১৯৭১ সালে পরাজিত হওয়ার পর থেকেই তা পুনরুদ্ধারে গত ৪৩ বছর ধরে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির বিরুদ্ধে বাঙালি পরিবারে জন্ম নিয়েও সশস্ত্র বিরোধিতা আজও শেষ হয়নি। নাশকতামূলক তৎপরতায় 'সিদ্ধহস্ত' হিসেবে খ্যাতরা তাদের পুরো শ্রম, নিষ্ঠা, একাগ্রতা ব্যয় করছে মূলত সেই উপনিবেশ রাজ্য 'পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারে'। ধর্মকে বর্ম করে তারা তাদের লক্ষ্য সম্প্রসারিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তথাপি দীর্ঘ সময় ধরে যত তৎপরতাই চালিয়েছে, তা একটা জায়গায় এসে মুখ থুবড়ে পড়েছে। কিন্তু থেমে নেই। ইতিমধ্যে শীর্ষ নেতারা যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারে প্রমাণিত। ফাঁসি, কারাদণ্ড, আমৃত্যু কারাদণ্ডের আওতায় নেতারা। ফাঁসি হয়েছে একজনের। আর অপরজনের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে নব্বইঊর্ধ্ব বয়সে কারাদণ্ড নিয়ে। তিনিই সব কর্ম-অপকর্মের হোতা হিসেবে অভিহিত।
তিনি সদ্য প্রয়াত গোলাম আযম। জামায়াতের আমিরও ছিলেন। জীবনভর যত প্রচেষ্টাই নিয়েছেন, ব্যুমেরাং হয়ে তা ফিরে ফিরে এসেছে। আর এসব প্রচেষ্টার কোনোটাই ছিল না গণমুখী। বরং জনগণের বিরুদ্ধে হানাদার শাসকদের বক্ষপুষ্ট হয়েও থেকেছেন। দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে সহিংস অবস্থানের কারণে নিজ দেশের নাগরিকত্ব হারাতে হয়েছে। পালাতে হয়েছে দেশ ছেড়ে। বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্বের পাসপোর্ট নিয়ে জন্মভূমিতে ফিরে এলেও মামলা করে শাসকশ্রেণির 'তল্পিবাহক' হিসেবে নাগরিকত্ব পেলেও রাজনৈতিক অঙ্গনে নিরাপদে ঘোরাফেরা করতে পারেননি। বরং তাকে কেন্দ্র করেই যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রাসঙ্গিকতা সামনে এসে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী প্রথম শীর্ষ ১০ জনের তিনি একজন। শুধু তাই নয়, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তিনি পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারে বাকি জীবন সচেষ্ট থেকেছেন। স্বীয় অপরাধের জন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ বা ক্ষমা প্রার্থনা করেননি। '৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সক্রিয় সহযোগী হিসেবে তিনি সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিলেন।
জামায়াতে ইসলামীর 'পূর্ব পাকিস্তান' শাখার আমির গোলাম আযম যুদ্ধ চলাকালে ঢাকা ছেড়ে পাকিস্তান চলে যান একাত্তরের ২২ নভেম্বর আরও জামায়াত নেতাসহ। পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সমর্থনে প্রথমে বাংলাদেশবিরোধী রাজনীতিকদের সমন্বয়ে শান্তি কমিটি, পরে রাজনৈতিক কর্মী সমন্বয়ে সশস্ত্র রাজাকার বাহিনী এবং জামায়াত ও তাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মী ও ক্যাডার সমন্বয়ে আলবদর বাহিনী গঠন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধবিরোধী তৎপরতাকে সর্বাত্মক করার জন্যই জামায়াতে ইসলামী হানাদার বাহিনীর সহযোগিতায় এসব গড়ে তোলে। আলবদর ছিল জামায়াতের তৈরি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। শিক্ষিত জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রসংঘ কর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত সশস্ত্র সংগঠনটির উদ্দেশ্য ছিল, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধরত বাঙালি জনগোষ্ঠীকে পাকিস্তানি জীবনদর্শনে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা। হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশে বদর বাহিনী সর্বাত্মকভাবে জামায়াতে ইসলামীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হতো। 'বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ঠাণ্ডা মাথায়' বদর বাহিনীর নৃশংসতা যুদ্ধের শেষ পাঁচটি মাস জনমনে ভয়াবহ আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল। হানাদারকবলিত দেশের প্রতিটি জেলা ও মহকুমা শহরেই এদের নিজস্ব 'ঘাঁটি' বা 'ক্যাম্প' ছিল। এসব ক্যাম্পে ধরে আনা স্বাধীনতাকামীদের ক্রমাগত নির্যাতনের মধ্য দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হতো। বদর বাহিনী সার্বিকভাবে গোলাম আযমের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হতো। এর প্রকাশ্য নেতা ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী।
১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর গোলাম আযম, মওলানা আবদুর রহিম ও এ কে এম ইউসুফ- এই তিন জামায়াত তথা বদর রাজাকার ও শান্তি কমিটি নেতা পাকিস্তান চলে যান। সেখানে বসে তারা পাকিস্তান জামায়াত নেতাদের সঙ্গে সলাপরামর্শ করেন। গোলাম আযম ১৯৭১-এর ১ ডিসেম্বর ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিত শ্রেণিকে হত্যা করার জন্য বদর বাহিনী ও রাজাকারের ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিলেন, এমনটা পরে প্রচারিত হয়। তা ছাড়া ১৬ ডিসেম্বর 'পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ'-এর বৈঠক ডাকার প্রসঙ্গটিও আলোচনা হয়েছে বলে পরবর্তীকালে প্রকাশিত হয়। গোলাম আযমসহ স্বাধীনতাবিরোধী দলগুলো আওয়ামী লীগের আসন শূন্য করিয়ে সেখানে ৮৮টি আসন ভাগাভাগি করে নেয় ভোট ছাড়াই। ততদিনে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে। পাকিস্তান হামলা চালায় ভারতে। ভারতও পাল্টা আক্রমণ করে। দু'দেশের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায়। ১৬ ডিসেম্বর হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের চূড়ান্ত পতন ঘটে এবং আত্মসমর্পণ করে হানাদার বাহিনী। কিন্তু রাজাকার আলবদর ও শান্তি কমিটি এবং আলশামস সদস্যরা পালিয়ে যায়। পলাতকদের অনেককে পরে ধরা হয়। বিচারের সম্মুখীনও করা হয়। তবে শীর্ষ পর্যায়ের যারা ছিল, তারা আত্মগোপন করে।
পরাজয় মেনে নিতে না পারা জামায়াত নেতা, শান্তি কমিটির নেতা গোলাম আযম ১৯৭২-এর ১৫ জানুয়ারি লাহোরে গঠন করেন 'পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি'। গোলাম আযমের নেতৃত্বে সপ্তাহব্যাপী পাকিস্তানের বাঙালি ও বিহারি অধ্যুষিত স্থানে মিছিল, সমাবেশসহ অন্যান্য কর্মসূচি পালন করা হয়। ভুট্টো তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। তারও লক্ষ্য একই। ভুট্টোর অর্থায়নে গোলাম আযম পাকিস্তানে এ কর্মসূচি পালন করেন। এরপর মুসলিম দেশগুলোর সমর্থনলাভে ও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণার জন্য সফর শুরু করেন পাকিস্তানি নাগরিক হিসেবেই, পাকিস্তানি পাসপোর্টে। তবে তার গঠিত তথাকথিত পুনরুদ্ধার কমিটি পাকিস্তানে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা অব্যাহত রাখে। পাকিস্তান সরকার যাতে কোনোভাবেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়, সে জন্য জামায়াতের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে গোলাম আযম প্রস্তাব পাস করান। এরপর '৭২ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশবিরোধী তার পরিকল্পিত আন্দোলনকে ব্যাপকতা দান ও সফল করার জন্য পাকিস্তান গোয়েন্দা বাহিনীর সহায়তায় দেশত্যাগ করেন।
সৌদি আরবে বসে গোলাম আযম ফন্দি ও পরিকল্পনা অাঁটতে থাকেন। সৌদি সরকারকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন, বাংলাদেশ ভারতের অঙ্গরাজ্য। সেখানে ইসলাম ধর্ম বিনষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থায় 'পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারে' সৌদি সহায়তা পেতে সক্ষম হন। তার প্ররোচনায় সৌদি আরব বাংলাদেশ থেকে কোনো হজযাত্রী যেতে দেয়নি ১৯৭২-৭৩ সালে। ১৯৭৪ সালে ওআইসি সম্মেলনে শেখ মুজিব সৌদি বাদশাহকে চাপ দেওয়ার পর হজযাত্রী যাতায়াত শুরু হয়। গোলাম আযম পূর্ব পাকিস্তানে ইসলামপন্থিদের ঐক্যবদ্ধ করে পাকিস্তানের সঙ্গে প্রথমে কনফেডারেশন গঠন ও ইসলামী রাষ্ট্র গোষণার আশ্বাস দেন। সেই সঙ্গে শেখ মুজিব সরকারকে উৎখাতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা নেওয়ার প্রস্তাবও রেখেছিলেন। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে রিয়াদে অনুষ্ঠিত 'বিশ্ব ইসলামী যুব সংস্থা' আয়োজিত আন্তর্জাতিক ইসলামি যুব সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে গোলাম আযম স্পষ্টভাবেই বলেছেন, 'হিন্দুস্থান দখল করে নিয়েছে পূর্ব পাকিস্তান। সেখানে মুসলমানদের হত্যা ও নির্যাতন করা হচ্ছে। মসজিদগুলো মন্দিরে রূপান্তরিত করা হচ্ছে।'
এমন ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টিকারী মিথ্যাচারে বশীভূত করে বিশ্ব মুসলিম যুবকদের সাহায্য দাবি করেন এগিয়ে আসার ও সহায়তা করার। এই প্রক্রিয়ায় বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেন পরবর্তীকালেও। তবে সংগৃহীত অর্থের বিরাট অংশ আত্মসাতেরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। যদিও এর অংশবিশেষ তিনি বাংলাদেশে পাঠিয়েছেন জামায়াত পুনর্গঠনে। ১৯৭৩ সালের মার্চে গোলাম আযম সৌদি আরব হতে লিবিয়া যান। বেনগাজিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে হাজির হন। মুসলিম দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের কাছে ধরনা দেন এবং বাংলাদেশ যে ভারতীয়দের দখলে অঙ্গরাজ্য এবং ইসলাম বিপন্ন, মসজিদগুলো মন্দির হয়ে গেছে- ইত্যাকার মিথ্যা ও বানোয়াট বিষয় ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলে ধরে 'পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার' ও সেখানকার মুসলিমদের উদ্ধারে সহায়তা চান। গোলাম আযম বাংলাদেশে তার অনুসারীরা সংঘবদ্ধ হচ্ছে বলে তাদের জানিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে গোলাম আযম লিবিয়ায় যান। ত্রিপলিতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইসলামী সম্মেলনে যোগ দিয়ে তিনি বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্য রেখে ভাষা ও ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদের তীব্র সমালোচনা করে মুসলিম জাতীয়তাবাদের ব্যাখ্যা দেন।
এই বক্তব্যের ক'মাস আগে ১৯৭৩ সালের ২২ এপ্রিল গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিল করে বাংলাদেশ সরকার। এরপর তিনি লন্ডনে চলে যান। 'পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারের' নামে সংগৃহীত অর্থে লন্ডনে বাড়ি কিনে বসবাস শুরু করেন পাকিস্তানি নাগরিক হিসেবেই। লন্ডনে স্থাপন করেন পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি'র সদর দফতর। লন্ডনের ম্যানচেস্টারে ফেডারেশন অব স্টুডেন্টস ইসলামিক সোসাইটি গঠন করান। এবং বার্ষিক সম্মেলনে বাংলাদেশে ইসলাম ধর্ম পালন করা যায় না বলে নানা বানোয়াট যুক্তি-তথ্য দিয়ে সম্মোহিত করেন। সম্মেলনে 'পূর্ব পকিস্তান পুনরুদ্ধারে' অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর সন্ত্রাসবাদী দল নেতাদের সঙ্গেও গোলাম আযম মতবিনিময় চালাতেন। লন্ডনে তিনি বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা অব্যাহত রাখতে বিভিন্ন সমাবেশে অংশ নিতে থাকেন। ১৯৭৩ সালের আগস্টে ব্রিটিশ ইসলামিক মিশনের লোটারে অনুষ্ঠিত বার্ষিক সম্মেলনে বাংলাদেশবিরোধী মনোভাব উসকে দেন। ইসলামি আন্দোলন করার কারণে তার নাগরিকত্ব বাতিল হয়েছে বলে সহমর্মিতা লাভ করেন। আর আর্থিক সহায়তা পেতে থাকেন।
'পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারে' তহবিল সংগ্রহে গোলাম আযম সমাবেশে যোগ দিতে থাকেন। এরপর আমেরিকা যান ১৯৭৩ সালের ৩১ হতে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে মুসলিম স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকা অ্যান্ড কানাডা আয়োজিত একাদশ বার্ষিক কনভেনশনে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখার সুযোগ নিয়ে তার দেশকে পুনরুদ্ধারে সবার সহায়তা চান। টানা তিন সপ্তাহ ধরে গোলাম আযম যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ইসলামী কেন্দ্র ও সংস্থায় ঘুরে ঘুরে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য মুসলিম দেশগুলোর প্রতি আবেদন জানান এবং দেশটি উদ্ধারে আর্থিক সহায়তা চান। বিশাল অঙ্কের তহবিল সংগ্রহ করেন গোলাম আযম।
১৯৭৩ সাল থেকে শুরু করে বেশ কয়েকবার গোলাম আযম সৌদি বাদশাহ ফয়সল বিন আজিজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। 'ভারতীয় আগ্রাসন এবং আধিপত্যের কবল থেকে বাংলাদেশের মুসলবানদের হেফাজতে রাখার' ব্যাপারে তিনি বাদশাহর সাহায্য কামনা করেছিলেন। 'বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ জনগণের ওপর ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতা চাপিয়ে দেওয়ার কোনো ষড়যন্ত্র যাতে সফল হতে না পারে সে বিষয়ে তার প্রভাব কাজে লাগানোর' অনুরোধও জানিয়েছিলেন। ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, গোটা মুসলিম জাহান থেকে ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন বাংলাদেশ। সে দেশটির তিন দিকে ভারত এবং অপরদিকে বঙ্গোপসাগর এবং পাশে কোনো মুসলিম রাষ্ট্র নেই। সেই দেশের ইসলামপ্রিয় জনতার স্বার্থে সৌদি আরবসহ গোটা মুসলিম বিশ্বের বাংলাদেশের বিষয়ে একটি অবস্থানে শামিল হওয়া উচিত। ১৯৭৪ সালের এপ্রিলে গোলাম আযম মক্কায় রাবেতায়ে আলম ইসলামির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ইসলামি সংগঠনসমূহের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পাকিস্তানি নাগরিক হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। এখানেও তিনি জামায়াত পুনর্গঠনে বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানি বিহারিদের সহায়তাকারী রাবেতার সহায়তা চান। সে সময় প্রচার হয় যে, মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে বিধ্বস্ত মসজিদ পুনর্গঠনের দাবি জানিয়ে গোলাম আযম ৪৫ লাখ রিয়াল সংগ্রহ করেন। এ টাকার একটি অংশ দিয়ে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারের বাড়ি কেনেন। যেখানে তার পুত্ররা বসবাস করে আসছেন এখনো। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর গোলাম আযম তার রূপরেখা বাস্তবায়নে বাংলাদেশে আসার তৎপরতা চালান। মোশতাকের কাছে জামায়াতীরা ধরনা দিলেও গোলাম আযমকে দেশে ফিরে আসতে দিতে রাজি হয়নি। এরপর সামরিক জান্তা শাসক জিয়ার কাছে আবেদন জানালেও জিয়া আপত্তি করেন শুরুতে। তখন গোলাম আযম তার নাগরিকত্ব ফেরতসহ বাংলাদেশে প্রবেশাধিকার দাবি করেন। ১৯৭৬ সালের এপ্রিলে গোলাম আযম লন্ডনে অনুষ্ঠিত ইসলামিক কাউন্সিল অব ইউরোপ আয়োজিত ইসলামি সম্মেলনে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের জন্য বাংলাদেশকে চাপ দিতে বলেন। ডিসেম্বরে সৌদি আরবে ইবনে সউদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামি আইন সম্মেলনে যোগ দিয়ে বাংলাদেশের মুসলমানদের ভারতের হাত থেকে রক্ষার জন্য মুসলিম বিশ্বের সহায়তা কামনা করে লিফলেট বিতরণ করেন।
গোলাম আযম ১৯৭৭ সালের জুলাইয়ে মক্কার কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক ইসলামি শিক্ষা সম্মেলনে যোগ দিয়ে বাংলাদেশে ইসলামি শিক্ষার পথ রুদ্ধ বলে বানোয়াট বর্ণনা দিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসারে বাংলাদেশকে চাপ দিতে ও মাদ্রাসাগুলোকে আর্থিক সহায়তাদানের আবেদন জানান। জুলাই মাসে ইস্তাম্বুলে ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ফেডারেশন অব স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশনস আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অতিথি বক্তা হয়ে ইসলামি আন্দোলনের নামে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা চালাতে থাকেন। লন্ডনে গোলাম আযম 'ডকুমেন্টেশন সেন্টার' নামে বাংলাদেশবিরোধী প্রচার ও 'পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারের' পক্ষে সমর্থনের লক্ষ্যে স্থাপন করেন। বিদেশি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত বাংলাদেশবিরোধী খবরের কাটিং একসঙ্গে করে ছাপিয়ে বের করাই ছিল এ প্রতিষ্ঠানের কাজ। এসব কাটিংসমৃদ্ধ কাগজপত্র বাংলাদেশের বিভিন্ন বার লাইব্রেরিতে পাঠানো হতো।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রশ্নে গোলাম আযম ও তার দল জামায়াতে ইসলামী কেবল বিরোধী অবস্থানই নেয়নি, একে সমূলে নস্যাতের জন্য দলটি সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায় এবং হত্যা, ধর্ষণ লুটপাটের পথ বেছে নেয়। দেশ, জাতি ও জনগণের বিরুদ্ধে গোলাম আযম ও জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই। তাই এ দলটি মানবতাবিরোধী অপরাধ যুদ্ধাপরাধে জড়িত। দেশ ও জাতির বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়ে এখনো সন্ত্রাস, ফন্দিপনা, হত্যা ইত্যাদির পথ বেছে নিয়েছে। আর এসব পথে দলটিকে ঠেলে দিয়েছেন গোলাম আযম, যার মৃত্যুর পর 'পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার প্রসঙ্গ' ভেস্তে গেছে। গোলাম আযম ১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে পাকিস্তানি পাসপোর্টে ঢাকা আসেন। এরপর থেকে জামায়াত পুনর্গঠনসহ সাজাপ্রাপ্ত হয়ে জেলে থাকার পূর্ব পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের স্বপ্ন দেখা শুধু নয়, কাজও করেছেন। তাই তার মৃত্যুতে পাকিস্তানে গায়েবানা জানাজা ও শোক প্রকাশের আধিক্য দেখা যায়। গোলাম আযম ১৯৮০ সালে দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, 'বিদেশে অবস্থানকালে যেখানেই গিয়েছি সেখানে আমি বাংলাদেশে ইসলামকে কোনো শক্তি দাবিয়ে রাখতে পারবে না এবং এখানকার মুসলমানরা ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু বরদাশত করতে রাজি হবে না বলে মুসলিম বিশ্বকে নিশ্চয়তা দিয়েছি। তবে যাতে সংবিধান থেকে সেক্যুলারিজম প্রত্যাহার করা হয় এবং ইসলামের কাজ করতে যেসব বাধা আছে তা দূর করা হয় সে উদ্দেশ্যে মুসলিম জাহান ও ইসলামি আন্দোলনের নেতাদের কাছে তদানীন্তন বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের আবেদন জানিয়েছি।' প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক একজন পাকিস্তানি নাগরিক যিনি ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর ঢাকা থেকে পলায়ন করে পাকিস্তান চলে যান, তিনি কী করে একটি স্বাধীন দেশ সম্পর্কে মতামত রাখেন? বাংলাদেশ বিরোধিতা আমৃত্যু করে গেছেন পাকিস্তানি চেতনাকারী গোলাম আযম। তার মৃত্যুর পর 'পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার' কমিটি ভেস্তে যে গেছে সেটা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক