বেশ কিছুদিন ধরে রাজনৈতিক অঙ্গনের একটি মুখরোচক খবর প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায়ও বেশ গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পাচ্ছে যে, বিএনপি ভেঙে যাচ্ছে এবং এই ভাঙন রোধ করার জন্যই পার্টির চেয়ারপারসন তার সৌদি আরব সফর বাতিল করেছেন। যাদের ব্যাপারে ভাঙন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা আকারে-ইঙ্গিতে বলা হচ্ছে এরা প্রায় সবাই ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী 'বিপ্লবী'। ওয়ান-ইলেভেনের পর এদের কেউ কেউ দুর্নীতির দায়ে জেল খেটেছেন। বিএনপির দু'একজন প্রবীণ নেতার টেলিফোন সংলাপ আড়ি পেতে সংগ্রহ করে বলার চেষ্টা করা হচ্ছে, বর্তমান বিএনপির হালচালে তারা মোটেও সন্তুষ্ট নন। অর্থাৎ তারাও নতুন কিছু করার কথা ভাবছেন। কিন্তু ওই টেলিফোন সংলাপ পর্যালোচনা করলে অনুমানটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। নেতা-কর্মীদের মধ্যে দল নিয়ে, দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিংবা করণীয় নিয়ে এমন আলোচনা হতেই পারে। সেই আলোচনার সঙ্গে সবাইকে একমত হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আবার মতামতটা যদি দলের জন্য উপযোগী এবং লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হয় তাহলে তা গ্রহণ করলেইবা ক্ষতি কি? ওয়ান-ইলেভেনের পর দলের তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার উত্থাপিত সংস্কার প্রস্তাব নাকচ করে তার ব্যাপারে অগণতান্ত্রিক ও অগঠনতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত না নিয়ে যদি প্রস্তাবের ভালো দিকগুলো বিবেচনা করা হতো, দলটিকে এখন এত পস্তাতে হতো না এবং দল 'পুনর্গঠন-পুনর্গঠন' বলে গলা শুকাতে হতো না। দলে ভিন্ন মতের প্রকাশ হলেই তা দল ভাঙার প্রক্রিয়া হিসেবে ভাবা ঠিক নয়। তবে রাজনৈতিক ও আদর্শগত কারণে একটা দলে বিভক্তি আসতেও পারে। আওয়ামী লীগেও এমন ভাঙন হয়েছিল ১৯৫৭ সালে। পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি, সিয়েটো-সেন্টো চুক্তি, বাগদাদ প্যাক্ট এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে (সোহরাওয়ার্দী বলেছিলেন ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়ে গেছে) হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দলের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা ভাসানীর বিরোধ মীমাংসার অযোগ্য স্তরে পৌঁছে গেলে দল ভেঙে যায়। সোহরাওয়ার্দী ছিলেন মার্কিন অনুরাগী আর মওলানা ছিলেন ঘোর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী। ফলে লীগ ভেঙে সেই সাতান্ন সালেই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) জন্ম। বিএনপিতে তেমন কোনো রাজনৈতিক বিরোধ এখনো দৃশ্যমান নয়। মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ও জামায়াতে ইসলামী প্রশ্নে মতাদর্শগত যে বিষয়টি নিয়ে দলে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, এটা সমগ্র দলগতভাবেই হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এ বিষয়টি বিএনপিতে একটি জটিল বিষয় তো বটেই। তবে বিএনপির রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক অবস্থানে একটা তাৎপর্যপূর্ণ ও দৃশ্যমান পরিবর্তনের লক্ষণ দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে। বিএনপিকে বলা হতো 'ডানের বাম এবং বামের ডান'- অর্থাৎ মধ্যপন্থি একটি উদার গণতান্ত্রিক দল। দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদীদের একটি মিলনকেন্দ্র হিসেবেই ভাবা হতো দলটিকে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জীবদ্দশায় লক্ষ্যের প্রতি অবিচল ছিল দলটি। একটি স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তিনি 'জাতীয় ঐক্য, সমন্বয় ও সমঝোতা' তত্ত্বের ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন। সেই তত্ত্ব প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছু ভুল-ত্রুটি হয়তো হয়েছে; কিন্তু তিনি লক্ষ্যচ্যুত ও আদর্শচ্যুত হয়েছেন- এটা তার 'জাতশত্রু'রাই শুধু বলতে পারে, আর কেউ নয়। জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করার সুযোগ প্রাপ্তি ঘটেছে জিয়াউর রহমান শাসন ক্ষমতায় আসার পর সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে।
আমরা জানি, এর আগে বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে একদলীয় বাকশাল প্রথা কায়েম করা হয়। জনগণের মৌলিক সব নাগরিক অধিকার হরণ করা হয়। পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় ব্যবস্থার বদলে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করা হয়। সেই সুবাদে বাকশালের 'কোটর' থেকে আওয়ামী লীগ যেমন আবার আলোর মুখ দেখে, জামায়াতে ইসলামীও সেই সাংবিধানিক সুযোগটি গ্রহণ করে। জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেওয়ার সেই উদ্যোগটি যদি 'অপরাধ' হয়ে থাকে- যার সুযোগ জামায়াত নিয়েছে, পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ এবং তার ঘনিষ্ঠ মিত্ররা কী করেছে? সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এ সময় তো যথেষ্ট ছিল। স্পষ্ট বোঝা যায়, বিএনপিকে ঘায়েল করার জন্যই অভিযোগটি বারবার উত্থাপন করা হয়। উচ্চ আদালতে যেখানে নির্বাচন কমিশনে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল হয়ে গেছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতে ইসলামীকে যেখানে দল হিসেবে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিবেচনার কথা বলেছেন, সে ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে লীগ সরকারের টালবাহানা রহস্যময়ই বটে!
তাই বলে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির বর্তমানে 'হরিহর আত্মা' হয়ে যাওয়ার মতো সম্পর্ককে কি অনুমোদন করা যেতে পারে? প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির এমন 'হানিমুন' সম্পর্কের কথা কল্পনাও করা যায়নি। ১৯৯৮ সালে চারদলীয় জোট গঠনের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর নিবিড় সম্পর্কের বিন্যাস শুরু হয়। জানা যায় আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে হারাতে ভোটের অঙ্কের হিসাব বুঝিয়ে খালেদা জিয়াকে রাজি করানো হয়। বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া জামায়াতকে নিয়ে জোট গঠনের বিরোধিতা করেছিলেন; কিন্তু ঠেকাতে পারেননি। সেই যে শুরু, দেড় যুগে তা আরও পোক্ত হয়েছে।
তখন ভোটে জেতা বা আসন সংখ্যার চেয়েও জামায়াতের প্রয়োজন ছিল বিএনপির মতো একটি রাজনৈতিক বটবৃক্ষের আশ্রয়। সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য ছিল ভোটের জোটকে স্থায়ী মৈত্রী জোটে পরিণত করে জোটের রাজনীতির নামে সারা দেশে সংগঠনকে ছড়িয়ে দেওয়া। ১৯৯৮ সালে জামায়াতের সাংগঠনিক বিস্তৃতি, শক্তি ও সক্ষমতার সঙ্গে বর্তমান অবস্থা তুলনা করলে বলতে হবে, তারা তাদের লক্ষ্য অর্জনে সফলই হয়েছে। তৃণমূলে তাদের কর্মী-সমর্থক রিক্রুটমেন্টের 'টার্গেট গ্রুপ'ই ছিল বিএনপির তৃণমূলের নেতা-কর্মী সমর্থকরা। বিএনপির 'বড় বাবুরা' হয়তো জানেনই না যে, তৃণমূলে তাদের দলের কী সর্বনাশই না হয়ে গেছে এরই মধ্যে! শুধু তৃণমূল কেন, থানায়, জেলায় এমনকি কেন্দ্রেও বিএনপির ওপর তাদের প্রভাব এতটাই বেশি বলে ধারণা করা হয় যে, দলের নীতি-নির্ধারণেও তারা কলকাঠি নাড়তে পারে। আবদুল মতিন চৌধুরীকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার পেছনে জামায়াতের জোর তদবির ছিল বলে একদা গুঞ্জন ছিল। বলা হয়ে থাকে, তার পৃষ্ঠপোষকতাতেই বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ইসলামী ছাত্রশিবির শক্তি আহরণ করে এবং বিএনপির প্রতাপশালী অঙ্গসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল দিন দিন দুর্বল হতে থাকে। জামায়াতের সঙ্গে জোট বাঁধার পর বিএনপি চরিত্রে এমন একটা লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা যায় যে, তারা যেন 'ইসলাম গেল ইসলাম গেল' একটা রব তুলতে চাইছে। খালেদা জিয়া নিশ্চয়ই কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে একবার বলে ফেলেছিলেন, 'এখন থেকে মসজিদে আজানের পরিবর্তে উলুধ্বনি শোনা যাবে।' তেমন ঘটনা কিন্তু দেশে ঘটেনি। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও বিএনপির ভুল আছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। জিয়ার শাসনামলে বিএনপির বহু আন্তর্জাতিক মিত্র তৈরি হয়েছিল। তার শাহাদাতবরণের পর বিশ্ব প্রতিক্রিয়ায় তা লক্ষ্য করা গেছে। খালেদা জিয়া স্বল্পকালীন একবারসহ তিনবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকার গঠন করেন। ১০ বছরের বেশি সময় তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। কিন্তু এত দীর্ঘ সময়েও তিনি আন্তর্জাতিক পরিসরে না পেরেছেন দলের জন্য, না পেরেছেন নিজের জন্য কোনো শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্য মিত্র তৈরি করতে। দ্বিতীয় দফার ক্ষমতাকালে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী স্বল্পকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন ছাড়া ১০ বছরের বাদবাকি সময় ম্যাডামের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন কর্নেল (অব.) মুস্তাফিজুর রহমান এবং এম মোর্শেদ খান। অবাক বিস্ময়ে মানুষ এখনো ভাবে কোন বিবেচনায় তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয়েছিল! ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও বিএনপি ভুল নীতি অনুসরণ করেছে বলে এখনো সমালোচনা শুনতে হয় দলটিকে।
খালেদা জিয়া তা উপলব্ধি করেছেন বলে স্পষ্ট হতে থাকে শেখ হাসিনার দ্বিতীয় দফার শাসনামলেই। বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতিতে নিকট প্রতিবেশী ভারতের মনোভাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ ছাড়াও ইনসার্জেন্সি রোধে বাংলাদেশে একটি বন্ধুভাবাপন্ন সরকার তারা প্রত্যাশা করতেই পারে। বাংলাদেশে মৌলবাদী ও জঙ্গি তৎপরতাও ভারতের মাথাব্যথার কারণ হতে পারে। শুধু ভারত কেন, মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ এখন সারা বিশ্বের জন্য হুমকি বলে বিবেচিত।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনাহূত ভারত-বৈরিতার কুফল বিএনপির টের পাওয়ারই কথা। ২০১২ সালের অক্টোবরে সরকারি আমন্ত্রণে ভারত সফরে গিয়ে খালেদা জিয়া তার দলের ভারতনীতিতে পরিবর্তনের সুস্পষ্ট ঘোষণা দেন। ঘোষণা দেন তার দল ক্ষমতায় গেলে ভারতের স্বার্থবিরোধী কোনো কাজে বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করতে দেবে না। অন্য আরও অনেক বিষয়েই তিনি অনুকূল অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বলেন, 'আমরা অতীত ভুলে যেতে চাই। পেছনে নয়, তাকাতে চাই সামনে।' কিন্তু কিছুদিন পরই আবার বিভিন্ন ইস্যুতে বিরোধ জন্ম নিতে থাকে হয়তো কারও উস্কানিতে। তার বড় আকারের দৃষ্টিকটু বহিঃপ্রকাশ ঘটে ২০১৩ সালের মার্চ মাসে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির বাংলাদেশ সফরকালে। তার সঙ্গে পূর্ব-নির্ধারিত সাক্ষাৎ কর্মসূচি বাতিল করে দেন খালেদা জিয়া। তখন তার জোট আহূত হরতালের কর্মসূচিকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। অবশ্য সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তিনি তার নিরাপত্তা হুমকিকেই কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। নরেন্দ্র মোদির সফরকালে খালেদা জিয়া আবারও তার ভারতনীতির পরিবর্তনের বিষয় বেশ ভালোভাবেই পরিষ্কার করেছেন। নরেন্দ্র মোদিও খালেদা জিয়াকে যা বলেছেন তার মমার্থ না বোঝার কিছু নেই। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ড. এস জয়শংকর বলেছেন, 'খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বেশকিছু বিষয় আলোচনা হয়েছে। বিএনপি নেত্রী স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুস্বাক্ষরে প্রধানমন্ত্রী মোদির নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন। এ অঞ্চলের এবং এর বাইরে পণ্যের অবাধ চলাচলের প্রতিও তিনি সমর্থন জানান। তিনি সব ধরনের সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে তার অবস্থান তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আমাদের অবস্থানও স্পষ্ট করেছেন। আর তা হলো আমরা গণতন্ত্রের সমর্থক এবং আমরা মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরোধী।' রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বাংলাদেশে ভারতের মতো নির্বাচনমুখী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে খালেদা জিয়ার সহযোগিতা কামনার জবাবে নরেন্দ্র মোদির বক্তব্য বিএনপির প্রতি জামায়াত ছাড়ারই গুরুত্বপূর্ণ বার্তা।
একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে জয়লাভ করার মতো বিপুল জনসমর্থন থাকার পরও দলটির নেতৃত্ব কাঠামোর অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, মৌলবাদী ঝোঁক দলটিকে দারুণ ইমেজ সংকটে ফেলেছে। খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে এই ইমেজ সংকট কাটানোর মতো ক্যারিশমেটিক নেতৃত্ব এখন বিএনপিতে নেই। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুর পর দলটির অস্পষ্ট ভূমিকা ভাবমূর্তির সংকট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে তরুণ প্রজন্মের কাছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে-পরে গড়ে ওঠা দেশি-বিদেশি সমর্থক মহলের এবং সর্বশেষ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের অন্তর্নিহিত বার্তার শর্ত পূরণ করে হারানো ভাবমূর্তি উদ্ধারে দলটি সচেষ্ট হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। একদিকে নীতি-নির্ধারণী নেতৃত্ব সংকট, অন্যদিকে রাজাকার অপবাদের ভাবমূর্তি সংকট থেকে উদ্ধারের জন্যই দলের প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব ও সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে সসম্মানে দলে ফেরত আনার প্রক্রিয়া চলছে। এ ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য খবর বের হচ্ছে মিডিয়ায়। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীও তার বক্তব্যে ইতিবাচক কথাবার্তা বলছেন। তবে তিনি একটা বিষয়ে বারবার গুরুত্ব দিচ্ছেন, বিএনপিকে জিয়ার বিএনপিতে ফেরত যেতে হবে অর্থাৎ বিএনপি তার জন্মকালীন আদর্শ থেকে বিচ্যুত। কর্নেল (অব.) অলি আহমদের ব্যাপারে শোনা যাচ্ছে তিনিও 'স্বগৃহে' প্রত্যাবর্তন করছেন। দুই নেতা একা নন, দল-বল নিয়েই পুরনো দলে ফিরছেন বলে খবর মিডিয়ায় আসছে। এমনকি আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার সংস্কার প্রস্তাবের পক্ষে যারা ছিলেন, যারা এখনো দলে ফেরেননি বা ফেরার সুযোগ পাননি, সেই সংস্কাপন্থিরাও পুনরায় দলে ফিরছেন বা তাদের ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলেও খবর বেরুচ্ছে। দল ভাঙার খবরের সঙ্গে এসব খবর সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সরকারি চাপে বা অজ্ঞাত উৎস থেকে উপার্জিত বিপুল বিত্তবৈভব রক্ষার জন্য কেউ হয়তো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাধন্য একটা কিছু করার চেষ্টা করতে পারেন, কিন্তু তাতে সরকারের কোনো লাভ তারা করে দিতে পারবেন না। বি. চৌধুরী এবং কর্নেল (অব.) অলি আহমদদের স্বদলে প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনায় প্রগতিশীল, দেশপ্রেমিক, জাতীয়তাবাদী গণতন্ত্রীরা খুশি হলেও মৌলবাদের সমর্থকরা বিচলিত। এরই মধ্যে ২০-দলীয় জোটের প্যাডসর্বস্ব দু'একটি দল বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। অস্থিরতা বেড়েছে বিএনপিতে ওদের পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যেও। তবে খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান যদি সিদ্ধান্তে অটল থাকেন, এসব প্রতিক্রিয়ায় কোনো কাজ হবে না। এদের যোগদানে বিএনপি লাভবান হবে সন্দেহ নেই। অধ্যাপক বি. চৌধুরীর যে রাজনৈতিক অতীত এবং উত্তরাধিকার, মুক্তিযুদ্ধে কর্নেল (অব.) অলির যে গৌরবদীপ্ত ভূমিকা তা থেকে সর্বত্র এই গুরুত্বপূর্ণ বার্তাটি পৌঁছবে যে, বিএনপি আবার জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ বিএনপিতে ফেরত যাচ্ছে, প্রগতিশীল গণতন্ত্রী জাতীয়তাবাদের ধারায় ফিরছে। এতে নতুন প্রাণের স্পন্দন জাগবে দলটিতে। ফিরে আসবে অনেকে, নতুন যোগও দিতে পারে অনেকে। জামায়াত বর্জনে অর্জন হয়ে যেতে পারে অনেক বেশি।
এবং এটাও বলা যায়, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থার ঘোষিত-অঘোষিত বার্তা, সর্বোপরি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও প্রচ্ছন্নে যে বার্তা বিএনপিকে দিয়ে গেছেন, বিএনপি তা সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। বোঝা যায়, খালেদা জিয়ার এ ব্যাপারে অবস্থান সুচিন্তিত ও দৃঢ়। চিন্তা ও বিশ্বাসের সঙ্গে দলকে মিলিয়ে নিতে হলে যেসব শর্ত পূরণ জরুরি, তা তো দৃশ্যমান ও কার্যকর হতেই হবে। এখন দেখতে হবে, বি. চৌধুরী, কর্নেল (অব.) অলি আহমদরা দলে ফিরলে যে 'অথর্বদের' কপাল পুড়বে, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার যোগ্যতাহীন যারা সংসদ সদস্য পদে লড়ার খোয়াব দেখছেন, যে অযোগ্যরা দলে বড় বড় পদ দখল করে বসে আছেন তাদের সব প্রতিরোধ ও চক্রান্তকে প্রতিহত করে বেগম খালেদা জিয়া তার সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেন কিনা।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
ই-মেইল : [email protected]