ত রাজনীতিবিদের বড় আকাল, তার মধ্যে যদি সৈয়দ আশরাফের মতো ব্যক্তিও এরকম অপমানের শিকার হন, তাহলে এই হতভাগা দেশে সজ্জন মানুষ রাজনীতি করবে না। চোর-বাটপাররাই রাজনীতির মাঠ দখল করে থাকবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বুঝতে পারিনি মন্ত্রিত্ব খোয়ানোর মতো কি অপরাধ সৈয়দ আশরাফ করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে তো দুর্নীতির কোনো অভিযোগ কেউ শুনতে পায়নি। তার মন্ত্রণালয়ে কাজ হয়নি, এরকম কোনো প্রমাণও তো দেখা যায়নি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে কোনো মতবিরোধও দেখা দেয়নি। আমরা বাইরে থেকে যতটুকু জানি তাতে সবাই বলাবলি করে আশরাফের মতো প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বস্ত সহকর্মী আর একজনও নেই। আগেই বলেছি কাকে মন্ত্রী করা হবে বা হবে না তার সর্বময় ক্ষমতার মালিক প্রধানমন্ত্রী। জানি না সৈয়দ আশরাফের মতো একজন নিবেদিত, বিশ্বস্ত, অনুগত, কর্মক্ষম, সৎ মন্ত্রীকে বাদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কি লাভ হয়েছে। জোর গলায় বলতে পারি সততা, নিষ্ঠা, আনুগত্য ও বিশ্বস্ততা দুষ্টচক্রের কাছে হেরে যাবে। সেই পুরনো কথার পুনরাবৃত্তি করে বলতে চাই, 'অসৎ সবার সঙ্গে সবকিছু দিয়ে শেয়ার করতে পারে কিন্তু সৎ-এর শেয়ার করার কেউ নেই এবং কিছু নেই এবং সৎ-এর পক্ষে কেউ থাকে না।' তাই আজ জনগণ বলছে আশরাফের পতন একজন সৎ মানুষের পতন যা বঙ্গবন্ধু কন্যার কাছ থেকে তার আপন ও বিশ্বস্তজনরা আশা করেনি। মন্ত্রিত্ব কোনো চাকরি নয় যে, কোনো সভায় উপস্থিত না থাকলে চলে যাবে। মন্ত্রীদের কোনো নির্দিষ্ট অফিস নেই। মন্ত্রণালয়ের অফিস মন্ত্রীর অফিস নয়। এমন কি গণতান্ত্রিক দেশে প্রধানমন্ত্রীর আলাদা কোনো অফিস নেই। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তার ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের বাসস্থানে তার অফিস করেন। “10 Downing Street is the official residence and the office of the British Prime Minister.” ভারতের প্রধানমন্ত্রী অফিস করেন তার বাসস্থান পঞ্চবটী, ৭ রেসকোর্স রোডে। (7, Race Course Road (officially : Panchavati and also 7, RCR) is the official residence and principal workplace of the Prime Minister of India, where he lives and holds most of his official or political meetings)। মন্ত্রীদের দশটা-পাঁচটা অফিস করার রেওয়াজ স্বৈরশাসকরা করে গেছে যা হয়তো গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন আশরাফ মেনে নিতে পারেননি কিন্তু সহজ-সরল মানুষ হিসেবে প্রকাশ্যে চলমান সিস্টেমের বিরোধিতা করেননি যা এখন তার কাল হয়েছে।
আমার ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র জীবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একটি স্মরণীয় ঘটনা আমি এ মুহূর্তে স্মরণ করতে চাই। ১৯৯৮ সালে তখনকার ডিজিএফআই-এর প্রধান জেনারেল হালিম আমাকে প্রধানমন্ত্রীর বাসস্থান গণভবনে নিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে মন্ত্রী বানানোর উদ্দেশ্যে। সেখানে তৎকালীন এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রায় দুই ঘণ্টা আলোচনা হয়েছিল কিন্তু আমি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে মন্ত্রিত্বের আহ্বান গ্রহণ করতে আপারগতা প্রকাশ করি এবং কোনো অবস্থায়ই মন্ত্রী হতে রাজি হইনি। কিন্তু স্মৃতিটি তা নয়। আমি আজও যে স্মৃতিটি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি তাহলো স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রী হওয়ার সরাসরি আহ্বান ফিরিয়ে দেওয়ার পরও তিনি কোনো উষ্মা দেখাননি, উল্টা তিনি তার ছেলের জন্য নিজের হাতে রান্না করা দেশি কৈ মাছ নিজের হাতে বেড়ে আমাকে ভাত খাওয়ায়ে ছিলেন। আমি সে জন্য কৃতজ্ঞ এবং আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মাতৃস্নেহ অতুলনীয়। তবে আজকে সৈয়দ আশরাফের পরিণতি দেখে মনে হচ্ছে সেদিন মন্ত্রী হওয়ার খায়েশ যদি হতো তাহলে আমার পরিণতি না জানি কি হতো!
পরিশেষে বলতে চাই প্রধানমন্ত্রীদের পাশে সৈয়দ আশরাফের মতো যাদের রক্ত বেইমানি করে না এমন অনেক মানুষের প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রীদের চাটুকারের অভাব হয় না কিন্তু আশরাফদের বড় অভাব। আশরাফদের দূরে ঠেলে দেওয়া সঠিক হবে না। সমাজে আশরাফদের শত্রু অনেক যেহেতু তারা অন্যায়কারীদের সঙ্গ দেয় না কিন্তু চূড়ান্ত লড়াইয়ে তাদেরই মূল্যায়ন হয়। সব বিরোধী দল যত না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষতি করতে পেরেছে আশরাফের বিরোধিতা করে তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে প্রধানমন্ত্রীর তথাকথিত নিজের লোকেরা যাদের চেহারা অতীতে বহুবার আমরা দেখেছি। আমি সৈয়দ আশরাফের কোনো বন্ধু নই বরং তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, তবে যে রাজনীতির স্বপ্ন আমি দেখি সৈয়দ আশরাফ সেই রাজনীতির একজন কাণ্ডারি। আমি ব্যক্তিগতভাবে সৈয়দ আশরাফের শক্ত এবং সম্মানজনক রাজনৈতিক অবস্থান কামনা করি তবে যে অপমান তিনি পেয়েছেন তা আরও বড় কিছু দিয়ে পূরণ না করলে আমরা হয়তো তাকে হারিয়েই ফেলব। কারণ সৎ মানুষ বড় অভিমানীও হয়। তাই দুঃখ ও বেদনা নিয়ে কবির ভাষায় বলছি- 'তুমি যারে করেছ অপমান, অপমান হতে হবে তাদের সবার সমান'। চলমান এই পরিস্থিতিতে সৈয়দ আশরাফের বিদেশে না যাওয়া হবে সময়ের সঠিক সিদ্ধান্ত।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।