আজকাল নারী ধর্ষণ, শিশু নির্যাতন আর সড়ক দুর্ঘটনা মহামারী আকার ধারণ করেছে। সড়ক সম্পর্কে আমার যে অভিজ্ঞতা তাতে মনে হয় অপ্রশিক্ষিত চালক, পুরনো ত্রুটিযুক্ত যানবাহন এবং একই রাস্তায় নানা গতির গাড়ির চলাচল দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। আমি এমনিতেই গরিব মানুষের মানুষ। খুব বেশি ন্যায়-অন্যায় দেখে নয়, সব কিছুতেই গরিবের পক্ষে দাঁড়ানো আমার স্বভাব। তারপরও মহাসড়কে সিএনজি, টমটম, নসিমন- এসব নিয়ন্ত্রণ বা নিষিদ্ধ করাকে সমর্থন না জানিয়ে পারি না। অনেক দিন পর নৈতিক সমর্থন জানাতে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী জনাব ওবায়দুল কাদেরকে ফোন করেছিলাম। ফোন পেয়ে ভদ্রলোকও খুশি হয়েছেন। সিএনজি এবং অন্যান্য গাড়িকে গ্যাস বা তেল নিতে কিছুটা সময় দেওয়া প্রয়োজন, তবে তা দীর্ঘ সময় নয়। এ ক'দিনেই দেখছি মহাসড়কে অনেক দুর্ঘটনা কমে গেছে। ছোট গাড়ি বুঝতে পারে না তাদের জন্য বড় গাড়ির কত অসুবিধা হয়। আর মহাসড়কের দুর্ঘটনায় ছোট গাড়ির যাত্রীই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হিসাব করে দেখেছি, এক কিলোমিটার ফোরলেন মহাসড়ক বানাতে যে টাকা খরচ হয় সেই টাকায় কম ক্ষমতার ২০-২৫ কিলোমিটার বাইলেন করা যেতে পারে। আশা করি সরকার এসব দিকে নজর দেবে।
মনুষ্যত্ব, মানবতা আর সভ্যতার দৌড়ে আমরা ছিলাম হাজার হাজার বছর সারা দুনিয়ার আগে। শৌর্য-বীর্য-শক্তি-সাহস- সর্বক্ষেত্রে আমাদের জয় ছিল চোখে পড়ার মতো। ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজির ১৭ ঘোড়সোয়ারের ঘোড়ার খুরের আঘাতে যেমন ভারতবর্ষ পদানত হয়েছে, তেমনি আবার সারা ভারত বিজয়ী মোগল সম্রাট আকবরের প্রধান সেনাপতি মানসিংহ বাংলার অহংকার বারো ভূইয়া মসনদ-ই-আলা ঈসা খাঁর কাছে পরাজিতও হয়েছে। দুনিয়ার কেউ ভাবতেও পারেনি ভেতু বাঙালির হাতে ওভাবে দুর্দান্ত পাঞ্জাবিরা মার খেয়ে পরাজিত হবে। অথচ তাই হয়েছে। সব সময় এমনই হয়। দুই দিন আগে আর পরে সত্যের কাছে মিথ্যার পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। আমাদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে এবং হবে।
গত ২৮ জানুয়ারি দোজখের অশান্তি থেকে দেশকে বাঁচাতে শুধু শান্তির দাবিতে মতিঝিলের কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের অফিসের সামনে ফুটপাতে বসেছিলাম। দাবি ছিল, 'বেগম খালেদা জিয়া অবরোধ প্রত্যাহার করুন, জননেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আলোচনায় বসুন'। একদিন, না দুই দিন কম ২০০ দিন ঘরে ফিরিনি। রোজার আগে তাঁবুতে রাস্তার পাশে, স্কুল মাঠে, মসজিদের বারান্দায় কাটিয়েছি। রোজায় লোকজনের বাড়ি বাড়ি, শেষের দিকে ২৫, ২৬, ২৭ রমজান ইতেকাফে মসজিদে ছিলাম। ঈদের পর ৩-৪ দিন টাঙ্গাইলে ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী সঙ্গে ছিল। তারপর আবার সখীপুর-বাসাইল ও অন্যান্য স্থানে। ১৯ তারিখ ছেলে-মেয়ে, পরিবার-পরিজন, দলীয় কর্মী নিয়ে টুঙ্গিপাড়া পিতার কবরে যাব ফাতেহা পাঠ করতে। গত ৮ এপ্রিল গিয়েছিলাম। আমি ছিলাম কবরের পাশে পিতার পায়ের কাছে। টুঙ্গিপাড়ায় গেলে সাধারণত সেখানেই থাকি। ছেলে-মেয়ে-বউ ছিল উপজেলা সদরে। ছেলে-মেয়েরা অত দূরে থাকায় কেমন যেন খালি খালি ফাঁকা ফাঁকা লেগেছে। যদিও সে যাত্রায় টুঙ্গিপাড়া যাওয়ার আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বা রেহানাকে কিছু বলে যাইনি। তবু টুঙ্গিপাড়ার বাড়ি যারা দেখাশোনা করে বৈকণ্ঠ, নির্মল, আক্কাছ, আলভী যথেষ্ট খাতির-যত্ন করেছে। বৈঠকখানা, খাবার ঘর খুলে দেওয়া, অজু-গোসলের জন্য বাথরুমের ব্যবস্থা সবই করেছে। জানি না, আর কদিন বাঁচব, আর কয়বার পিতার কবর জিয়ারত করতে টুঙ্গিপাড়া যেতে পারব। তাই ছেলে-মেয়ে, স্ত্রীকে নিয়ে যাচ্ছি। জানি আমি যখন থাকব না, ছেলে-মেয়েরা তখন হয়তো টুঙ্গিপাড়া আমার রাজনৈতিক পিতার কবর জিয়ারতে যাবে না। ওরা আমার জন্মদাতার কবর জিয়ারতেই তেমন একটা যায় না। বর্তমান জামানায় আবেগ-অনুভূতি কেমন যেন ভোঁতা হয়ে গেছে। অর্থ বা স্বার্থের জন্য হয়তো এখনো কারও চোখে পানি আসে। কিন্তু ভালোবাসার জন্য কারও চোখে তেমন একটা পানি দেখি না। পরিবারের সবাইকে নিয়ে যেতে চাই, যদি পিতার কবরে এই যাওয়াই শেষ যাওয়া হয়। গতবার ছেলে-মেয়েরা দূরে ছিল ভালো লাগেনি। তাই চিন্তা করেছি ওরাও যদি কাছে থাকতে পারে তাহলে কেমন হয়? গামছা বা চাদর ফেলে আমি যখন কবরের পাশে পড়ে থাকি, কর্মীরা তখন এখানে ওখানে থাকে। আমার অসুস্থ স্ত্রী এবং ছেলে-মেয়েরা হয়তো তা পারবে না। বিশেষ করে ছোটটা আমার বুকের ধন কলিজার টুকরো চোখের মণি কুশির অসুবিধা হবে। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ব্যক্তিগত পত্র দিয়েছি, পিতার কবরের পাশে তার বাড়িতে ওদের মা, ছেলে-মেয়ে নিয়ে এক রাত থাকতে পারবে কিনা? মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড কীভাবে চলে ভালোভাবে জানি না। ভাগিনা শাকিল, ভাগিনা কবির, ভাতিজা শেখর অনেকেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ওখানে আছে। কিন্তু তেমন যোগাযোগ নেই। সেদিন জনাব সাজ্জাদুল হাসান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ কে ফোন করেছিলাম। ১৯ আগস্ট পরিবার-পরিজন নিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় পিতার কবরে ফাতেহা পাঠ করতে যেতে চাই সে জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ব্যক্তিগত পত্র দেওয়া প্রয়োজন। কীভাবে দিতে পারি? ভদ্রলোক বললেন, 'আমার কাছে পাঠিয়ে দিন। আমি পৌঁছে দিব।' সঙ্গে এও বলেছি, আমার বড় মেয়ে কুঁড়ি ব্যারিস্টারি পড়তে ক'দিন পর লন্ডনে যাবে। ওর মা মেয়ে নিয়ে আপার সঙ্গে দেখা করতে চান। ভদ্রলোকের সঙ্গে সঙ্গে জবাব, 'স্যারকে জিজ্ঞাসা করে অবশ্যই জানাব।' সেটা ছিল বৃহস্পতিবার। আজ মঙ্গলবার। চিঠি দিয়েছি গতকাল। তাই ফলাফল জানি না। তবে জনাব সাজ্জাদুল হাসানের কথা ভালো লেগেছে। নির্বাসনে থাকতে মাঝে-মধ্যে ইন্দিরাজীকে ফোন করতাম আর. কে. ধাওয়ান ধরতেন। তিনি যেভাবে বলতেন অনেকটা সেভাবেই বললেন মনে হলো।
আগস্ট আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন বিপর্যয়ের মাস। গত পর্বে বেগম খালেদা জিয়াকে জাতীয় শোকের মধ্যে জন্মদিন পালন না করতে অনুরোধ করেছিলাম। আজবধি বুঝতে পারছি না তিনি কী করবেন বা করছেন। তাই আবারও অনুরোধ করছি, মাননীয় দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া দয়া করে শোকের দিনে জন্মদিন পালন করবেন না। শুধু আপনি নন, আপনার দলকেও বলুন তারাও যেন ওইদিন জন্মদিন পালনের চেষ্টা করে জাতীয় বিদ্বেষ আরও বৃদ্ধি না করে। আমাদের এখন বিদ্বেষ নয়, জাতীয় সম্প্রীতির প্রয়োজন। আশা করব, বেগম খালেদা জিয়া যদি যথার্থই দেশনেত্রী হন তাহলে সেই সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় তিনিই প্রথম উদ্যোগ নেবেন। জননেত্রী শেখ হাসিনা আমায় খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এক সময় মায়ের মতো যত্ন করেছেন। তার জন্য তিনি আমার কথা ফেলতেও পারেন। গভীর নৈকট্য কখনো কখনো মারাত্দক দূরত্ব সৃষ্টি করে। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তো আমার তেমন নৈকট্য নেই। তাই তিনি আমার কথা ফেলবেন কী করে? আশা নিয়ে বসে রইলাম, না ফেললে ভালো করবেন। বর্তমানে আমরা একটা জাতীয় দুর্যোগ অতিক্রম করছি। মানবিক মূল্যবোধ, দয়া-মায়া-ভালোবাসা সবকিছু থেকে কেমন যেন দূরে সরে যাচ্ছি। একে অপরকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসার বদলে মানুষের প্রতি নির্মমতা এক মহামারী আকার ধারণ করেছে। নারী নির্যাতন, শিশু হত্যা যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধ-বিগ্রহ ঝঞ্ঝা-বিক্ষোভে পৃথিবীর বহু দেশে বহু মানুষ মারা গেছে, আরও মারা যাবে। কিন্তু আমাদের মতো না। সারা দুনিয়ার সব থেকে নিরাপদ মাতৃগর্ভ। আমার দেশে সেই মাতৃগর্ভও আজ নিরাপদ নয়। নিশ্চয়ই পেটে বাচ্চা নিয়ে বহু মা এর আগে মরেছে, ভবিষ্যতেও মরবে। কিন্তু কোনো মা পেটের ভিতর গুলিবিদ্ধ বাচ্চা জন্ম দেননি। মাগুরার নাজমা বেগমকে আমার মনে হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দুর্ভাগা অথবা ভাগ্যবতী মা, যিনি গুলিবিদ্ধ সুরাইয়াকে জন্ম দিয়েছেন। যে সন্তান মায়ের পেটে গুলিবিদ্ধ হয়েও জীবিত আছে। সেদিন হাসপাতালে তাকে দেখতে গিয়ে মনে হয়েছে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য তাজমহল, আমি তারচেয়ে অনেক বড় আশ্চর্য দেখার ভাগ্য অর্জন করলাম। দিনটা ছিল ৭ আগস্ট। আগস্ট আমার নাড়িছেঁড়া দুর্ভাগ্যের মাস হলেও সকালেই আমার ভাতিজি ঝর্ণা সুখবর দিয়েছিল সে মা হতে চলেছে। সঠিকভাবে মেয়েদের মা হওয়া পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গৌরব। মা হওয়ার খবর শুনে আমি খুবই খুশি হয়েছিলাম। তারপর হাসপাতাল, হাসপাতাল থেকে জুমার নামাজ আদায় করতে বায়তুল মোকাররম। নামাজের অনেক আগে মসজিদে যাওয়ায় বায়তুল মোকাররমে ইমামের ঘরে ফ্লোরে বসেছিলাম। অনেক লোক আসা-যাওয়া করছিল, কথা বলছিল। বেশ কয়েকজন বসেছিল। কষ্ট হচ্ছিল তাই বলেছিলাম, কত কষ্ট করে দেশ স্বাধীন করেছি, সেই রক্ত দেওয়া দেশে মায়ের পেটেও আজ সন্তান নিরাপদ নয়। এক আওয়ামী লীগের কুলাঙ্গার সামনে বসেছিল। সে চট করে বলে উঠেছিল, 'অমন ঘটনা তো দু-একটা ঘটতেই পারে।' ঘৃণায় মন ভরে গিয়েছিল। তাকে বের করে দিয়েছিলাম। দলকানাদের যদি এমন মনোভাব হয় তাহলে তারা নির্ঘাত আমার প্রিয় বোনকে ধ্বংস করে ছাড়বে। তাই এবারের শুক্রবারটা ভালো যায়নি। সব সময় শনিবার আমার জন্য ভালো হয়। কিন্তু এবারের শনিবারও কেমন যেন বেদনায় বেদনায় কেটে গেল। ঘুম থেকে উঠেই বেগমের ফোন, 'জানো, শুভ্রাদি হাসপাতালে।' মানে ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতির স্ত্রী। তার খুবই শরীর খারাপ। তাই দিলি্ল ফোন করেছিলাম দু-তিনবার। একটু পরেই আবার ফোন, 'দীপের আব্বু, আয়েশা মারা গেছে।' (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)। শোকে সে কথা বলতে পারছিল না। গভীর রাতে বাবার মৃত্যু সংবাদ যেভাবে দিয়েছিল প্রায় অনেকটা সেভাবেই আয়েশার খবর দেয়। গিয়েছিলাম ছাতিহাটি আয়েশার জানাজায়।
আয়েশা এক অতি সাধারণ গ্রামের দরিদ্র মেয়ে। '৭২ সালে সে আমাদের ঢাকার বাসায় এসেছিল। '৭৫-এ বঙ্গবন্ধু যেদিন নির্মমভাবে নিহত হন সেদিনও সে আমার মোহাম্মদপুরের বাড়িতে ছিল। ওরপর ভারতে আমার লম্বা নির্বাসিত জীবন। সে সময় আয়েশা ছিল শুশুর সঙ্গে আবুধাবিতে। '৯০-এর ১৬ ডিসেম্বর আমি দেশে ফিরি। মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে দিন ভালোই কাটছিল। যাকে ঘিরে আমার জীবন সেই মা ২০০৪ সালে দুনিয়া ছেড়ে চলে যান। আমার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যায়। রাজরানীর মতো স্ত্রী, রাজপুত্র-রাজকন্যার মতো ছেলেমেয়ে থাকতেও দুনিয়ার সব আকর্ষণ কেমন যেন হারিয়ে ফেলি। চারদিকে কালো ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঠিক সেই সময় কুশিমনি আমাদের বুকে আসে। সব অন্ধকার কেটে গিয়ে জীবন আলোয় আলোয় ভরে ওঠে। তাকে ঘিরেই এখন আমাদের জীবন, আনন্দ-বেদনা, চাওয়া-পাওয়া। ওর হাসি-কান্নাই আমাদের হাসি-কান্না। সেই কুশিমনিকে লালন-পালন করার জন্য আবার আয়েশা আমাদের বাড়ি আসে। ছোট্ট কুশিকে সে বড় করে। কয়েক বছর পর আয়েশার গলায় এক টিউমার হয়। সে জন্য কিছু দিন গ্রামের বাড়ি থাকে। তারপর বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে তার অপারেশন হয়। অপারেশনের আগে বায়োফসিতে সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু অপারেশনের পর মস্ত টিউমারে দেখা যায় মারাত্দক ক্যান্সারের আলামত। তাই কেমোথেরাপির জন্য একদিন ঢাকা মেডিকেলে যাই। কাগজপত্র দেখে বিভাগীয় প্রধান বলেন, 'স্যার, আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই ক্যান্সার সব থেকে মারাত্দক। কেমো না দিলে ৪০ দিন, থেরাপি দিলে ১৫-২০ দিন এর মধ্যেই রোগী মারা যাবে।' প্রফেসর ভদ্রলোক নাকি ১৫-২০ বছর আগে আমায় ময়মনসিংহ মেডিকেলে দেখেছিলেন। বড় আন্তরিক ব্যবহার করেছিলেন। আয়েশার কথা শোনার পর চোখে পানি রাখতে পারিনি। আমার আবার খুব বেশি চোখে পানি আসে না। কিন্তু আয়েশা বাঁচবে না- শুনে বুকের ভিতর উথাল-পাতাল করছিল, চোখে পানি রাখতে পারছিলাম না। বুকের ভিতর হু হু করছিল। ওরপর যতবার নামাজে দাঁড়িয়েছি ততবার আপনা থেকেই আয়েশার জন্য আল্লাহর কাছে কান্না এসেছে, 'হে আল্লাহ, মাকে নিয়ে আমার জীবন অন্ধকার করে দিয়েছিলে। কুশিমনি এসে আমার সেই অন্ধকার জীবন আলোকিত করেছে। তাকে লালন-পালন করছে আয়েশা। সেই আয়েশাকে তোমার কি খুব দরকার? সারা দুনিয়ার সবাইকে নিলেও তো তোমার তিল পরিমাণ লাভ নেই, আর কাউকে না নিলেও তোমার কোনো ক্ষতি নেই। দয়াময় প্রভু কুশির জন্য তুমি কি আয়েশাকে কিছু সময় দিতে পার না?' উঠতে বসতে কান্না। মুখের কালি মা বুঝতেন, ভালোবাসলে স্ত্রীরাও বোঝে। আমার ব্যথার কথা নাসরীনকেও কখনো বলিনি। কান্না আমার থামেনি। আয়েশাকে সবকটি থেরাপি দেওয়া হলো। থেরাপি শেষে আড়াই-তিন মাসের জন্য বিশ্রাম। বিশ্রাম শেষে ভালো হয়ে হসপিটালে গেলে ডাক্তাররা তো অবাক। তাদের জীবনে এ ধরনের ক্যান্সারের রোগী বাঁচতে দেখেনি। আয়েশার স্বাস্থ্য আগের চেয়ে ভালো হয়। সারা দিন কুশির সঙ্গে থাকে। বছর ফুরিয়ে গেল তিনটি। আস্তে আস্তে কুশি বড় হয়ে ওঠে। তার মর্জি মেজাজে মাশাল্লাহ। আমরা ৩-৪ জনেও তাকে সামলাতে পারি না। আমাদের পদে পদে ভুল ধরে, শাসন করে। আয়েশাকেও করে, 'আপনি বুঝেন না। আপনি শুধু শুধু ভুল করেন। আপনার তো কোনো কিছুই মনে থাকে না। আপনাকে নিয়ে আর পারি না।' এমন হাজার অভিযোগ অনুযোগ। গত ৬-৭ মাস আয়েশা বাড়িতে ছিল। কয়েক মাস বেশ অসুস্থ। গত মাসে শুনলাম তার চলন শক্তি রহিত হয়ে গেছে। খেতে পারে না। যা খায় তাই বমি করে। আমার সঙ্গে থাকে এক ফরিদ প্রায় ৩৩ বছর। হা করলে হামিদপুর বোঝে। সে একদিন বলল, 'আয়েশা মৃত্যু শয্যায়। তার গলা থেকে পেট পর্যন্ত ক্যান্সারে সব নষ্ট হয়ে গেছে।' তাই দীপের মা একদিন কুশি-কুঁড়ি-দীপ ও আমাকে নিয়ে আয়েশাকে শেষ দেখা দেখতে গিয়েছিল। ছাতিহাটি বাবা-মার কবরের পাশে গাড়ি থেকে নেমেই দেখি আয়েশা, কী রে তুই এখানে? 'আপনারা আসছেন শুনে আসলাম। শরীর ভালো না, খেতে পারি না।' পরদিন ভর্তি করেছিলাম টাঙ্গাইল হাসপাতালে। হাসপাতালের লোকজন দারুণ যত্ন করেছে। এরপর নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেলে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায় তার গায়ে ক্যান্সারের লেশমাত্র নেই। মোটামুটি একটু ভালো হয়ে বাড়ি ফিরে। অপুষ্টিতে ভোগা দরিদ্র মানুষ। সেদিন তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়। জানাজায় দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, আল্লাহ আর আমায় কত দয়া করবেন। থেরাপি দিলে ১৫-২০ দিন, না দিলে ৪০ দিন। আমার কান্নায় সেই মানুষের তিন-সাড়ে তিন বছর বাঁচা- সে তো অনেক সময়। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, দোষে গুণে মানুষ। আল্লাহ যেন তাকে ক্ষমা করে বেহেশতবাসী করেন- আমিন।
লেখক : রাজনীতিক।