ঠাকুর ঘরে কেরে? কলা আমি খাই না। অনেক পুরনো প্রবাদ কিন্তু খুবই বাস্তব এবং অর্থবহ। সম্প্রতি সরকারদলীয় অনেক বাঘা বাঘা মন্ত্রী ও নেতা বিএনপি ভাঙা নিয়ে বড় বড় বক্তৃতা মাঠে-ময়দানে দিয়ে বেড়াচ্ছেন। সরকারের এককালের খামাকা মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এলান করেছেন বিএনপি নাকি এ দলের নেতারাই ভাঙছেন। সরকার বিএনপি ভেঙে দিতে সমর্থ হবে বিএনপি নেতারা এ ধরনের আশঙ্কা অমূলক বলে ঘোষণা দিলেও বাবু সুরঞ্জিত স্বীকার করে নিয়েছেন সব সরকারই বিরোধী দল ভাঙার চেষ্টা করে।
একইভাবে, কে বা কারা বিএনপি ভাঙার চেষ্টা করছে সে বিষয়ে কোনো তথ্য তার জানা নেই- বলেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও নতুন জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। সৈয়দ আশরাফ আরও বলেছেন, কারা ভাঙছে, ভাঙতে চাইছে তাদেরও তিনি চেনেন না। তবে সৈয়দ আশরাফ আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সব রাজনৈতিক দল যেন গণতান্ত্রিক পরিবেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। ভূতের মুখে রাম নাম। রাজনৈতিক দলের ভাঙাগড়া নদীর কূল ভাঙা-গড়ার মতো। চলমান নদী যেমন তার আপন খেয়ালে এক কূল ভাঙে তো আরেক কূল গড়ে তেমনি রাজনৈতিক দল ইতিহাসের বাঁকে ভাঙাগড়ার খেলায় মেতে উঠে। সময়ের সঙ্গে প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়, পরিবর্তন হয় মানুষের মনমানসিকতা। মানুষ ক্রমপ্রগতিশীল। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বেছে নেয় নতুন শিক্ষা, আদর্শ। পরিবর্তন হয় নেতৃত্বের। রাজনীতিতে সৃষ্টি হয় নতুন জোয়ার। নতুন নতুন পরিচয়ে রাষ্ট্র বিকশিত হয়, জন্ম হয় নতুন আদর্শের, এগিয়ে যায় রাষ্ট্র, সমাজ, সভ্যতা। এভাবেই আমরা আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগ থেকে বাকশাল, বাকশাল থেকে আওয়ামী লীগ পেয়েছি যা ঐতিহাসিক সত্য এবং বাস্তবতা। হয়তো সময়ই একদিন বলে দেবে আগামী দিনে কী পরিবর্তন হবে।
বিএনপি একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। সময়ের প্রেক্ষাপটে ও দাবিতে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির যাত্রা শুরু করেছিলেন। বাংলাদেশের এমন কোনো গ্রাম পাওয়া যাবে না যেখানে বিএনপির শাখা-প্রশাখা নেই। বিএনপি জনগণের ভোটে বেশ ক'বার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে এবং আগামীতেও যে কোনো সময় আবারও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে পারে। একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হিসেবে এটি বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সম্ভাবনা। এ রকম একটি সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক দল বা শক্তিকে ধ্বংস বা দুর্বল করার চেষ্টা তার প্রতিপক্ষরা করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের কাজে জড়ানো কোনো কারণেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। অতীতে সামরিক বা দলহীন স্বৈরাচারী সরকার হয়তো তাদের হীনস্বার্থে এ ধরনের ন্যক্কারজনক কাজ করতে পারে যার কথা বাবু সুরঞ্জিত বলেছেন কিন্তু কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে এ ধরনের হীন রাজনৈতিক কৌশল কোনো অবস্থাতেই কাম্য হতে পারে না।
অতীতে বিভিন্ন অবৈধ সামরিক ও স্বৈরাচারী সরকার গায়ের জোরে ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক কুলাঙ্গারদের ভাগিয়ে তাদের পক্ষে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দল ভাঙার ষড়যন্ত্র করেছে কিন্তু তারা সফল হয়নি। সাধারণ জনগণ কখনোই সামরিক বা স্বৈরাচারী সরকার পছন্দ করে না এবং মেনেও নেয় না। তাই সামরিক সরকার ক্ষমতায় এসেই প্রথমে জনপ্রিয় দলগুলোকে ভাঙার চেষ্টা করে। সামরিক সরকার প্রথমে বিভিন্ন জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের বিনা কারণে জেলে ঢুকায়, তার পরে বিভিন্ন মিথ্যা মামলা দিয়ে সামরিক সরকারের কাছে নতি স্বীকার করার জন্য হয়রানি করে। দুর্বল চিত্তের এবং দুর্নীতিপরায়ণ ও সন্ত্রাসী নেতা-কর্মীরা সামরিক সরকারের হয়রানিমূলক চাপ সহ্য করতে না পেরে সামরিক জান্তার সঙ্গে হাত মেলায়। এগুলো পুরনো কৌশল। এ ধরনের অপরাজনৈতিক কৌশল কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সরকারের কাছে আশা করা যায় না। এ অপরাজনীতির সঙ্গে বর্তমান সরকারের একটি সচেতন মহলের যে সমর্থন নেই তা কিন্তু নতুন জনপ্রশাসন মন্ত্রী আশরাফ সাহেবের কথায় ফুটে উঠেছে। সৈয়দ আশরাফ যথার্থই বলেছেন, সব রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক পরিবেশে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করুক। মনে হয় সৈয়দ আশরাফের মনোভাবের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর মনোভাবও এক। কিন্তু সমস্যা মনে হয় হয়েছে সরকারের হাইব্রিড নেতাদের নিয়ে। বিভিন্ন ঘাটে ধাক্কা খেয়ে আসা দলছুট দলভাঙা মন্ত্রীরা যারা যেখানেই যান সেখানেই বদহজম সৃষ্টি করে। জাসদ, কমিউনিস্ট, ন্যাপ ভাঙা নেতারা এখন এই সরকারের জন্য দিন দিন সমস্যা হয়ে উঠছে তা প্রায় দৃশ্যমান। এই দলছুট নেতারাই চাচ্ছেন বিভিন্ন দল থেকে নেতা-কর্মী ভাগিয়ে এনে সরকারে এই দলছুট নেতাদের প্রভাব বৃদ্ধি করতে। আওয়ামী লীগের অনেক হাইব্রিড নেতার সঙ্গে বিএনপির অনেক নেতার প্রকাশ্য এবং গোপনে যে অাঁতাত রয়েছে তা রাজনৈতিক মহলের সবার জানা। বিএনপি চেয়ারপারসনের একজন ক্ষমতাশালী ব্যক্তিগত সহকারীর সঙ্গে যে এক দাপুট শ্রমিক নেতা তথা মন্ত্রীর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তা বাংলাদেশের কে না জানে। পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, প্রভাবশালী ব্যবসায়ীসহ ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত সহকারীসহ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের মেলামেশা তো খোলা চোখেই দেখা যায়। দলের চেয়ারপারসনের কর্মসূচি সরকারের ওইসব মহল থেকে চূড়ান্ত হয় বলে বাজারে জনশ্রুতি আছে। তাই বিএনপির যে কোনো কর্মসূচি বা চেয়ারপারসনের গতিবিধির সব আগাম খবর সরকারের সব মহলই পেয়ে যায়, যার প্রমাণ জনগণ ভূরি ভূরি পেয়েছে।
সরকারের একটি মহল বিএনপি ভাঙতে তৎপর তার আলামত ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান। বর্তমান জগাখিচুড়ি সরকারে অনেক দলছুট দল ভাঙা নেতা আছে যারা সব সময়ই ভাঙাগড়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে। ওই ষড়যন্ত্রকারীদের মূল লক্ষ্য হলো আরও বেশি দলছুটদের সরকারে নিয়ে এসে সরকারের রাজনৈতিক ভারসাম্যটি নষ্ট করে দেওয়া। বিভিন্ন দল থেকে আসা এসব মন্ত্রীর অতীত পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ওরা সবাই কোনো না কোনো এক সময় আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুবিরোধী রাজনীতি করেছে। এসব দলছুট মন্ত্রীর সঙ্গে সরকারের মূল দল বা অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে খুব একটা ভালো সম্পর্ক নেই। এসব দলছুট মন্ত্রী সরকারে খুব প্রভাবশালী হলেও মাঠে-ময়দানে বা রাজনীতিতে তাদের কোনো প্রভাব নেই। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে বড় বড় বক্তৃতা দিলেও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তাদের মিল মহব্বত অনেক বেশি। তাই সব সময় এসব দলছুট মন্ত্রীর মুখে শোনা যাবে বিএনপি ভেঙে যাচ্ছে, জামায়াত ভেঙে যাছে, মন্ত্রিপরিষদে রদবদল হচ্ছে, অমুক মন্ত্রী বাদ পড়ছে, অমুক নতুন মন্ত্রী হচ্ছে। ওইসব দলছুট মন্ত্রী-নেতারা সব সময় খালেদা জিয়া ও তারেককে গালাগালি করবে, খালেদা জিয়ার জেল হবে, খালেদা জিয়াকে কাসিমপুর জেলে পাঠানো হবে, তারেক রহমানকে ধরে দেশে নিয়ে আসা হবে, তারেক রহমানের ফাঁসি হবে ইত্যাদি বড় বড় বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে বেড়াবে। দল ভাঙার আষাঢ়ে গল্প করে মিডিয়াকে মাতিয়ে রাখছে এসব দুর্নীতিবাজ দলছুট মন্ত্রী ও কালো বেড়াল মার্কা নেতারা।
সরকারে যেমন দলছুট মন্ত্রীরা সারা দিন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র নিয়ে ব্যস্ত তেমনি বিএনপিতেও ওই দলছুট নেতারা দলের মধ্যে ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত। সরকারের সঙ্গে অাঁতাত করে বড় বড় বক্তৃতা দেবে, মাঠের কোনো কর্মসূচিতে কর্মীদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ না করে প্রেসক্লাবে প্যাডসর্বস্ব নামহীন-কামহীন বিভিন্ন ভুঁইফোড় সংগঠনে বাপের চেয়ে বড় সরকারবিরোধী বক্তব্য দিয়ে জেলে যাবে। আবার তাদের জেল থেকে বের করে আনার জন্য বিনা পয়সার কিছু উকিল আদালতপাড়ায় দাঁড়িয়ে থাকে তাদের মুক্তির নাটকে অংশগ্রহণ করে দলের কোনো পদপদবি হাসিল করা যায় কিনা তার জন্য!
বিএনপি একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম যেখানে বিভিন্ন মত ও পথের লোকেরা একত্রীভূত হয়েছিল যাদের মূল লক্ষ্য ও আদর্শ ছিল ক্ষমতার ভাগ নেওয়া। তাই ১৯৮৪ সালে স্বৈরাচারী এরশাদ ক্ষমতায় আসার পরে অনেক পাখিই বিএনপি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। বিএনপি মূলত আশির দশকে রাজনৈতিক দল হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। তখন তরুণ প্রজন্ম বিশেষ করে ছাত্রসমাজ ছাত্রদলের বিএনপিতে ব্যাপক সমাবেশ ঘটে যাদের তারুণ্যদীপ্ত নির্লোভ নিঃস্বার্থ আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারী এরশাদের পতন হয় এবং বিএনপি ১৯৯১ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। ১৯৯১ সালে বিএনপির কর্মী ছিল অনেক কিন্তু নেতা ছিল কম। বিএনপির প্রায় সব নেতাই ১৯৯০ সালের আগে হয় বিএনপি ছেড়ে চলে গিয়েছিল না হলে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছিল। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে যে ১৪২ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তাদের প্রায় ৮০ জনই ছিলেন নতুন যারা আগে কোনো রাজনৈতিক দল করেননি। তার পরের ইতিহাস সবারই জানা। পতিত স্বৈরাচারের দোসররা দলে দলে বিএনপিতে এসে ভিড় করল, ধ্বংস বা নষ্ট করে দেওয়া হলো ছাত্রদলকে। নষ্ট করে দেওয়া হলো যুবসমাজকে। কলুষিত করা হলো ধর্মকে, ধর্মের রাজনীতির নামে ধর্ম ও রাজনীতিকে। এই ভুল রাজনীতির পথে হাঁটতে গিয়ে ক্ষমতা থেকে ছিটকে গেল বিএনপি। বিএনপি রাজনীতিতে ভুল করেছে কিন্তু তারপরও বিএনপি এখনো টিকে আছে শুধু বেগম খালেদা জিয়াকে অবলম্বন করে। খালেদা জিয়াই বিএনপির একমাত্র শক্তি। এই বিএনপিতে দুর্নীতিবাজ দলছুট নেতাদের কোনো প্রয়োজন নেই। এই দল তারুণ্যের দল। এই দল ফিনিক্সে পাখির দল যার প্রতিটি পালক থেকে নতুন ফিনিঙ্ জন্ম নেয়। কিছু লোক দল থেকে চলে গেলে দল ভেঙে যায় না। অতীতে অনেকেই বিএনপি ছেড়ে চলে গেছে তাই বলে বিএনপি থেমে থাকেনি। শরীরের নষ্ট রক্ত যেমন প্রতিনিয়ত জন্ম নেওয়া নতুন রক্তকণিকা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয় তেমনি বিএনপির নষ্ট হয়ে যাওয়া নেতাদের স্থান পূরণ করবে আগত নতুন প্রজন্মের নেতারা। বিএনপির ভয়ের কিছু নেই। বিএনপির পেছনে ফিরে দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। যারা চলে গেছে তাদের চলে যেতে দিন। যারা এখনো চলে যেতে চায় তাদেরও চলে যেতে দিন। আমি সহ আমরা যারা বিভিন্ন বাহানায় দল থেকে দূরে সরে গেছি তাদেরও দলে ফিরিয়ে আনার কোনো প্রয়োজন নেই। নতুনদের জায়গা করে দিতে হবে। দুর্নীতিবাজদের হটিয়ে রাজনীতিতে খাঁটি রক্ত সঞ্চালনের ব্যবস্থা করতে হবে। ৮০ দশক উত্তর ছাত্র, যুব ও কর্মজীবী প্রজন্মকে সুযোগ দিলে ওরাই বিএনপিকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাবে। বিএনপির জয় সুনিশ্চিত। হটকারিতায় বিএনপিকে ধ্বংস করবেন না। অন্ধকারের পরেই যে আলো সেই আলোর বিন্দু দেখা যাচ্ছে যার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আর সাড়ে তিনটি বছর। তাড়াতাড়ি করলে বুমেরাং হবে। এখন সাবধানে পা ফেলতে হবে। জেলজুলুমের ভয়ের দিন চলে গেছে। সরকার এখন নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। এ সুযোগে বিএনপিকে ঘর গোছাতে হবে। বিএনপি এখন আর ভাঙবে না বরং দিন দিন শক্তিশালী হবে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।