প্রতি বছর যখন আমাদের জীবনে আগস্ট মাস আসে তখন জাতির জনকের স্মৃতি আমাকে আন্দোলিত করে। হৃদয়ের গভীরে নিবিড়ভাবে দোলা দেয় ঐতিহাসিক সংগ্রামী ছবিগুলো। প্রতিদিন প্রত্যুষে বাড়ির দেয়ালে শোভিত বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছবিগুলো দর্শনের মধ্য দিয়ে দিনের কাজ আরম্ভ করি। কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার প্রাক্কালে স্মৃতিমধুর ছবিগুলো দেখে যাই। বঙ্গবন্ধু আমার জীবনে চলার পথের প্রেরণা। যে স্নেহ-ভালোবাসা-আদর আমি বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পেয়েছি তাতে আমার জীবন ধন্য। পরিচয় হওয়ার পর থেকেই পরমাদরে বঙ্গবন্ধু আমায় কাছে টেনে নিয়েছেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পরম মমতায় নিজের কাছেই রেখেছেন। বিশেষ করে '৬৯-এ গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা যখন বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্ত করে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সংবর্ধনা দিয়ে কৃতজ্ঞ জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করেছিলাম, সেই দিন থেকে শেষদিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিলাম।
'৬৯-এর পর থেকে বঙ্গবন্ধু যত রাজনৈতিক সফর করেছেন আমি তার সফরসঙ্গী হয়েছি। মনে পড়ে '৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনের আগে ভোলাসহ দেশের উপকূলীয় অঞ্চল ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়েছিল। লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে বঙ্গবন্ধু ছুটে গিয়েছিলেন। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখে সেদিন বঙ্গবন্ধু ভেঙে পড়েছিলেন। অশ্রুসজল চোখে সেদিন বলেছিলেন, 'আমাকে এখান থেকে নিয়ে চল। আমি আর পারি না।' ভোলা থেকে ফিরে আজকে যেটা বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় তখন ছিল শাহবাগ হোটেল, সেখানে প্রায় দুই শতাধিক সাংবাদিকের উপস্থিতিতে দৃঢ়প্রত্যয়ে বলেছিলেন, 'প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড় প্রাকৃতিক দুর্যোগে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়, আর আমরা এভাবে মরতে চাই না। আমরা বাঙালিরা বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা হতে চাই।'
এরপর আসে '৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচন। এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু আমাকে মাত্র ২৭ বছর বয়সে জাতীয় পরিষদে মনোনয়ন দিয়ে নির্বাচিত করেন। উপকূলীয় অঞ্চলে দুর্যোগের কারণে পিছিয়ে দেওয়া সময় অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৭ জানুয়ারি '৭১-এ, আর সারা দেশে ৭ ডিসেম্বর '৭০-এ। এই পুরো সময়টা সারা বাংলায় ছিল নির্বাচনী উৎসব। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সেদিন ভোটাধিকার প্রয়োগে বাঙালি জাতি উৎসবে মেতেছিল। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকার আনাচে-কানাচে সফর করেছিলেন। আমি ছিলাম বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী। বাস-ট্রেন-স্টিমারে একসঙ্গে গিয়েছি, একই কামরায় থেকেছি। প্রতিটি জনসভায় বঙ্গবন্ধুর আগে বক্তৃতা করেছি। এক জনসভায় বক্তৃতা করে আরেক জনসভায় ছুটেছি। জনসভার শৃঙ্খলা, মঞ্চ-ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ের দেখাশোনা ও স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছি। পরে বঙ্গবন্ধু এসেছেন, বক্তৃতা করেছেন। একদিনে ৮-১০টি করে জনসভা, পথসভা। দিন শেষে সন্ধ্যা নামলে চারদিক অন্ধকার; এর মধ্যে লোকজন লণ্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে থাকত শুধু বঙ্গবন্ধুকে একনজর দেখবে বলে। মনে পড়ে কুড়িগ্রাম গিয়েছি। রাস্তা নেই, পুল নেই, গাড়ি নেই, কিছুই নেই। এমনকি বহু জায়গায় পায়ে চলার পথও নেই। খেতের আইল দিয়ে হাঁটাপথ। কোথাও পায়ে হেঁটে, কোথাও বা গরুর গাড়িতে। নাগেশ্বরী, রৌমারী, চিলমারী, ভুরুঙ্গামারী, বুড়িমারীসহ কুড়িগ্রামের প্রতিটি থানায় তিনি জনসভা করেছেন। আমরা পায়ে হেঁটে আর বঙ্গবন্ধু গরুর গাড়িতে। স্বচক্ষে দেখেছি লাখো মানুষের জনস্রোত। মানুষকে জিজ্ঞাসা করেছি কোথায় যাচ্ছেন? দৃপ্তকণ্ঠে মানুষজন উত্তর দিয়েছে 'কেন মিটিংয়ে যাচ্ছি!' আবার প্রশ্ন করেছি, কার মিটিংয়ে? আওয়ামী লীগের? ততোধিক বলিষ্ঠ উত্তর 'নাহ্'। তবে কার মিটিংয়ে যাচ্ছেন? 'মুজিবরের মিটিংয়ে যাচ্ছি, শেখ মুজিবের মিটিংয়ে যাচ্ছি।' বাংলার মানুষের হিমালয়সমান আস্থা আর বিশ্বাস ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতি। বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু দুটো কথা বলতেন। এক. 'ভায়েরা আমার, আমি যদি আপনাদের জন্য আমার জীবনের যৌবন পাকিস্তানের কারাগারে কাটাতে পারি, আমি যদি ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারি- আমি কী আপনাদের কাছে একটি ভোট চাইতে পারি না।' এই দুই কথায় মানুষের চোখের পানি পড়ত এবং দুই হাত তুলে সমস্বরে বলত, 'হ্যাঁ, আপনি আমাদের কাছে ভোট চাইতে পারেন।' '৭০-এর নির্বাচনে বাংলার মানুষ প্রতিশ্রুতি রেখেছিল। বঙ্গবন্ধু মুজিবকে ভোট দিয়েছিল। নির্বাচনের দিনেও আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলাম। নির্বাচনের সম্ভাব্য ফলাফল সম্পর্কে বিদেশি সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, 'আপনার প্রত্যাশা কী, কয়টি আসনে জয়ী হবেন?' বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'আমি বিস্মিত হব, যদি আমি দুটো আসনে পরাজিত হই।' ১৬৯টি আসনের মধ্যে তিনি ১৬৭টি আসনে বিজয়ী হয়েছিলেন। মাত্র দুটি আসনে তিনি পরাজিত হয়েছিলেন। একটি ময়মনসিংহের নান্দাইল নূরুল আমিনের এবং অপরটি পার্বত্য চট্টগ্রাম রাজা ত্রিদিব রায়ের নির্বাচনী এলাকা। ময়মনসিংহের নান্দাইলে আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গিয়েছিলাম। বিশাল জনসভা। মানুষের মনোভাব তিনি হৃদয়ের গভীরতা দিয়ে উপলব্ধি করতেন। সেদিন বক্তৃতা শেষে গাড়িতে উঠেই বলেছিলেন, 'এই আসন পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। লোকজন এসেছে শুধু আমাকে দেখতে।' বঙ্গবন্ধু যখন আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে গিয়েছিলেন তখন বঙ্গবন্ধুকে নূরুল আমিন সমর্থন দিয়েছিলেন। গোলটেবিল বৈঠক থেকে ফিরে বঙ্গবন্ধু আমাদের বলেছিলেন, 'দুইজন আমাকে সমর্থন করেছিল। একজন প্রফেসর মুজাফফর আহমেদ এবং অপরজন নূরুল আমিন।' বঙ্গবন্ধুকে যে রাজনীতির কবি বলা হয়, তা সর্বাংশে সত্যি। তিনি আসলেই 'রাজনীতির কবি' ছিলেন। মানুষের মনোভাব তথা জনসাধারণের নাড়ির স্পন্দন তিনি বুঝতেন।
আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি জাতীয় সংসদের সাবেক ডেপুটি স্পিকার কর্নেল শওকত আলী সাহেবের কাছে শুনেছি, ক্যান্টনমেন্টে যখন বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচার শুরু হয়, সেদিন আরও যারা সেই মামলার আসামি ছিলেন তাদের সঙ্গে প্রিজন ভ্যানে উঠে তিনি বলেছিলেন, 'আমার সঙ্গে কণ্ঠ মিলাও।' এই বলে তিনি প্রিয় মাতৃভূমির উদ্দেশে গাইলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সেই বিখ্যাত গান, 'ধন ধান্য পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা, তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা...।' পরবর্তীতে দেশ স্বাধীনের পর তিনি এই গানটিকে 'জাতীয় গীত' হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। শওকত সাহেব বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, 'মুজিব ভাই, আমাদের তো ফাঁসি হবে, আপনি কী করেন।' তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'ঘাবড়াবার কিছু নেই। ওরা আমাদের ফাঁসি দেওয়ার মতো ক্ষমতা রাখে না। এই মামলা আমরা মোকাবিলা করব। আমাদের বিচার শুরু হবে। দেশের মানুষ এই বিচারের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আন্দোলন করবে। ছাত্র-জনতা জেগে উঠবে। সেই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা মুক্তিলাভ করব। মুক্তিলাভের পর দেশে একটা নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচনে আমরা বিজয়ী হব। কিন্তু বিজয়ের পর ওরা আমাদের ক্ষমতা দেবে না। ক্ষমতা না দিয়ে ওরা আমাদের উপর গণহত্যা চালাবে। তখন বাংলার মানুষ সর্বব্যাপী মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে।' সেই কবে '৬৯-এ কারাগারে যাওয়ার প্রাক্কালে তিনি যে কথা বলেছিলেন, পরবর্তীতে বাস্তবে তাই-ই ঘটেছিল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ষড়যন্ত্র করে প্রহসনের বিচার করে তাকে ফাঁসিতে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু আমরা জাগ্রত ছাত্রসমাজ গণআন্দোলন-গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করে তাকে কারাগার থেকে মুক্ত করেছি। '৭০-এর নির্বাচনে তিনি বিজয়ী হয়েছেন কিন্তু পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। গণহত্যার নীলনকশা 'অপারেশন সার্চলাইট' অনুযায়ী বাঙালি নিধনে মত্ত হয়েছিল। যে কারণে পাকিস্তানের সমাধি রচনা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন'।
অসাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী বঙ্গবন্ধু ছিলেন দূরদর্শী নেতা। '৭১-এ অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে যখন বঙ্গভবনে ভুট্টোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দেখা হয়, তখন তিনি ভুট্টোকে বলেছিলেন, 'মিস্টার ভুট্টো, পাকিস্তান আর্মি ষড়যন্ত্র করছে ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে। তুমি পাকিস্তান আর্মিকে বিশ্বাস করো না। ওরা প্রথমে আমাকে হত্যা করবে, পরে তোমাকে।' ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা হত্যা করতে পারেনি। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপথগামী উচ্ছৃঙ্খল কর্মকর্তা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভবিষ্যদ্বাণী সত্যে পরিণত হয়েছিল। এরপর ঠিকই পাকিস্তান আর্মির জেনারেল জিয়াউল হক ভুট্টোকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করেছে।
'৭১-এ অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে এয়ার ভাইস মার্শাল আসগর খান এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। আসগর খান বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, 'এরপর কী হবে?' বঙ্গবন্ধু উত্তরে বলেছিলেন, 'এরপর ইয়াহিয়া খান আসবে। ইয়াহিয়া খানকে অনুসরণ করবে এমএম আহম্মদ এবং প্লানিং কমিশনের একটা টিম আসবে। সেই টিমে জেনারেল হামিদ, জেনারেল মিঠ্ঠা এবং অন্য জেনারেলরা থাকবে। সঙ্গে ভুট্টো আসবে। তারপরে একদিন আমার সঙ্গে আলোচনা শুরু করে হঠাৎ বাঙালিদের উপর আক্রমণ চালাবে। আর সেদিনই পাকিস্তানের সমাধি রচিত হবে।' রাজনৈতিক পরিস্থিতির কী নিখুঁত বিশ্লেষণ! পরবর্তী ঘটনাগুলো অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে!
মনে পড়ে মুজিববাহিনীর অন্যতম কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে ১৮ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে আসি। ২২ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকার দেশে প্রত্যাবর্তন করে। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং ১৪ জানুয়ারি আমাকে মাত্র ২৯ বছর বয়সে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তার রাজনৈতিক সচিব হিসেবে নিয়োগ দেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার প্রথম বিদেশ সফর ছিল ৬ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিম বাংলায়। কলকাতায় স্মরণকালের সর্ববৃহৎ সেই জনসভায় ২০ লক্ষাধিক মানুষের উদ্দেশে বক্তৃতার শেষে কৃতজ্ঞচিত্তে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'রিক্ত আমি নিঃস্ব আমি দেবার কিছু নাই, আছে শুধু ভালোবাসা দিয়ে গেলাম তাই।' এরপর রাজভবনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক হয়। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সেই বৈঠকে উপস্থিত থাকার। কাছে থেকে দেখেছি গভীর আন্তরিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে স্বাক্ষরিত হয়েছিল ২৫ বছর মেয়াদি ঐতিহাসিক 'বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি'। আলোচনা বৈঠকের শেষে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমার জন্মদিনে আপনাকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।' আন্তরিকভাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। বঙ্গবন্ধু পুনরায় অনুরোধ করে বললেন, 'মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার সফরের আগেই আমি চাই ভারতের সেনাবাহিনী আপনি ফিরিয়ে আনুন।' ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, 'আপনি যা চাইবেন আমি তাই-ই করব।' ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কথা রেখেছিলেন। তিনি '৭২-এর ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে স্বাধীন বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন এবং প্রতিশ্রুতি মোতাবেক একই বছরের ১২ মার্চ বিদায়ী কুচকাওয়াজের মধ্য দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতের সেনাবাহিনী ফিরিয়ে নিয়েছিলেন।
স্বাধীনতার পরপর অল্প সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণ ও দক্ষ কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় ১১৬টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। সুচারুরূপে দেশ পরিচালনায় দলীয় ঐক্য এবং জাতীয় ঐক্য নিশ্চিত করতে বঙ্গবন্ধু ছিলেন বদ্ধপরিকর। সে জন্য সমমনা দলগুলোকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যের লক্ষ্যে তিনি গঠন করেছিলেন ত্রিদলীয় ঐক্যজোট। '৭৪-এর ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলে দলীয় নীতি-আদর্শ সমুন্নত রাখতে দলের নেতা-কর্মীদের জনসম্পৃক্ততা বজায় রাখতে সবার উদ্দেশে কর্তব্য-কর্ম নির্দেশ করে বলেছিলেন, 'আত্দসমালোচনা, আত্দসংযম ও আত্দশুদ্ধি চাই।' 'রাষ্ট্রের চারটি আদর্শ- গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র এবং একই সঙ্গে দলের চারটি আদর্শ- নেতৃত্ব, মেনিফ্যাস্টো, নিঃস্বার্থ কর্মী ও সংগঠন' সমুন্নত রাখতে বলেছিলেন, 'দল শক্তিশালী করতে দল থেকে আবর্জনা দূর করতে হবে।' 'সামনে এগোতে হলে স্বচ্ছ-পরিষ্কার পন্থা অবলম্বন করতে হবে।'
বঙ্গবন্ধু যখন প্রধানমন্ত্রী আমি অত্যন্ত কাছ থেকে নিবিড়ভাবে দেখেছি তার সমগ্র চিন্তাই ছিল দেশ ও দেশের মানুষ। '৭১-এ ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি বলেছিলেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' তিনি আমাদের স্বাধীন দেশ, জাতীয় পতাকা, গণতান্ত্রিক সংবিধান ও নির্বাচিত সার্বভৌম সংসদ দিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশ গঠনে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। অর্থনৈতিক মুক্তির কাজ শুরু করেছিলেন। স্বাধীনতার পর দেশে কিছুই ছিল না। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ। গোলাঘরে চাল ছিল না। ব্যাংকে টাকা ছিল না। বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না। রাস্তা-ঘাট ধ্বংস করে দিয়েছিল পাকবাহিনী। ব্রিজ-কালভার্ট উড়িয়ে দিয়েছিল বোমা মেরে। ভৈরব ব্রিজ, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ধ্বংসপ্রাপ্ত। রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়েছিল। একটা প্লেন ছিল না, রেল ছিল না, বাস ছিল না, ট্রাক ছিল না, স্টিমার ছিল না। পুরো যোগাযোগ ব্যবস্থা তছনছ করে দিয়েছিল। অর্থনীতি ছিল পুরোপুরি ধ্বংসপ্রায়। মাত্র ৩ বছর ৭ মাস উদয়াস্ত পরিশ্রম করে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশটাকে আমরা স্বাভাবিক করেছিলাম। ভৈরব ব্রিজ, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ যেদিন উদ্বোধন করা হয় সেদিন আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলাম। '৭৪-এ বাংলাদেশে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল সেটা ছিল মানুষের তৈরি। খাদ্যশস্য থাকা সত্ত্বেও বন্যার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত থাকায় আমরা মানুষের কাছে খাদ্যদ্রব্য সঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারিনি। এ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি মোতাবেক ২ লাখ টন খাদ্যসামগ্রী মাঝপথ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল। এতসব কিছুর পরও বঙ্গবন্ধু দেশটাকে স্বাভাবিক করেছিলেন। যেদিন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়, সেদিন গোলাঘরে চাল, ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রা আছে এবং দেশে স্বাভাবিকতা বিরাজ করছে।
নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু ছিলেন ইস্পাতকঠিন। তার সংকল্পবোধ ছিল দৃঢ়। সুদৃঢ় সংকল্পবোধ নিয়েই তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ গঠনে অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে খুনিচক্র তাকে দেশের অভ্যন্তরে সপরিবারে হত্যা করেছিল। জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করেই খুনিচক্র ক্ষান্ত হয়নি। একই বছরের ৩ নভেম্বর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যারা নেতৃত্ব দিতেন বা বার বার নেতৃত্ব দিয়েছেন দলের এবং সরকারের ঐতিহাসিক মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, কামরুজ্জামান সাহেব আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্য তাদের কারাভ্যন্তরে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডের আসল উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্বশূন্যতা তৈরি করা। কিন্তু ঘাতকচক্রের ধ্বংসাত্দক ষাড়যন্ত্রিক প্রয়াসকে আমরা সফল হতে দেইনি। বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে ধারণ করেই ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়েছি। চরম প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে সাংগঠনিক তৎপরতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করে মূল দলসহ সহযোগী সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করে নিজদের ভেদাভেদ ভুলে কেবল দলকেই ধ্যান-জ্ঞান করে, দলীয় ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতে আওয়ামী লীগের পতাকা তুলে দিয়েছি। সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে সাফল্যের সঙ্গে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে আজ তিনি জাতিকে প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
আজকে ভাবতে ভালো লাগে বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত নীতি অনুযায়ী দেশ এগিয়ে যাচ্ছে তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। অতীতে ৭ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশে মানুষের খাদ্যাভাব ছিল, আজ ১৬ কোটি মানুষের দেশে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। একসময় দেশে বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না, আজ ২৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। রেমিটেন্স ছিল না, আজকে ১৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি আমাদের রেমিটেন্স। এঙ্পোর্ট ছিল মাত্র ৩০০ মিলিয়ন ডলার, আজ তা ৩১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। শুরুতে বাজেট ছিল মাত্র ৭৮৭ কোটি টাকা আজ তা ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এখন আন্তর্জাতিক বিশ্ব বাংলাদেশ সম্পর্কে বলে 'বিস্ময়কর উত্থান বাংলাদেশের'। মাল্টিন্যাশনাল ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকস্ ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, 'পরবর্তীকালে যে ১১টি দেশ অর্থনৈতিকভাবে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ তার অন্যতম।' আরেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান জেপি মরগ্যান, 'বাংলাদেশ উদীয়মান দ্রুতগতির অর্থনীতি' বলে অভিহিত করেছে। ইতিমধ্যে আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০তম বর্ষপূর্তিতে আমরা বাংলাদেশকে মধ্য-আয়ের দেশে উন্নীত করতে সক্ষম হব। বঙ্গবন্ধুর যেমন দুটি লক্ষ্য ছিল- এক. দেশ স্বাধীন করা এবং দুই. অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করা। তিনি গর্ব করে বলতেন, 'আমার বাংলা রূপসী বাংলা, আমার বাংলা সোনার বাংলা।' তিনি বলতেন, 'ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলব আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ।' একইভাবে ২০০৮-এর নির্বাচনের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু কন্যাও বাংলাদেশের মানুষের জন্য দুটি লক্ষ্য স্থির করেছেন- এক. ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা এবং দুই. বাংলাদেশকে মধ্য-আয়ের দেশে রূপান্তরিত করা। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আর স্বপ্ন নয়। ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে মোবাইল ও তথ্য-প্রযুক্তির সেবায় দেশের মানুষ ইতিমধ্যে তার সুফল ভোগ করতে শুরু করেছে। অপরদিকে বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মতে, বাংলাদেশ নিম্ন মধ্য-আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে এবং ২০২১-এ আমরা পরিপূর্ণভাবে মধ্য-আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পথে রয়েছি। বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন, আজ তার কন্যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেই পথেই এগিয়ে চলেছে এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তব রূপলাভ করতে চলেছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে পরিচালিত হয়ে বাংলাদেশ আগামীতে উন্নত দেশে রূপান্তরিত হবে এবং সমগ্র বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।
লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, বাণিজ্যমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।