বাংলাদেশ কি অকাম্য পরিণতির দিকেই ধাবিত হচ্ছে? দেশে আইন-কানুন আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। ক্ষমতার দাপট ও অর্থবিত্তের জোরের কাছে মানবিকতা পরাজিত। সম্পূর্ণরূপে পরাভূত। আইনের শাসন নির্বাসিত। তাহলে গণতন্ত্রের অবশিষ্ট কি থাকল?
কয়েক দিন ধরে একের পর এক শিশু নির্যাতন ও হত্যার যে বীভৎস বিবরণ মিডিয়ায় আসছে, তাতে সামান্য বিবেকবান কোনো মানুষই স্বাভাবিক ও সুস্থ থাকতে পারে না। সিলেটের শিশু রাজন হত্যার ঘটনার পরপরই শুনলাম খুলনায় শিশু রাকিবের ওপর নির্যাতনের বীভৎস ঘটনা, যার পরিণতি ছিল মৃত্যু। এখানেই শেষ নয়, বরগুনায় নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছে ১০ বছরের রবিউল, রাজবাড়ীর ১৫ বছরের বালক মিজু শেখ। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, এই শিশুরা গরিব ঘরের সন্তান এবং শ্রমজীবী। যে বয়সে তাদের স্কুলে যাওয়ার কথা, বাবা-মায়ের আদরে বড় হওয়ার কথা, সেই বয়সে তারা পরিশ্রম করছে বাবা-মায়ের সংসারে দুটো পয়সা জোগান দেওয়ার জন্য এবং নিজের দুবেলা অন্ন সংস্থানের জন্য। দেশে-বিদেশে শিশুশ্রমকে নিন্দা করা হয়। তা নিয়ে সেমিনার-সিম্পোজিয়ামও কম হয় না। কিন্তু শিশুশ্রম অব্যাহতভাবে আছেই। উপরন্তু এই শিশুদের প্রতি যে অমানবিক আচরণ করা হয় তারই কিন্তু চিত্র পাওয়া গেছে রাজন-রাকিব-রবিউল-মিজুর মৃত্যু সংবাদের মধ্য দিয়ে। যে সমাজ এ গরিব শ্রমজীবী শিশুর প্রতি সহানুভূতি দেখাতে পারে না, সেই সমাজকে ঘৃণাভরে ধিক্কার জানাই।
হঠাৎ করে এত অমানবিক হয়ে গেল কেন আমাদের সমাজ? এর জন্যও দায়ী ক্ষমতাসীনদের গণতন্ত্রহীনতার রাজনীতি ও লুটপাটের অর্থনীতি। বেপরোয়া লুটপাট কেবল অর্থনীতিতেই উৎপাদনবিমুখ নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে না, একই সঙ্গে কুৎসিত কালচারেরও জন্ম দিচ্ছে। একটা ধারণা জন্মেছে যে, ক্ষমতার কাছাকাছি থাকলে অথবা টাকা খরচ করতে পারলে আইনকে গ্রাহ্য না করলেও চলবে। পুলিশ-প্রশাসনও পক্ষে থাকবে। রাজনকে যারা নির্যাতন করেছিল তারা নির্যাতনের দৃশ্য ছবিতে তুলে ফেসবুকে দিয়েছিল। এর মধ্যে এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দ আছে, যা মধ্যযুগীয় বর্বরতা অথবা উনবিংশ শতাব্দীর কলকাতার বাবু কালচারের বীভৎসতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য ফেসবুকে প্রচার করা হয়। প্রদর্শনবাদিতাও এ কালচারের অংশ। রাজন হত্যাকারীদের প্রধান আসামি ইতিমধ্যে পুলিশ ও প্রশাসনকে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে দেশত্যাগ করে সৌদি আরবে চলে যেতে সক্ষম হয়েছে। কিছু দিন আগের আরেকটি খবর ক্ষমতাসীনদের বিকৃত মানসিকতার পরিচয় তুলে ধরেছে। দামি গাড়ি হাঁকিয়ে যাওয়া এক সংসদ সদস্যের ছেলে বখতিয়ার রাস্তায় জ্যামে পড়ে। এ রকম জ্যামে পড়লে আমাদেরও বিরক্তির উদ্রেক হয়। কিন্তু তাই বলে আমাদের মতন সাধারণ মানুষ খুন করার কথা ভাবতে পারে না। কিন্তু ক্ষমতার কাছাকাছি থাকলে আমাদের দেশে তা ভাবা যায়। সংসদ সদস্যের ছেলে লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করে। তাতে নিহত হন রিকশাচালক আবদুল হাকিম ও জনকণ্ঠের সিএনজি অটোরিকশাচালক ইয়াকুব আলী। গণতন্ত্রহীন পরিবেশে আইনের শাসন না থাকার ফলে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা উদ্ধত যুবকের মনে এমন ড্যামকেয়ার মানসিকতা জন্ম নিয়েছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, 'যখন একটি রাষ্ট্র বা সমাজে আইনের শাসনের দুর্বলতা দেখা দেয়, তখন নানা ধরনের অমানবিক ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডও বৃদ্ধি পায়।' তিনি আরও বলেন, 'অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকসহ নানা ধরনের প্রভাব খাটিয়ে কিছু মানুষ অমানবিক ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে। তাদের ধারণা, এ প্রভাব কাজে লাগিয়ে তারা আইনের ঊর্ধ্বে অবস্থান করতে পারবে এবং বিচার তাদের স্পর্শ করতে পারবে না। এ থেকেই ঘটনাগুলো বার বার ঘটেছে।' (সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৮ আগস্ট)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেছেন, 'দেশে কি আইনের শাসন আছে? মানুষ যখন দেখবে অপরাধ করে পার পাওয়া যায় না, তখন অপরাধপ্রবণতা কমবে। কিন্তু দেশে সে পরিস্থিতি নেই।'
সরকার বিরোধী দলকে দমন করার জন্য নিজস্ব সংগঠনের যুবক মাস্তানদের ব্যবহার করেছে, যাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল পিস্তল। এসব নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় ছবিসহ অনেক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। আগের সরকারগুলোও করেছিল, বর্তমান সরকারও করছে। এটা যেন একটা রাষ্ট্রীয় কালচারে পরিণত হয়েছে। দলীয় মাস্তানরা পুলিশের সামনেই এবং পুলিশের আশ্রয়েই এ ধরনের অপরাধ করে থাকে। তাহলে কেন ক্ষমতার কাছাকাছি কিছু লোকের এ ধারণা জন্মাবে না যে, তারা আইনের ঊর্ধ্বে। ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা বিগত বিএনপি আমলেও ছিল, এ আমলেও আছে। ক্রসফায়ারের জন্য যাদের ব্যবহার করা হয়, সেই র্যাব ও পুলিশ, তারা তো একপর্যায়ে আপেক্ষিক স্বাধীনতা ভোগ করবেই। র্যাবের মধ্যে যে সব অসৎ সদস্যরা যে একপর্যায়ে ভাড়াটে খুনিতে পরিণত হতে পারে, তা-ও তো জানা গেল নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর। যে দলীয় ক্যাডারদের নির্বাচনে ভোট কেন্দ্র দখলের কাজে ব্যবহার করা হয়, তারা তো ওই পর্যন্ত গিয়েই থামবে না, তারা আরও কিছু দখল করতে চাইবে- সম্পত্তি দখল, জমি দখল, টেন্ডার বাক্স দখল ও নারী দখল।
এ দখলি মনোবৃত্তি ও মাস্তানি কালচার যে পরিণামে শাসকদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে তা বোধ হয় এখনো আমাদের শাসকদের বোধোদয় হয়নি। তবে অচিরেই হবে। যারা রাষ্ট্রীয় মদদে আইন ভাঙতে শিখছে, তারা সমাজে কেবল নৈরাজ্যই তৈরি করবে, যা কোনো শাসক দলের জন্য কখনই সুখকর হতে পারে না। এরা নিজেরা নিজেরা মারামারি-খুনাখুনি করছে, আরও করবে। সম্প্রতি মাগুরায় শাসক দলের এক অঙ্গ সংগঠন- যুবলীগের দুই দল তরুণের মধ্যকার দ্বন্দ্ব সশস্ত্র সংঘর্ষে রূপ নিয়েছিল, যার পরিণতিতে এক গর্ভবতী মা ও তার পেটের সন্তানও গুলিবিদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের এক প্রতিবেদনে (৯ আগস্ট, প্রথম পৃষ্ঠায়) বলা হয়েছে, 'নিরাপত্তাহীনতার পরিস্থিতি এমনই যে, পৃথিবীর আলো দেখবার আগেই ঘাতকের বুলেটে জীবন সংশয় হয়ে পড়েছে নবজাতকেরও।' আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য সংরক্ষণ কেন্দ্র থেকে পাওয়া খবরে জানা গেছে, ২০০৯-১৪ (ডিসেম্বর) পর্যন্ত ছয় বছরে শাসক দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত হয়েছেন ১৭২ জন। এসব কিছুর মিলিত ফল হলো আইনের শাসনের অনুপস্থিতি। যে কারণে তৈরি হচ্ছে দুর্বলের ওপর সবলের নির্যাতনের সামাজিক ভিত্তি। গরিব শিশু নির্যাতনকে এ প্রেক্ষাপটেই দেখতে হবে।
সমাজে আরও যেসব দুর্বল জনগোষ্ঠী আছে, তারাও নানাভাবে অত্যাচারিত ও বঞ্চিত হচ্ছে। বিশেষ করে আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। সম্প্রতি হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদ সংবাদ সম্মেলন ডেকে অভিযোগ করেছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের সম্পত্তি দখল করছেন বা দখলের চেষ্টা করছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও প্রশাসনের লোকজন। এদের মধ্যে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যও আছেন। তারা কিছু তথ্য-প্রমাণও তুলে ধরেছেন। আমরা জানি যে, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদ আওয়ামী লীগ ও তার সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল। তবু কেন এ অভিযোগ? এমন অভিযোগও নতুন নয়। জমি হাতছাড়া হওয়া ও সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে হিন্দুধর্মাবলম্বী নাগরিকরা যে ক্রমাগত দেশত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন, এটাও কোনো অজানা তথ্য নয়। আওয়ামী লীগ-বিএনপি-এরশাদ সব আমলেই এ দেশত্যাগের ধারা অব্যাহত ছিল ও আছে। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারকাত এক সমীক্ষায় দেখিয়েছেন, যারা হিন্দু সম্পত্তি দখল করছে তার ৬০ শতাংশ আওয়ামী লীগের এবং ৪০ শতাংশ বিএনপির প্রভাবশালী ব্যক্তি। আওয়ামী লীগ মনে করে হিন্দু নাগরিকরা তাদের রিজার্ভ ভোট। তবে তারা দেশত্যাগ করলেও আপত্তি নেই। কারণ সে ক্ষেত্রে তাদের বাড়ি-ঘর, জমি সহজে দখল করা যাবে। দেশে থাকলে ভোট নিশ্চিত, দেশত্যাগ করলে জমি দখল সহজতর।
এ সবই হচ্ছে আইনের শাসনের অনুপস্থিতির কারণে। ফলে সমাজের দুর্বল জনগোষ্ঠী, সংখ্যালঘু অথবা গরিব শিশু সবলের আঘাতে জর্জরিত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেক মহাবিপদ। মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের একের পর এক মানুষ খুন- ব্লগার হত্যা। গত ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত খুন হয়েছেন চারজন। প্রকাশ্য দিবালোকে। হয় জনবহুল রাস্তায় অথবা বাড়ির ভিতরে। অভিজিৎ, ওয়াশিকুর বাবু, অনন্ত ও সর্বশেষ নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের পুলিশ খুবই দক্ষ। তবু কেন এসব খুনের হদিস বের করতে পারছে না, তা ভাবতে অবাক লাগে। অভিজিৎকে চাপাতি দিয়ে খুন করার সময় পুলিশের গাড়ি পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। তার স্ত্রীর চিৎকারেও তারা সাড়া দেয়নি। ওয়াশিকুর বাবুকে হত্যা করে পালিয়ে যাওয়ার সময় দুই খুনিকে হাতেনাতে ধরে পুলিশে সোপর্দ করেছিলেন কয়েকজন সাহসী ব্যক্তি, যাদের আমরা সাধারণত তৃতীয় লিঙ্গের বলে তুচ্ছজ্ঞান করি। খুনি ধরা পড়ার পরও পুলিশ কেন রহস্য ভেদ করতে পারছে না, তা বোধগম্য নয়। সব কটি খুনের কায়দা এক, মোটিভও এক। এরা যে মৌলবাদী সন্ত্রাসী গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত তাও অজানা নয়। তবে কেন পুলিশ ব্যর্থ হচ্ছে আসামিদের গ্রেফতার করে বিচারের ব্যবস্থা করতে।
মৌলবাদী সন্ত্রাস যদি আরও বিস্তার লাভ করে, যদি পাকিস্তানের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাহলে তো বাংলাদেশ ভঙ্গুর (fragile) রাষ্ট্র বলেই বিশ্বে চিহ্নিত হবে। যতই মধ্য আয়ের দেশ হোক, আইনের শাসনের এই নিদারুণ করুণ অবস্থা বর্তমান থাকলে অর্থনৈতিক উন্নয়নও ব্যর্থ হতে বাধ্য। সব দিক দিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির হঠাৎ অবনতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ প্রতিদিনের ৯ আগস্টের সংখ্যায় প্রথম পৃষ্ঠার শীর্ষ প্রতিবেদনে যথার্থই বলা হয়েছে, 'এ অবস্থায় জীবনের নিরাপত্তায় পুলিশি সহায়তা চেয়েও মিলছে না। নিরাশ সাধারণ মানুষ রীতিমতো উদ্বেগজনক সময়ের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।' সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরা কি সামান্য নিরাপত্তা, একটু সুবিচার ও আইনের শাসন দাবি ও প্রত্যাশা করতে পারি না?
লেখক : রাজনীতিক