একাত্তরে ১৬ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। ’৭৫-এ ১৯ বছর বয়সে অংশ নিয়েছেন প্রতিরোধ যুদ্ধে। জীবনের মায়া না করে বারবার ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ন্যায়যুদ্ধে। ’৭৫-এর পর তারা জাতীয় মুক্তিবাহিনী গঠন করেন। সেই বাহিনী ’৭৬ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে হরতাল ডেকেছিল। হরতাল সফল করতে ১৩ আগস্ট রাতে তার নেতৃত্বে ছয়জনের একটি বাহিনী টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের একটি ব্রিজ উড়িয়ে দেয়। পরদিন তাদের আশ্রয়স্থল ঘিরে ফেলে সেনাবাহিনী। কিন্তু আত্মসমর্পণ না করে নৈতিক কারণে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তারা। যুদ্ধে তার পাঁচ সহযোগী শহীদ যান। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেফতার হন তিনি। সামরিক আদালতের রায়ে তার ফাঁসির দণ্ড হয়। মৃত্যুর অপেক্ষায় আট বছর নির্জন কনডেম সেলে থেকেছেন। অন্তত চারবার পরিবারের সদস্যরা তার সঙ্গে শেষ দেখা করেছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার চাপ, বিশেষ করে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ফাঁসির দণ্ড মওকুফ করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় তার।
১৪ বছর কারাভোগ শেষে ’৮৯ সালে মুক্তি পান এই মহৎ যোদ্ধা। আমাদের কৈশোরের কিংবদন্তি বীর বিশ্বজিৎ নন্দী। ’৭৫-এ তাদের এই প্রতিরোধ যুদ্ধকে কারও কাছে মনে হতে পারে কৈশোরের আবেগ, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকে কেউ কেউ হটকারিতাও বলতে পারেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর লাশ ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের সিঁড়িতে রেখে যখন তার সহকর্মীরা ছুটে গিয়েছিলেন বঙ্গভবনে, যখন বঙ্গবন্ধুর কোটি অনুসারী রাতারাতি গায়েব হয়ে গিয়েছিলেন; তখন বিশ্বজিৎ নন্দীরা নিজেদের জীবনের মায়া তুচ্ছ করে যুদ্ধ করেছেন স্রেফ বঙ্গবন্ধুর প্রতি নিখাঁদ ভালোবাসা থেকে। জাতির পিতার হত্যার পর কোনো প্রতিরোধ হয়নি, কেউ ইন্নালিল্লাহ পড়েননি; ২১ বছরের এই অপপ্রচারকারীদের মুখে চপেটাঘাত এই বিশ্বজিৎ নন্দীরা। বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ না করার গ্লানি থেকে তারা জাতিকে মুক্তি দিয়েছিলেন। সেই প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন ১০ হাজারেরও বেশি মুজিবপ্রেমিক। প্রাণ দিয়েছিলেন ১০৪ জন। তারা যে সত্যি সত্যি কোনো প্রাপ্তির আশায় যুদ্ধ করেননি, তার প্রমাণও রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংগঠন আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায়, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, ওলামা লীগ, অমুক লীগ, তমুক লীগের তস্য নেতাদের প্রচার-প্রচারণার পোস্টারে-ব্যানারে, তোরণে, মাইকিংয়ে যখন কান ঝালাপালা; যে কোনো লীগের তস্য কর্মীর দাপটে যখন কাঁপে চারপাশ; তাদের ঠাটে-বাটে, জৌলুসে যখন ঝলমল সবকিছু; তখন বিশ্বজিৎ নন্দী টাঙ্গাইলে নিভৃত জীবনযাপন করেন। সংসার চলে স্কুলশিক্ষক স্ত্রীর আয়ে। অজানা অভিমানে আওয়ামী লীগে নেই, কিন্তু ’৬৯ সালে ছাত্রজীবনে একপলকের জন্য বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখা বিশ্বজিৎ নন্দী হৃদয়ে ধারণ করেন সত্যিকারের বঙ্গবন্ধুকে। ১৫ আগস্ট এলেই ছটফট করেন। ছুটে আসেন ঢাকায়। সকালের রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা, দিনভর আওয়ামী লীগের লটবহরের ফুল দেওয়া শেষ হলে, ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটি যখন একটু নিরিবিলি হয়, তখন বিশ্বজিৎ নন্দী যান সেখানে। চুপচাপ বসে থাকেন, হৃদয়ের গভীরে অনুভব করেন প্রিয় বঙ্গবন্ধুকে। ’৯৭ সালে বিয়ে করেছেন। এক মেয়ে, এক ছেলে নিয়ে নিরিবিলি সুখের সংসার। ছেলেমেয়েরা তার বাবার বীরত্বের গল্প শোনে, বাবাকে নিয়ে গর্ব করে। স্বজনরাও গর্বিত বিপ্লবী বিশ্বজিৎ নন্দীকে নিয়ে। কখনো কি মনে হয়, ভুল করেছেন? ভুল যুদ্ধে তছনছ করেছেন নিজের জীবন? জেগে ওঠে তার প্রতিবাদী সত্তা, তীব্র আপত্তি করেন, প্রশ্নই ওঠে না। পিতা হত্যার প্রতিবাদ করতে পেরেছেন, এ নিয়ে গর্বের শেষ নেই তার। গোটা জাতিকে গ্লানিমুক্ত করার যে অর্জন, মনে করেন, তার চেয়ে মহত্তম কোনো অর্জন নেই। মনে করেন জাগতিক কোনো অর্জনে মাপা যাবে না তা। রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে বিচার হয়েছে, ফাঁসির রায় হয়েছে। কিন্তু বিশ্বাস করেন, একদিন ইতিহাসে তাদের নাম লেখা থাকবে, বীর হিসেবেই, রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে নয়। কোনো ক্ষোভ নেই, কোনো গ্লানি নেই, কোনো অপ্রাপ্তি নেই। খালি বেদনা আছে, বঙ্গবন্ধুর হত্যার ষড়যন্ত্রের যারা ছিল, যারা সারাজীবন বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করেছেন, তারা যখন এখন ক্ষমতার বলয়ে; টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজরা যখন নিজের চামড়া বাঁচাতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের স্লোগান দেন; তখন কষ্টে বুক ভেঙে যায়। এই বাংলাদেশ কি চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু? দুর্বৃত্তরা রাজনীতির নিয়ামক হবে বলেই কি তারা যুদ্ধ করেছিলেন? মুক্তির পর এক বছর ছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার প্রশ্রয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িতেই। এখনো অনুভব করে বঙ্গবন্ধু কন্যার স্নেহ-মমতার পরশ। বিশ্বজিৎ নন্দীর কাছে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী নন, জননেত্রী নন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী নন; কেবলই বঙ্গবন্ধু কন্যা, তার আদর্শের উত্তরাধিকার। বিশ্বাস করেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই একদিন বাস্তব হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা।
জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে এটিএন নিউজের বিশেষ আয়োজন ছিল ‘বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই মুজিব’। সেই আয়োজনে অতিথি হয়ে এসেছিলেন এই কিংবদন্তি যোদ্ধা। এখনকার হাইব্রিড আওয়ামী লীগাররা যখন শোককে শক্তিতে পরিণত করেছে, এমনকি শোক দিবসের অনুষ্ঠানেও যখন সেই শক্তি দেখাতে গিয়ে নিজেরা নিজেরা খুনাখুনি করছে; তখন জাতীয় শোক দিবসে এমন একজন মহৎ বঙ্গবন্ধুপ্রেমিকের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাতে পেরে নিজের মধ্যেও তৈরি হয়েছে এক ধরনের ভালো লাগার অনুভূতি।