কয়েক সহস্র বছরের রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে আধুনিক গণতান্ত্রিক চীনের গোড়াপত্তন করেন মহান বিপ্লবী নেতা ডা. সান ইয়াৎ সেন। তার মৃত্যুতে শ্রদ্ধা জানিয়ে গভীর অনুরাগী মাও সে তুং বলেছিলেন, 'মৃত্যু অতি স্বাভাবিক নিত্য ঘটনা, তা যেন পাখির পালক খসে পড়া, যেন গাছের শুষ্ক পাতা ঝরে পড়া। কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যু আছে যা পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দেয়, যেন থাই পর্বত ধসে পড়ে।' ভারতের মহান রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. এপিজে আবদুল কালামের মহাপ্রয়াণে সান ইয়াৎ সেনের জন্য মাও সে তুং উচ্চারিত কথাগুলো আমার অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং যথাযথ মনে হয়েছে। মনে হয়েছে তার মহাপ্রয়াণে সত্যি হিমালয় ভেঙে পড়েছে। তার মৃত্যু ছিল অত্যন্ত আকস্মিক। এমনটি কেউ এতটুকুও আশঙ্কা করেনি। সুন্দর সুস্থ সদা কর্মচঞ্চল আবদুল কালাম বাংলাদেশের সনি্নকটে ভারতের উত্তর সীমান্তে মেঘালয় রাজ্যের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের শহর শিলংয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মহাজ্ঞানী মহাজন কালাম এসেছিলেন এক তরুণ ছাত্র সমাবেশে বক্তৃতা দিতে। তিনি মঞ্চে বক্তৃতারত অবস্থায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে নিচে পড়ে যান। তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তিনি সেখানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। গোটা ভারতবর্ষের মানুষ, বাংলাদেশের মানুষ, দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ গভীরভাবে শোকাহত হয়। হয় শোকে মুহ্যমান। এ যেন সত্যি হিমালয় ধসে যাওয়া এক মৃত্যু। আবদুল কালাম বহুমাত্রিক প্রতিভার নানামুখী বিকাশের এক বিরল ব্যক্তিত্ব। তিনি জ্ঞানতাপস, বিজ্ঞানসাধক, পরমাণু গবেষক। মহাবিজ্ঞানী আবদুল কালাম ভারতের নভোচারী মিসাইলম্যান। তিনি স্বপ্নদ্রষ্টা, যুগস্রষ্টা, দার্শনিক ও কবি। গভীর মানবতাবাদী শান্তিবাদী। রবিঠাকুরের কথায়, 'সীমার মাঝে অসীম তুমি'। কোনো সীমারেখা আবদুল কালামকে সীমাবদ্ধ করতে পারেনি। তিনি জীবনভর শুধু স্বপ্ন দেখেছেন, অনেক বড় বড় স্বপ্ন। স্বপ্ন দেখাই ছিল তার মহত্ত্ব ও বিশালতা। তিনি গোটা জাতিকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তিনি তরুণদের বলতেন, 'যা তোমরা ঘুমের মধ্যে দেখ তা স্বপ্ন নয়। স্বপ্ন সেটাই, যা তোমাকে ঘুমাতে দেয় না।' আবদুল কালামের স্বপ্ন আত্মজয়ের। তার স্বপ্ন বিশ্বজয়ের, মহাকাশ জয়ের। স্বপ্নগুলো মানুষের অদম্য চেতনার, মানুষের সীমাহীন সম্ভাবনার বিকাশ সাধনের। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল বৈজ্ঞানিক আবদুল কালামের সঙ্গে এক দুর্লভ সাক্ষাৎ লাভের। সেটা ১৯৯৬ সালের শেষের দিকে কথা। আমি সেনাবাহিনী প্রধান। ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল শংকর রায়চৌধুরীর আমন্ত্রণে ভারত সফরে যাই। দিলি্লর সাউথ গেটে বাহিনী প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করি। আইকে গুজরালের মন্ত্রিসভায় প্রতিরক্ষামন্ত্রী মুলায়েম সিং যাদবের সঙ্গে আমার আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ হয়। প্রতিরক্ষামন্ত্রী একপর্যায়ে আবদুল কালামের কথা উল্লেখ করেন এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে তার সহযোগিতার ইঙ্গিত দেন। আবদুল কালামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। মাথাভরা দীর্ঘ কেশ, সৌম্য, শান্ত, উদার ও বিনয়ী মানুষটির মধুর আচরণ আমাকে মুগ্ধ করে। তিনি আমাকে বলছিলেন, 'শুনেছি আপনি সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কোরে কমিশনপ্রাপ্ত। নিজেও ইঞ্জিনিয়ার। ভারতে আমরা নিজেরাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ ঘটিয়ে সামরিক আধুনিকায়ন করছি। সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নে আপনারাও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কাজে লাগাতে পারেন। চাইলে আমরাও সহযোগিতা করতে পারি।' বাংলাদেশ সম্বন্ধে তার অনেক কৌতূহল দেখেছিলাম। জ্ঞান-বিজ্ঞানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমূল্য অবদানের কথা উল্লেখ করে তিনি জগদীশ চন্দ্র বসু ও সত্যেন বোসকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। আমার মনে পড়ে তিনি আমাকে কয়েকটি ব্যক্তিগত পত্রও লিখেছিলেন। আমি আনন্দসহকারে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সেগুলোর জবাব দেই। আমার মনে পড়ছে, সফর শেষের সন্ধ্যায় আমি ও আমার স্ত্রী নাগিনা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতায় এগিয়ে আসা কিছু বিশিষ্ট ভারতীয় বন্ধুর সম্মানে দিলি্লর এক অভিজাত হোটেলে নৈশভোজের আয়োজন করি। তিন বাহিনীর প্রধানসহ জেনারেল জ্যাকব রাষ্ট্রদূত মুচকুন্দ দুবে ও আরও অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব উপস্থিত হয়েছিলেন। জেনারেল অরোরা অসুস্থ বিধায় তার কন্যাকে পাঠিয়েছিলেন। সেই সন্ধ্যায় বিজ্ঞানী এপিজে আবদুল কালামও নৈশভোজে অংশ নিয়ে আমাকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছিলেন।
বিজ্ঞানব্রতী আবদুল কালাম ভারতকে বিশ্বসভায় সম্মানিত করেছেন। আত্মবিশ্বাস ও শক্তি যুগিয়েছেন। ভারতকে প্রযুক্তিমনস্ক করেছেন। স্বপ্নবিভোর করেছেন। সৃজনশীলতায়, মননশীলতায় নতুন নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। বিশ্বের প্রথম কাতারের দেশগুলোর সঙ্গে ব্রাকেটভুক্ত করেছেন।
বৈজ্ঞানিক ও প্রকৌশলী স্বপ্নচারী সাধক আবদুল কালাম রচিত আত্মজীবনীমূলক বই 'উইংস অব ফায়ার'-এর শেষ কয়েকটি লাইন এ রকম, 'এই গল্প শেষ হবে আমার সঙ্গেই, যেহেতু পার্থিব কিছুই আমার নেই। আমি কোনো কিছুরই মালিক নই, কিছুই সৃষ্টি করিনি, অধিকারী নই কোনো কিছুর- না পরিবার, না পুত্র-কন্যার।... আমার প্রপিতামহ আবুল, আমার পিতামহ পাকির, আমার পিতা জয়নুলাবেদিন- এর ব্লাড লাইন হয়তো শেষ হবে আবদুল কালামে (অকৃতদার) এসে। কিন্তু আল্লাহর মহিমা কখনো থামবে না, যেহেতু তা চিরন্তন।' না। রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম তার মৃত্যুর মধ্যদিয়ে মোটেই শেষ হয়ে যাননি। কখনো যাবেনও না। আল্লাহর মহিমায় তিনি তার অবিস্মরণীয় কীর্তির মধ্যদিয়ে চিরজাগরূক থাকবেন। চিরজাগরূক থাকবেন বাংলাদেশের মানুষের মনেও। তিনি বাংলাদেশে একাধিকবার এসেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানগুলোতে, বিদগ্ধ বিভিন্ন সভা-সমাবেশে মহামূল্যবান বক্তৃতা দিয়েছেন। ছাত্র ও যুব সমাজকে জ্ঞানের আলোকবর্তিকা তুলে দিয়েছেন। বিশাল বিশাল স্বপ্ন দেখিয়েছেন। এপিজে আবদুল কালামের মৃত্যু এক অবিস্মরণীয় মৃত্যু। তিনি কর্মের মধ্যেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। এপিজে আবদুল কালামের স্মৃতির প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক : সাবেক সেনাপ্রধান।