স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মন্ত্রণালয় হারানোর পর পরই অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত নিশ্চিত করেছিলেন যে আরো পরিবর্তন আসছে। শেষ পর্যন্ত পরিবর্তন তেমন কিছু হয়নি, বরং মন্ত্রিসভায় নতুন কিছু মুখ সংযোজিত হয়েছে। এই সংযোজন নিয়ে জনমনে বড় ধরণের তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হয়েছে বলে চোখে পড়েনি। সরকারের সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলে তা নিয়ে যতোটা প্রতিক্রিয়া হয়, পছন্দ না করার তেমন কারণ না থাকলে সেই অর্থে ততোটা প্রতিক্রিয়া হয় না। মন্ত্রিসভার নতুন সংযোগ নিয়ে সম্ভবত অপছন্দ হওয়ার বড় ধরণের যুক্তি তেমন একটা নেই।
ইয়াফেস ওসমান নামে কেউ যে এই সরকারের মন্ত্রী আছেন সেটা ভুলেই গিয়েছিলাম। আমার ধারণা, অধিকাংশ মানুষই তিনি যে এখনো মন্ত্রী আছেন সেটা ভুলে গিয়েছিলেন। কথাবার্তায়, আচার-আচরণে মন্ত্রী-রাজনীতিকদের যে যতো 'ফাউল' সেই ততো আলোচিত, পরিচিত। মিডিয়াওয়ালারাও তাদের পেছনেই দৌড়ায়। ভালো কাজ করে সরকারের মন্ত্রীদের কেউ আলোচনায় আছেন- তেমন একটা নজির পাওয়া কঠিন। সেই দিক থেকে ইয়াফেস ওসমান আড়ালে পড়ে থাকারই কথা। তিনি আলোচনায় এসেছেন মন্ত্রী হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে।
গত দুই তিন দিনে অবশ্য একটা ব্যতিক্রম ঘটেছে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের বেলায়। সিলেটে শিশু রাজনের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডে পোর্টফোলিওর দায়বদ্ধতা এমন কি এখতিয়ার অতিক্রম করে তিনি কিছু কাজ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশংসাসূচক আলোচনায় তিনি জায়গা করে নিয়েছেন তার কাজ দিয়ে। একই ইস্যুতে প্রবল সমালোচিত হয়েছেন আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিসেবে রাজন হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে জনগণের আকাঙ্খার প্রতিফলন তার কাজে ঘটেনি। অবশ্য আগেও যে তিনি জনআকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটাতে পেরেছেন তেমনটি নয়। তবু তিনি পদোন্নতি পেয়েছেন। পরিপূর্ণ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি শপথ নিয়েছেন। তাঁর এই পদোন্নতির কোনো ব্যাখ্যা অবশ্য আমাদের কাছে নেই।
অনেক সময় জনগণের কাছে যেটি ব্যর্থতা – সরকারের নীতি নিয়ন্ত্রকদের কাছে সেটিই সফলতা হিসেবে বিবেচিত হয়। এই দেশে রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন। তিনি সেই দায়িত্বে থাকতে পারেননি। ‘খলিফা’ কায়দায় রাত বিরেতে থানা ঘুরে বেড়ানো সেই বীর উত্তম সরকারের কাছে গ্রহযোগ্য সফল ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হননি। হয়তো আর কখনো হবেনও না।
তবে মন্ত্রী পরিষদে নতুন সদস্যদের সংযোজনের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। সেজন্য তাঁকে ধন্যবাদ। বিতর্কিত, অতীতে ক্ষমতা বা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার সুবাদে বিত্তশালী হয়ে ওঠা ‘মৌসুমী’ রাজনীতিকদের এই যাত্রায় অন্তত: তিনি মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভূক্ত করেননি। নতুন অন্তর্ভূক্ত সদস্যদের কারো ব্যাপারেই এখন পর্যন্ত কোনো ধরণের অভিযোগ বা সমালোচনা কোনো পর্যায় থেকেই উঠেনি। বরং তাদের ব্যাপারে প্রশংসাসূচক বার্তাই পাওয়া যাচ্ছে চতুর্দিকে। একটি সরকারের জন্য এটি কম পাওয়া নয়।
সরকারের প্রতিটি সিদ্ধান্তই জনগণকে কোনো না কোনো বার্তা দেয়। মন্ত্রী পরিষদের সংযোজনও কিছু বার্তা দিয়েছে। চট্টগ্রামের বহু গ্রুপে বিভক্ত আওয়ামী লীগও নিশ্চয়ই কিছু বার্তা পেয়েছে। প্রয়াত আকতারুজ্জামান চৌধুরি বাবু আর এ বিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে ঘিরে চট্টগ্রামের আওয়ামী রাজনীতিতে যে বলয় গড়ে উঠেছে ক্ষমতার হাত অতীতে তার বাইরে তেমন একটা গিয়েছে বলে মনে হয় না। নুরুল ইসলাম বিএসসির পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে অন্তর্ভূক্তি সেই বলয় ভাঙ্গার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো পদক্ষেপ কী না, তা সময়ই বলে দেবে।
তারানা হালিমের মতো পরিচ্ছন্ন তারুণ্যের অন্তর্ভূক্তি রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে থাকা রুচিশীল, ভদ্রলোক আর সজ্জনরা অবশ্যই উৎসাহিত হবেন।
মন্ত্রী পরিষদের রদবদলের গুঞ্জন উঠলেই প্রচার প্রত্যাশী সুবিধাবাদী রাজনীতিকরা সক্রিয় হয়ে ওঠেন। 'সম্ভাব্যে'র তালিকায় নিজেদের নাম অন্তর্ভূক্ত করিয়ে পত্রিকায় নাম এবং ছবি ছাপানোর সুযোগটা প্রচার প্রত্যাশী রাজনীতিকরা কমই হাতছাড়া করেন। সাংবাদিকরাও তাদের পছন্দের নেতাদের নাম, ছবি ঢুকিয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত ফলাফল যাই হোক না কেন- পাবলিসিটি তো পাওয়া যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
ক্ষমতার অপব্যবহার করে লুটপাটের মাধ্যমে বিত্তশালী গডফাদার হয়ে ওঠা কোনো কোনো কেউকাটাও সাংবাদিকদের সঙ্গে সম্পর্কের সুবাদে সম্ভাব্য মন্ত্রী হিসেবে মিডিয়ায় নিজের নাম প্রচার করিয়েছিলেন। নানা কারণে বিতর্কিত সাবেক মন্ত্রীদের অনেকেও অনুসারীদের দিয়ে নিজেদের নাম সম্ভাব্য মন্ত্রী হিসেবে প্রচার করিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী তাদের খায়েশকে নাকচ করে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন- তাদের অতীতের সকল অপকর্ম সম্পর্কেই প্রধানমন্ত্রী জ্ঞাত।
বলতে দ্বিধা নেই যে মন্ত্রিসভায় নতুন সংযোজন সামগ্রিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। যদিও কিছু বিয়োজনের প্রত্যাশা অপূর্ণ থাকার হতাশাটা এখনো রয়ে গেছে। নতুন সংযোজিত হওয়া, পদোন্নতি পাওয়া মন্ত্রীদের অভিনন্দন এবং শুভেচ্ছা।