'৭৫-এর ১৫ আগস্ট শুক্রবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে নির্মমভাবে নিহত হন। '৭১-এর ১৬ আগস্ট পাকিস্তান হানাদারদের গুলিতে দারুণভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলাম। বাঁচার তেমন আশাই ছিল না। কেন দয়াময় আল্লাহ বাঁচিয়ে রেখেছেন তা তিনিই জানেন। গতকাল গিয়েছিলাম ধানমন্ডির বাড়িতে। পায়ে পায়ে কত স্মৃতি, কত আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না। বাড়ির এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতে মনে হচ্ছিল কোথায় ৪০ বছর? এ যেন এই সেদিন মাঝরাতে এসেছিলাম। পিতার সঙ্গে শেষ কথা, শেষ দেখা হয়েছিল। সেদিন আর এদিন কত তফাৎ! আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ৪০ বছর বয়সে নবী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। তার ওপর আল্লাহর ওহি নাজিল হয়েছিল। আশায় আছি আমাদের অমানিশার অন্ধকার ঘোচে কিনা। আমরা আবার আলোর দিশা পাই কিনা। দয়াময় আল্লাহ যেন নেতা, পিতা, বন্ধু, ভাই হিসেবে তাকে বেহেশতবাসী করেন। আগামীকাল ১৯ আগস্ট পিতার কবরে সপরিবারে ফাতেহা পাঠ করতে যাব। পিতৃহত্যার প্রতিবাদে ঢাকায় কয়েক দিন আত্মগোপনে থেকে '৭৫-এর ১৯ আগস্ট প্রতিরোধে বেরিয়ে পড়েছিলাম। তাই ৪০ বছর পর সেই ১৯ আগস্ট নেতা, পিতার কবরে ফাতেহা পাঠ করতে যাচ্ছি।
জাতীয় শোকের দিনে এবার কী করে যে সখীপুরে ছিলাম। এর আগে কত জায়গায় থেকেছি। কিন্তু ১৫ আগস্ট কখনো সখীপুরে থাকিনি। বছরের পর বছর সারা দিন না খেয়ে থেকেছি, ২৮ বছর মাংস মুখে দিইনি। শুধু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর কারণে আমার বিয়ে পিছিয়েছিল ১০ বছর। সেই ১৫ আগস্ট এলে কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাই। এত বছর পরও কেমন যেন নিজেকে সামাল দিতে পারি না। ভক্ত-অনুরক্তরা আলোচনা, মিলাদ মাহফিলের মধ্য দিয়ে প্রতি বছর শোকাহত ১৫ আগস্ট পালন করে। এবার তাদের সঙ্গে শোক দিবস পালন করে বেশ তৃপ্তি পেয়েছি। দলীয় নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের সাড়া ছিল অসাধারণ। যদিও দেশে এখন অন্যের জন্য তেমন শোক-তাপ নেই, মায়া-মমতা-ভালোবাসা নেই। মা-বাবাকেও আজকাল স্বার্থের জন্য ছেলেমেয়েরা হত্যা করে। বাবা-মা মারা গেলে অনেক ব্যস্ত ছেলেমেয়েরা তাদের শেষ দেখা দেখার সময় পায় না। এরকম অবস্থায় কে কার জন্য শোক করবে? সবাই আছে নিজেকে নিয়ে। '৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর লাশ যখন ধানমন্ডির বাড়িতে পড়েছিল তখন কাঁদার লোক ছিল না, বরং দাঁত কেলিয়ে হাসার লোক ছিল অনেক বেশি। মোশতাক ভাই-ই তো আমাদের আসল নেতা বলে দাঁত কেলিয়ে হেসেছেন। সেদিনের হাসার লোকেরা এখনো যখন তার কন্যার প্রধানমন্ত্রীর সময়েও ঠিক সেই ১৫ আগস্টের মতো হাসে তখন বড় কষ্ট হয়, হৃদয় চৌচির হয়ে যায়। তেলের মাথায় তেল সবাই দেয়, সব সময়ই দেবে। তেল মর্দন শিখিনি বলে হাতে-পায়ে তেল দিই না সেও প্রায় ৫০ বছর। হাতে-পায়ে তেল দিলে হঠাৎ সে তেল কারও গায়ে লাগে এই ভয়ে গায়ে পায়ে চুলে তেল দেওয়া বন্ধ করেছি। তাতেও তেলের কারবার মোটেই কমেনি। ইদানীং নব্য আওয়ামী লীগাররা কী যে করে, জগতের সব কল্পনাকেও তারা হার মানিয়েছে। লাখ লাখ কোটি কোটি টাকা তুলে পিতার মৃত্যুদিনে কাঙালি ভোজ করে। ভাবখানা যেন এমন বঙ্গবন্ধু মরেও তাদের রুটি-রুজির পথ করে গেছেন। আর কিছু বিরোধী রাজনীতিক যারা তার জীবদ্দশায় হাড্ডি মাংস জ্বালিয়ে পুড়িয়ে একাকার করেছে তাদের কথাবার্তা শুনে পিত্তি জ্বলে যায়। শুনেছি বিধর্মীরা মুসলমান হলে নাকি বেশি বেশি গরু খায়। যারা একসময় প্রকৃত আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী হত্যা করে যজ্ঞ করেছে তারা এখন নব্য আওয়ামী লীগার। এমন দল শোকের দিনে পিতার প্রতিকৃতিতে ফুলমালা দিতেও গোলাগুলি করে মানুষ মারে! কী যে অশান্তিতে আছি কাউকে বুঝাতে পারি না। অন্ধ পাগলের মতো বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে কীভাবে যে দিনগুলো পার করে দিলাম ভাবতেও অবাক লাগে। ৪০টা বছর দেখতে দেখতে কেটে গেল দেশের কোনো কাজেই লাগলাম না। একসময় বঙ্গবন্ধুকে সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থ করতে মতিয়া চৌধুরী, হাসানুল হক ইনু, শাজাহান খান, মঈনুদ্দিন খান বাদল, কর্নেল তাহের বীরউত্তমের ভাই ওয়ারেসাত হাসান বেলাল যারা ইন্ডিয়ান হাইকমিশনে আক্রমণ করেছিল কতজনের নাম বলব, আরও যারা আদাজল খেয়ে লেগেছিল তাদের আজকাল সে কী প্রতাপ! অথচ পিতৃহত্যার প্রতিবাদে যারা জীবন বাজি রেখেছিল তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম শামসুদ্দিন মোল্লা, রওশন আলী এমপি, আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক আনোয়ার হোসেন, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, গৌর, বৈদ্য, গিয়াস। নাসিম, সুলতান, নড়াইলের জিন্নাহ, সিলেটের শাহ আজিজ এমপি, জলিল, মান্নান, ফারুক। ফারুককে তো আওয়ামী খুনিরা হত্যাই করেছে। ক'জনের কথা বলব? সাভারের মাহবুব, ফিরোজ, গাইবান্ধার কবির, সুজা, বারহাট্টার রহমান মাস্টার, দুর্গাপুরের আ. হক, কলমাকান্দার আজাদ খালেক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তুলশী, ঢাকার রেন্টু, সেন্টু, চট্টগ্রামের মৌলভী সৈয়দ, সুকুমার, জিতেন, তমছের, হালিম, দুলাল, আবদুল্লাহ বীরপ্রতীক, বগুড়ার খসরু, গিরানী, ফজলু বীরপ্রতীক, হায়দার, সাঈদ, বদি, একরাম, বিশ্বজিৎ নন্দী আরও কতজন। এর মধ্যে যারা পরপারে চলে গেছে তারা তো বেঁচেছে। কিন্তু যারা বেঁচে আছে তাদের বিড়ম্বনার শেষ নেই। জানি আজ যারা ক্ষমতার আলোয় ঝলমল করছে ক্ষমতা চলে গেলে অন্ধকারে তাদের মুখও দেখা যাবে না। তবু খারাপ লাগে দেশের এই ভয়াবহ পরিণতির জন্য যারা দায়ী রাজনৈতিকভাবে তাদের কোনো বিচার হলো না। বরং চাটুকারী করে এখনো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার একটা বিরাট জায়গা দখল করে আছে। আর সেই দখলকাজে যেভাবেই হোক জাতির পিতার কন্যার সহযোগিতা পাচ্ছে। এসব দেখে খারাপ না লেগে পারে না। বঙ্গবন্ধু আজীবন যে গণতন্ত্রের জন্য, মানুষের সম্মান আর মর্যাদার জন্য সংগ্রাম করেছেন সেই গণতন্ত্র এবং মানুষের মর্যাদা আজ ধুলায় লুণ্ঠিত। তাই কী করে পিতার আত্মা শান্তি পাবে ভেবে পাই না।
কতবার বেগম খালেদা জিয়াকে অনুরোধ করেছি জাতির শোকের দিনে দয়া করে জন্মদিন পালন করবেন না। দলীয় নেতা-কর্মীদেরও পালন করতে দেবেন না। কিন্তু না, তিনি এবারও ঘটা করে জন্মদিন পালন করেছেন। আল্লাহ জানেন, তার এই জন্মদিন পালনে জাতির কতটা কী লাভ হবে। গত সংখ্যায় লিখেছিলাম 'দেশনেত্রী খালেদা জিয়া'। আর হয়তো তাকে দেশনেত্রী লিখতে কলম চলবে না। নিশ্চয়ই বেগম খালেদা জিয়া বিএনপি নেত্রী, একদল মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। বিএনপি নেত্রী আর দেশনেত্রী এক কথা নয়। দলীয় নেতা-কর্মীর ইচ্ছা-অনিচ্ছাই ১৬ কোটি মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা নয়। বিএনপির নেত্রী হতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সমর্থন বিশ্বাস আস্থাই যথেষ্ট। কিন্তু দেশনেত্রী হতে বিএনপির বাইরেও সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে, মানুষকে জানতে হবে। তার কাছে শত্রুর জীবনও নিরাপদ। বিচার-আচারে বিরোধীরাও ন্যায় প্রত্যাশা করতে পারে। যতক্ষণ দেশবাসী অমন আস্থা পাবে না, ততক্ষণ তিনি দেশনেত্রী নন। শুনলাম জাতীয় শোকের দিনে তার জন্মদিন পালন করা থেকে ধীরে ধীরে বিরত হবেন বা সরে আসবেন। একবারে সিদ্ধান্ত নিলে অসুবিধা হতে পারে। তার উপদেষ্টা যখন আজম তখন এমন সিদ্ধান্ত নিতে দোষ কী? কিন্তু আগামী মহারণে তার এই রণকৌশল আদৌ কোনো কাজ দেবে কিনা ভবিতব্যই জানে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকেও পরিপূর্ণ জাতীয় নেতা বলা যায় না। তার মধ্যেও প্রচুর দলীয় সংকীর্ণতা আছে। কয়েক মাস আগে সীমান্ত এলাকায় গিয়েছিলাম। '৭৫-এর প্রতিরোধ সংগ্রামীরা বড় বেদনায় বলেছে, 'বাসে আগুনে পোড়াদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কত দান ধ্যান করলেন। আমরা যারা '৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিরোধে সর্বস্বান্ত হলাম। আমাদের কোনো খোঁজখবর নিলেন না, এটা কেমন মানবতা?' এই তো সেদিন ১৫ আগস্ট গেল, একবার তো ফোন করতে পারতেন। মরে গেছি না বেঁচে আছি জানার চেষ্টা করলে কী এমন আসমান ভেঙে পড়ত? পিতৃহত্যার প্রতিশোধে ১০৪ জন শহীদ, ৫০০ জনের ওপর আহত হয়েছিল, তাদের তো খোঁজ নিতে পারতেন। কিন্তু সবাই হিংসায় কেমন যেন অন্ধ হয়ে গেছে। পক্ষে না থাকলে কেউ কারও নয়, মানবিক দিকটাও দেখতে চায় না, সামান্য সৌজন্যও দেখায় না। সভ্যতা-ভব্যতায় এক সময়ের শ্রেষ্ঠ জাতি কেমন যেন ভালোবাসার অভাবের রোগে ভুগছে। এত দৈন্য নিয়ে কোনো জাতি বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। আগে ব্রিটেনের পার্লামেন্টে আমাদের মাত্র একজন বাঙালি রুশনারা আলী ছিল। এবার ববির বোন, রেহানার মেয়ে টিউলিপসহ তিনজন নির্বাচিত হয়ে আমাদের বাঙালি জাতির মুখ সূর্যের মতো উজ্জ্বল করেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি ব্রিটেনের পার্লামেন্টের সদস্য। এতে আমাদের মাথা বিশ্ব দরবারে হিমালয়ের মতো উঁচু হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে যখন রাজনের মতো শিশু নির্যাতিত হয়ে নিহত হয় বা মারা যায়, মাগুরায় নাজমার পেটে গুলিবিদ্ধ সুরাইয়া যখন জন্ম নেয় তখন পৃথিবীর নিরাপদ মাতৃগর্ভ নিয়ে কি ব্রিটেনের সভ্য সমাজে টিউলিপকে জবাবদিহি করতে হয় না? তাতে কি তার উঁচু মাথা নিচু হয় না? আমরা এমন কৃতঘ্ন জাতি, যারা বিশ্ব দরবারে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করল আমরা তাদের আলোকিত উজ্জ্বল মুখ বিবর্ণ কালো করলাম, উঁচু মাথা নিচু করলাম?
স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে কাল টুঙ্গিপাড়া যাব। যেদিন আমি থাকব না, সেদিন আমার পরিবারের কেউ যে টুঙ্গিপাড়া যাবে জোর দিয়ে বলতে পারি না। কারণ পৃথিবী এখন পাল্লা দিয়ে নির্মমতার দিকে যাচ্ছে, অধঃগতির দিকে যাচ্ছে। ভালোবাসা কৃতজ্ঞতার বড়ই অভাব। আমি যখন রাস্তাঘাটে ঘুরি তখন দেখি কিছু মানুষ এত ব্যস্ত বঙ্গবন্ধু নামে কেউ একজন যে ছিলেন, যার জন্য স্বাধীনতা পেয়েছি এটাও তাদের ভাবার সময় নেই। বিশেষ করে যাদের কালো অক্ষর পেটে। এখন আমাদের কোটি মানুষ বিদেশে, কত রাস্তাঘাট, হাটবাজার, দালানকোঠা। বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে কোটি মানুষ বিদেশে পাড়ি দেওয়া তো দূরের কথা অতগুলো পাসপোর্ট পেত না। বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, আজ যারা স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছে তারা স্বাধীনতাকে সম্মান করে না, মুক্তিযোদ্ধাদের তো আরও না। একবার হাত তুলে দোয়া করে না, যারা দেশ স্বাধীন করেছে সেই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যে সবার ভাগ্য ফিরেছে- এটা কখনো মনেও করে না। কেমন যেন অনেকেই স্বার্থপর হয়ে গেছে। শোকের দিনে শাড়ি-চুড়ি পরে, আলতা, লিপস্টিক মাখা কম মেয়ে কি রাস্তায় নেমেছিল? স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের আমোদ-ফুর্তিতে কি কোনো টান পড়েছে? শপিং মলে কি বেচাকেনা কম হয়েছে? হয়নি। কেমন যেন জাতিটাকেই ধ্বংস করে ফেলছি। সেদিন আমার বাসার সামনে লাশ দেখতে এক আওয়ামী নেতা এসেছিল। তার কয়েক বছর আগেও ভাঙা খোরায় চা খাওয়ার পয়সা ছিল না। এখন অঢেল টাকার মালিক। বাপ-মায়ের খবর রাখে না। সে নাকি দুই গরু জবাই করে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দিনে কাঙাল খাইয়েছে। এদের ২-৩ বিয়ে করতেও অসুবিধা নেই, গরু জবাই করতেও নেই। বঙ্গবন্ধু তার জীবন দিয়ে দেশবাসীকে মানুষ বানাতে চেয়েছিলেন। আর আমরা তার অপদার্থ ভক্তরা দেশবাসীকে কাঙাল বানাতে উঠেপড়ে লেগেছি। কত আর বলব? কেউ যদি না শোনার পণ করে থাকে শিক্ষা-দীক্ষা যদি উল্টোপথে চলে কড়কড়ে সত্য সেখানে অপ্রিয় শোনাবেই। ঘুম থেকে উঠে টুঙ্গিপাড়ার পথে রওনা হব। জানি না, এ যাওয়াই শেষ যাওয়া কিনা। অসুস্থ স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করতে গত সপ্তাহে চিঠি দিয়েছিলাম। এখনো কোনো উত্তর পাইনি। কিন্তু পাঠকদের প্রতিক্রিয়ায় বিস্মিত হয়েছি। গত ১০ তারিখ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে প্রায় ২৫ বছর পর ব্যক্তিগত পত্র দিয়েছি। সেখানে তাকে 'আপা' সম্বোধন করেছি- আজীবন যা করি। তিনি আমায় বজ নামে ডাকেন। মা-বাবা, বড় ভাই, চাচা-চাচি, খালা-খালু, ফুফু-ফুফারা অনেকেই বজ নামে ডাকতেন। ২-৩ জন ছাড়া এখন কেউ নেই। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমায় বজ ডাকায় আপনজনের সানি্নধ্য বোধ করি, এখানে দোষের কী? কিন্তু আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আপা বলেছি কেন- এ নিয়েও কারও কারও অভিযোগ-অনুযোগের অন্ত নেই। কোনো পাঠক যদি ফোন করে তাহলে বুঝতে হবে লেখাটিতে তিনি কতটা মনোযোগ দিয়েছেন। চিঠি লিখলে তো কথাই নেই। তাই পাঠকের মনোভাবের প্রতি সম্মান না দেখিয়ে লেখা যায় না। কেউ কেউ বলেছেন এবং লিখেছেন, আমি অন্য দল করি, তাই প্রধানমন্ত্রীকে আপা বললে তার মর্যাদা বাড়ে, আমার কমে। রাজনীতি করতে গিয়ে ওভাবে ছাড় দিলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। লম্বা মানুষ একটু বোকা হয় সে আমি জানি। আর কত ক্ষতিগ্রস্ত হব? যেটুকু হওয়ার তা তো হয়েছিই। দুনিয়ার কিছু পাওয়ার আশায় আমি তেমন একটা মানুষকে ভয় করে চলি না। আল্লাহকে ভয় করি। দয়াময় আল্লাহ আমার অন্তরের খবর জানেন। তাই জনসাধারণের কাছে রাজনীতি করা মানুষ হিসেবে লুকানোর কী আছে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে আমি শুধু আপা বলে সম্বোধন করি না, আমার কোনো বড় বোন ছিল না, ক্ষণিকের জন্য হলেও তিনি পরিপূর্ণভাবে আমার সে অভাব পূরণ করেছেন তাই তাকে মায়ের মতো বড় বোন মনে করি। দেখা হলে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করি। মুসলমান হিসেবে সালাম করতে গিয়ে মাথা নত করি না, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ব্যক্ত করি। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীকে অনেক রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানেও পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেছি, এখনো করি। তার স্ত্রী আমার থেকে ছোট তারপরও তাকে ভাবী হিসেবে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করি। এ যদি আমার সেকেলে আচরণ হয় আমার কিছু করার নেই। 'কয়লার ময়লা যায় না ধুইলে, খাসলত যায় না মরলে', আমি তো প্রধানমন্ত্রীকে পত্র লিখিনি, আমি আমার মায়ের মতো বোনকে লিখেছি। এতে রাজনীতি না থাকলে না থাকবে। আমার কাছে রাজনীতি এবং ক্ষমতা কোনোটাই বড় না। অনেকে মুখে বলে, আমি অন্তর দিয়ে অনুভব করি। বাড়ি পালানো রিকশা চালানো মানুষ আমি। তাই আমাকে ভয় দেখিয়ে লাভ কী? আমি আল্লাহর গোলাম হতে চেয়েছি, আল্লাহ যদি তার গোলাম হিসেবে সুযোগ না দেন আমার কী করার আছে? ফকির, মিশকিন, কাঙালেরও দশ দুয়ারে হাত পাতার সুযোগ আছে। কিন্তু মুসলমান হিসেবে এক আল্লাহ ছাড়া আমার আর কোনো প্রভু নেই দয়া করার, হাত ভরে দেওয়ার কেউ নেই। তাই আমার অন্তরাত্মা যখন যেভাবে নির্দেশ করেছে সেভাবেই চলার চেষ্টা করেছি। না হলে আমার মেয়ে বিলেতে পড়তে যাবে তার টাকার অভাব হবে কেন? ১/১১-এ ফখরুদ্দীন, মইনউদ্দিনের সময় ছেলের পড়া বন্ধ হয়েছে, এখন মেয়ের পড়াও যদি না হয় তাহলে অমন বাপ হলাম কেন? এখনো হাজার কোটির বহু মালিক আছে যারা আমার খেয়ে-পরে বড় হয়েছে। আমি আল্লাহর গোলাম হিসেবে দয়াময় আল্লাহর বান্দার সেবা করতে চাই। যখন যেভাবে পারি সেভাবেই করার চেষ্টা করি। আমার জন্য কেউ বড় হলে খুশি হই, কাউকে ছোট করার চেষ্টা করি না। সত্য বলতে গিয়ে কেউ যদি ছোট হয় সেখানে আমি অসহায়। তাই মা-খালাদের কী বলে ডাকব? তাদের অন্যকিছু সম্বোধন করব? আমি তো তেমন পারব না। রাজনৈতিক দূরত্ব থাকলেই পারিবারিক নৈকট্য থাকবে না- এটা অনেকেই ভাবতে পারে। আমার বড় ভাইও আমাকে নিয়ে অনেক কিছু না হোক ভাবেন। তাই বলে ভাই হিসেবে তিনি বা আমি খারিজ হয়ে যাব? ভারতে থাকতে যখন জ্যোতি বসু, অটল বিহারি বাজপেয়ি, জর্জ ফার্নান্ডেজ, বিজু পট্টনায়েক, রাজ নারায়ণদের সঙ্গে মেলামেশা করতাম, তখন সেটা নাকি কংগ্রেসবিরোধী হতো। আমি তো মুক্ত স্বাধীন মানুষ। মর্যাদা নিয়ে সবার সঙ্গে মিশেছি। বঙ্গবন্ধুর যেমন ছায়া ছিলাম, হুজুর মওলানা ভাসানীরও মায়া ছিলাম। এ নিয়ে কোনো বিরোধ বাধেনি। কতজন এখন শেখ রেহানার পায়ে চুমু খায়, ম্যাডাম বলে মুখে ফেনা তোলে। কিন্তু আমি তো তাকে রহিমা, শুশুমা, শাহানার মতো ছোট বোন রেহানা বলেই ডাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। এখনো মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করি। এখানে কোনো হীনমন্যতা তো আমাকে স্পর্শ করে না। তাহলে আপাকে আপা বলায়, মাকে মা বলায় দোষ কোথায়? 'রেহানার সঙ্গে কথা হলেই সে বলে জাতির পিতার বাড়িঘর সব আমাদের না, ওখানে আপনারও দাবি আছে। কারও স্বীকার-অস্বীকারে আপনার কিছু আসে যায় না। সারা দুনিয়া জানে আপনি জাতির পিতার ছেলে আমাদের ভাই।' রেহানার এ অনুভূতির প্রতি সম্মান দেখাতে আপাকে লিখেছি। এতে যদি আসমান ভেঙে পড়ে পড়বে- সেটা আমি ফেরাব কী করে?
আমার বড় মেয়ে কুড়ি বছর শেষে বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে যাবে। বাবার বড় ইচ্ছা ছিল তার কোনো নাতি-নাতকুর ব্যারিস্টার হোক। লন্ডনে যেতে ব্যাংক সলভেন্সির প্রয়োজন। '৯০-এ দেশে ফেরার পর অগ্রণী ব্যাংক ছাড়া আমার কোনো ব্যাংকে হিসাব নেই। আমার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে কারও নামে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই। ভেবেছিলাম, যে ব্যাংকে বছরের পর বছর লেনদেন সে ব্যাংক থেকেই সার্টিফিকেট দেব। কিন্তু আজব কারবার তাদের পছন্দের ব্যাংক না হলে চলবে না। প্রথমে খটকা লেগেছিল। তারপর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম ব্রিটিশ সরকারের তালিকার ব্যাংক থেকে সলভেন্সি সার্টিফিকেট দিতে হবে। অ্যাকাউন্ট না থাকলে ব্যাংক সলভেন্সি দেবে কেন? তাই নতুন অ্যাকাউন্ট খোলার প্রয়োজন। তেমন টাকা-পয়সা ছিল না। কয়েকজন কোটিপতির কাছে কয়েক সপ্তাহের জন্য টাকা চেয়েছিলাম। বিপুল বিত্তের মালিকদের কেউ সাহায্য করতে পারেনি অথবা বিশ্বাস করে সাহায্য করেনি। কিন্তু যাদের অল্প আছে তারা প্রায় সবাই করেছে। মতিঝিলের শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করতে গিয়ে শুনলাম চোর, ডাকাত এমনকি চামারের হিসাব খুলতেও কোনো বাধা নেই। যত বাধা রাজনৈতিক লোকদের। রাজনৈতিক লোকদের বাংলাদেশ ব্যাংকের পারমিশন ছাড়া কোনো হিসাব খোলা যাবে না, যায়ওনি। প্রায় এক সপ্তাহ পর বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে তবে হিসাব খোলা হয়েছে। এ ঘটনায় একেবারে মরে যেতে ইচ্ছা করেছে। কতবার মনে হয়েছে চোর-ডাকাত হলেও ভালো হতো, কোনো প্রশ্ন আসত না। মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজনীতি করি বলে ছাগল চোরের চেয়েও চরম দুর্গতি। নিজের টাকায় ব্যাংকে হিসাব খুলতেও পুলিশের হাতে ধরা পড়া চোর-ডাকাতের মতো জবাবদিহি। জানি না রাজনীতি আর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে আর কত নিচে নামানো হবে। মহান সর্বশক্তিমান দয়াময় আল্লাহ বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের সবাইকে বেহেশতবাসী করুন। আমিন।
হলেখক : রাজনীতিক