ঈদের আনন্দের কয়েক দিন আগেই একটা সুখবরে আমরা বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলাম। বিশ্বব্যাংক বলেছে, আমরা মধ্যম আয়ের দেশ বলে স্বীকৃতি লাভ করেছি। এই মহাসুসংবাদে অবশ্য ক্ষুধাযন্ত্রণাপীড়িত ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের যন্ত্রণার লাঘব হবে না। অসহনীয় বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের নির্মম জ্বালা সহ্য করতে না পেরে যারা বেপরোয়া হয়ে নৌকা করে সমুদ্রপথে ভয়ঙ্কর যাত্রা করেছিল, তাদের জন্য চাকরি জুটবে না। অথবা ঈদ সামনে রেখে জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে ২৭ নর-নারী-শিশুর যে মৃত্যু হয়েছে, তার পুনরাবৃত্তি হবে না- এমন নিশ্চয়তাও দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ মাথাপিছু গড় আয়ের হিসাব একটা সংখ্যা মাত্র। এই গড় হিসাবে প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না। কিছুসংখ্যক বিপুল ধনীর আয়ের সঙ্গে গরিব মানুষের আয় যোগ করলে যে গড় হয়, তার অংকটা বড় হলেও গরিবের সত্যিকারের আয় বৃদ্ধি হয় না।
তবু মধ্যম আয়ের দেশ বলে গর্ব করা যায় বৈকি! চাকরিসন্ধানী আট হাজার সমুদ্রে ভাসা মানুষের কথা অথবা জাকাতের কাপড়ের সন্ধানে পদপিষ্ট হয়ে মারা যাওয়া হতভাগ্যদের কথা আপাতত না ভেবে মনে একটু ফুর্তি ভাব রাখা যাক না। হাজার হোক আমরা তো এখন আর গরিব না। বিশ্বব্যাংক সার্টিফিকেট দিয়েছে। অর্থমন্ত্রীও বলেছেন, 'এ ধরনের স্বীকৃতিতে আত্দগরিমা বাড়ে।' গরিব কথাটা শুনতে খুব খারাপ লাগে। অসম্মানজনকও বটে। বিশ্বব্যাংকের স্বীকৃতি সেই অসম্মান থেকে আমাদের বাঁচিয়েছে।
জাতিসংঘের হিসাবে অবশ্য আমরা এখনো গরিবই রয়ে গেছি। বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের হিসাবে এবং মান নির্ণয়ে কিছু পার্থক্য আছে। তিন বছর পর পর মাথাপিছু বার্ষিক গড় আয় এক হাজার ৪৫ ডলার হলে বিশ্বব্যাংকের বিবেচনায় কোনো দেশকে মধ্যম আয়ের দেশ বলে গণ্য করতে হবে। আমাদের এখন গড় জাতীয় আয় এক হাজার ৩১৪ ডলার। জাতিসংঘের হিসাবে বার্ষিক গড় আয় যাকে বলে জিএনআই, তা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হচ্ছে ৯২৬ ডলার। তা এক হাজার ১৯০ ডলারে উন্নীত করতে পারলে জাতিসংঘ আমাদের মধ্যম আয়ের দেশ বলে স্বীকৃতি দেবে। আমাদের রাষ্ট্রনায়করা ভরসা দিচ্ছেন, ওটাও হয়ে যাবে। তারা বলছেন, 'টার্গেট ছিল ২০২১ সাল, তার আগেই টার্গেট পূরণ করেছি। অতএব আমাদের ওপর ভরসা রাখুন।' অবশ্য তারা দেশ থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণ, বেকারত্বের অবসান এবং ধনী-দরিদ্র বৈষম্যের জন্য কোনো ভরসা দিতে পারছেন না।
মধ্যম আয়ের জন্য যে গড় সংখ্যাটি অর্জন করতে হয়, তা কিন্তু আমরা আরও আগেই দেখাতে পারতাম। কারণ অনেক দেশজ আয় ঠিকমতো হিসাবের মধ্যে আসেনি। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ভাষ্য অনুযায়ী অর্থনীতির ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ হচ্ছে কালো টাকা। এই টাকার হিসাব ঠিকমতো পাওয়া কঠিন। ফলে গড় হিসাব থেকে কিছুটা অংক বাদ পড়ে যায়। তার ওপর যে টাকা গোপনে বিদেশে পাচার হয়ে যায় সেটাও হিসাবের বাইরে চলে যায়। গত বছর সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশি নাগরিকদের জমা টাকার পরিমাণ ছিল ৫০ কোটি ৮০ লাখ সুইস ফ্রাঁ, বাংলাদেশি টাকার হিসাবে চার হাজার ৪৫৪ কোটি টাকার সমান। সুইস ব্যাংকে টাকা রাখে বাংলাদেশের অতিকায় ধনীরা। তাদের কল্যাণেই তো গড় আয় বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের মর্যাদা আমরা পেয়েছি। তাদের টাকার পরিমাণ এবং বিদেশে পাচার করা টাকার পরিমাণও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০৪ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমানো টাকার পরিমাণ ছিল ৪ কোটি ১০ লাখ সুইস ফ্রাঁ। তার মানে প্রতি বছর পাচার করা টাকার পরিমাণ বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (GFI)) প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০১ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে মোট এক লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এটা না হলে তো বিশ্বব্যাংক, এমনকি জাতিসংঘের সার্টিফিকেট আরও আগে পেতাম। আমাদের অর্থমন্ত্রী খুবই স্পষ্টভাষী। ব্যাংক লুট করা দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে যে নিজ দলের লোকদের জন্যই ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না, এ কথা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, দুর্নীতির কারণে জিডিপি ২ থেকে ৩ শতাংশ কমেছে। হিসাব করলে দেখা যাবে অংকটি বেশ বড়। এই দুর্নীতির প্রাপ্য টাকার একটা বড় অংশ হিসাবের মধ্যে ধরা পড়ে না। পাচারের টাকা, দুর্নীতির পুরো টাকা যোগ করতে পারলে আমাদের গড় হিসাব আরও বড় হতো। আমরা আরও আগেই মধ্যম আয়ের দেশ বলে ঘোষিত হতাম। আহা! কী পরিতাপের বিষয়।
গড় হিসাবটাই আসলে খুব গোলমেলে ব্যাপার। আমাদের দেশে যে ধনীর সংখ্যা ও বিত্তের পরিমাণ বাড়ছে, এতে আমরা যারা গরিব ও মধ্যবিত্ত তারা যেন হিংসা না করি। কিছু লোক অতিকায় ধনী হওয়ার কারণেই তো গড় আয়ের হিসাব বেড়ে গেছে। আমাদের মর্যাদা বেড়েছে। এখন আর কেউ আমাদের গরিব দেশ বলবে না। ধনীর সংখ্যা কীভাবে এবং কত দ্রুত বাড়ছে, সেই চিত্রটাও সামনে থাকা ভালো। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রদত্ত হিসাব মতে, ২০১০ সালে কোটিপতির সংখ্যা ছিল ২৩ হাজার ২১২ জন। আর মাত্র চার বছরে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ হাজারের উপরে। মুদ্রাস্ফীতিকে হিসাবে নিলেও কোটিপতির সংখ্যা চার বছরে দ্বিগুণের বেশি হওয়া খুব স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। এই অস্বাভাবিকতার কারণেই ব্যাপক জনগণ দরিদ্রে পড়ে থাকলেও আমরা মধ্যম আয়ের দেশ বলে গর্ব করতে পারি। মধ্যম আয়ের দেশ বলেই তো রাস্তায় এত দামি দামি গাড়ি দেখা যায়। গত বছরের নভেম্বরের হিসাব অনুযায়ী BRTA-তে নিবন্ধিত কোটি টাকার ওপর গাড়ির সংখ্যা ৪৯ হাজার। অবিশ্বাস্য মনে হলেও কোনো কোনো গাড়ির দাম ৪-৫ কোটি টাকা পর্যন্ত- যেগুলো বড় বড় ব্যবসায়ী ও অনেক রাজনীতিবিদ ব্যবহার করেন। এসব গাড়িই তো রাস্তায় যানজট বাধায়।
অতিকায় ধনীদের অতিকায় আয় আমাদের গড় আয়ের হিসাবটি বাড়িয়ে দিচ্ছে ঠিকই। কিন্তু এ কথা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, দেশের প্রকৃত উৎপাদনে বা জাতীয় আয়ে তারা বড় অবদান রাখছেন। বড় অবদান রাখেন প্রধানত তিনটি শ্রেণি। সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আনছেন প্রবাসী শ্রমিকরা। এ বছর পহেলা জানুয়ারির হিসাবে বছরে পাঠানো রেমিটেন্সের পরিমাণ হলো ১৪ বিলিয়ন ডলার। আর গত জুনে বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২৪ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ প্রবাসী শ্রমিকদেরই অবদান সবেচেয়ে বেশি। অথচ আমরা জানি এই শ্রমিকরা মধ্যপ্রাচ্য বা মালয়েশিয়ায় প্রায় দাসসুলভ জীবনযাপন করেন। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে তারপর সবচেয়ে বেশি যাদের অবদান তারা হলেন গার্মেন্ট কারখানায় কর্মরত নারী-পুরুষ শ্রমিকরা, যাদের বলা যেতে পারে আধুনিক দাসশ্রম। জাতীয় উৎপাদনে আর অবদান রাখেন কৃষক, যারা ফসলের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে হতাশায় ভুগছেন। তার মানে, জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি করে একদল কিন্তু ভোগ করে আরেক দল। যারা হচ্ছে জনসংখ্যায় সংকীর্ণ স্তর, তাদেরই বিত্তবৈভব গড়কে বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তাতে কি ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনে ক্ষুধা, দারিদ্র্য দূর হয়? চিকিৎসা-শিক্ষা, এমনকি সুপেয় পানির প্রসঙ্গ তো বাদই দিলাম। বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরো যে হিসাব দিচ্ছে, তাতে বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এই সংখ্যাটি কিন্তু বেশ বড়- চার কোটি, যা পৃথিবীর অনেক দেশের লোকসংখ্যার চেয়ে বেশি। তবু এই চার কোটি মানুষের ব্যাপারে চোখ বুজে রেখে একটু আনন্দ করা যাক- 'আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি।' সরকারের লোকজনও বেশ গর্বের হাসি হাসছেন।
কিন্তু সমস্যা অন্যখানে। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য এত বিরাট হলে তা সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে, এমনকি অর্থনীতিকেও হুমকির মুখে ফেলে, যা সেই হাসি মুছে ফেলে দিতে পারে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলছেন, অর্থনৈতিক আয় বৈষম্য বৃদ্ধি বা হ্রাস পরিমাপ করা যায় যে 'গিনি সোহাগ' (এটি অর্থনৈতিক শাস্ত্রের একটি tool) দ্বারা, তা যদি বাড়তে বাড়তে শূন্য দশমিক পাঁচ-এর কাছাকাছি পৌঁছায় বা অতিক্রম করে তবে তা অর্থনীতির জন্য মারাত্দক সংকেত। এখন বাংলাদেশে গিনি সোহাগ এই সীমান্তরেখা প্রায় ছুঁতে চলেছে। অথচ তা ছিল বাংলাদেশে জন্মলগ্নকালে অর্থাৎ ১৯৭২ সালে মাত্র শূন্য দশমিক ৩২। তার মানে মোট জাতীয় আয় এবং মাথাপিছু মোট জাতীয় আয় বৃদ্ধি পেলেও ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে ধনবৈষম্য।
আমাদের সংবিধানে লেখা আছে সমাজতন্ত্র হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি। কিন্তু বাস্তবে আমাদের শাসক ও নীতিনির্ধারকরা অনুসরণ করছেন ঠিক তার উল্টা নীতি। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে দারিদ্র্যের মধ্যে রেখে, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বাড়িয়ে বিশ্বব্যাংকের সার্টিফিকেট 'মধ্য আয়ের দেশ', এই খেতাব লাভ করে কি আমরা সত্যিই গর্ব বা আনন্দ অনুভব করতে পারি?
আমাদের পাশের দেশ ভারত আঞ্চলিক সুপার পাওয়ার। অর্থনীতির আয়তনটাও বিরাট। পৃথিবীর মধ্যে তিন বা পাঁচ নম্বরে। (কোনো হিসাবে তিন, কোনো হিসাবে পাঁচ)। কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক রতন খাসনবিস বলছেন, দুটি ভারতবর্ষ আছে- ধনীর ভারত ও গরিবের ভারত। ২০০৯ সালের লেখা এক প্রবন্ধে তিনি বলছেন, 'ভারতের সেই বছরের জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ৮.৭ শতাংশ, তার আগের বছর ছিল ৯.৪ শতাংশ। কিন্তু 'দরিদ্র, হতদরিদ্র, প্রান্তিক ও দুর্বল শ্রেণিভুক্ত ভারতীয় পরিবারের সংখ্যা হলো মোট পরিবারের ৭৬.৭ শতাংশ।
সম্ভবত এদের একটা বড় অংশই দুই বেলা পেট ভরে খেতে পারে না।' প্রায় একই রকম কথা কি বাংলাদেশ সম্পর্কেও প্রযোজ্য নয়? মধ্যম আয়ের দেশ বাংলাদেশেও রয়েছে দুই দেশ- ধনীর বাংলাদেশ এবং গরিবের বাংলাদেশ। গরিবের বাংলাদেশের লোকেরাই অথৈ সাগর জলে ভাসে, জাকাতের কাপড় জোগাড় করতে গিয়ে প্রাণ হারায়, বন্দীশালার মতো গার্মেন্ট কারখানায় দৈনিক ১৭-১৮ ঘণ্টা কাজ করেও ঈদের আগে বকেয়া বেতনের দাবিতে রাস্তায় নামে। মধ্যম আয়ের দেশের সার্টিফিকেট পেয়েও হতভাগ্য বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ যে সেভাবে হাসতে পারছে না। কঠিন দারিদ্র্য যে আমাদের হাসি কেড়ে নিয়েছে।
লেখক : রাজনীতিক।