এক. হঠাৎ করেই কেন এতদিন পর লতিফ সিদ্দিকীর এমপিত্ব বাতিল করা হচ্ছে? তবে কি লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে বিব্রতকর অবস্থা লাঘবে তার এমপিত্ব বাতিল করতে হচ্ছে? তার শূন্য আসনে উপনির্বাচন দিয়ে তাকে কি স্বতন্ত্র এমপি বানিয়ে সংসদে নিয়ে আসা হচ্ছে? তার এমপিত্ব লাভ সহজ করতে দলের মধ্য থেকে দুর্বল কাউকে কি দলীয় মনোনয়ন দিয়ে জনগণকে আইওয়াশ করা হবে? এটা কি এক ধরনের ক্লিন সার্টিফিকেট দিয়ে তাকে পুনরায় এমপি বানানোর প্রক্রিয়ারই অংশ? আমরা এগুলো বিশ্বাস করতে চাই না। তবে নিকট ভবিষ্যৎই বলে দেবে আমাদের এ আশঙ্কা ভুল না সঠিক।
দুই. সপ্তাহখানেকের মধ্যেই সংসদ সদস্যপদ চলে যাচ্ছে দল ও মন্ত্রিপরিষদ থেকে বহিষ্কৃত ধর্মদ্রোহী লতিফ সিদ্দিকীর। লতিফ সিদ্দিকীর এমপিত্ব বাতিলের প্রায় সব আইনি প্রক্রিয়াই এখন শেষের দিকে। দলের সাধারণ সম্পাদক স্পিকারকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন যে, শৃঙ্খলা ভঙ্গ করার অপরাধে লতিফ সিদ্দিকীকে দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। সংসদ সদস্য পদ বাতিল চেয়ে দলের দেওয়া চিঠি স্পিকার নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়েছেন। এখন নির্বাচন কমিশন সংবিধানের ৬৬(৪) অনুচ্ছেদের বলে লতিফ সিদ্দিকীর আসন শূন্য ঘোষণা করতে যাচ্ছে। সংবিধান বলছে নির্বাচন কমিশনের এ সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। তাই এবার লতিফ সিদ্দিকীর এমপিত্ব চলে যাচ্ছে এটা নিশ্চিত।
তিন. সংসদ সদস্যদের পদত্যাগ বা নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোট প্রদান ছাড়া একজন এমপিকে দল থেকে বহিষ্কার করার কারণে তার সদস্যপদ থাকবে কি না, তা নিয়ে সংবিধানে স্পষ্ট কিছু নেই। তবে ১৯৯৯ সালের ২৯ জুলাই সুপ্রিমকোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের এক রায়ে (১১৬৯/১৯৯৮ নম্বর রিট পিটিশন) সংবিধান অনুযায়ী এ বিষয়টিকে নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে সাত দিনের মধ্যে নিষ্পত্তির আদেশ দেওয়া হয়। সুপ্রিমকোর্টের এ আদেশ পেয়ে নির্বাচন কমিশন সে বছরের ১১ অক্টোবর তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে ১৯৯৬ সালে বিএনপি থেকে নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভায় যোগদানকারী সিরাজগঞ্জ-৭ আসনের এমপি হাসিবুর রহমান স্বপন ও রাজশাহী-৫ আসনের ডা. আলাউদ্দিনের আসন দুটি শূন্য ঘোষণা করে। তখন নির্বাচন কমিশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু আইনি পর্যবেক্ষণ দেয়, যা আমাদের সাংবিধানিক অস্পষ্টতা নিরসনে সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক নজির সৃষ্টি করে। নির্বাচন কমিশন তার পর্যবেক্ষণে বলে, কোনো দলের মনোনয়ন নিয়ে সেই দলের আদর্শ ও নীতির ভিত্তিতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে সেই দলের আদর্শ ও নীতির পরিপন্থী কার্যকলাপের জন্য দল থেকে বহিষ্কৃত হলে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের চেতনার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যের পদটি বাতিল হবে। নিজ দলের প্রতি আনুগত্য বজায় রাখেননি বলে এটা দলের প্রতি তার বিশ্বাসঘাতকতারই নামান্তর। এ ধরনের ঘটনা সংসদীয় পদ্ধতির কর্ম সম্পাদনে প্রতিকূল প্রভাব ফেলে। এটা দল থেকে তার পদত্যাগেরই সমার্থক।
চার. তবে কোন পদ্ধতিতে তার আসন শূন্য ঘোষণা করা হবে, এ নিয়ে রীতিমতো বিপাকে পড়েছিল সরকার। সংসদ সচিবালয় এবং নির্বাচন কমিশনের সামনে দুটি আইনি পদ্ধতি ছিল। প্রথমত, আমাদের সুপ্রিমকোর্টের ১১৬৯/১৯৯৮ নম্বর রিট পিটিশনের রায়ের ভিত্তিতে এবং সংবিধানের ৬৬(৪) অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে আসন শূন্য ঘোষণা করা যাবে। দ্বিতীয়ত, গণপ্রতিনিধিত্ব আইনের ১২ ধারার ক্ষমতাবলে স্পিকারের মাধ্যমেও এটা করা সম্ভব। তবে শেষ পর্যন্ত সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এখন সাংবিধানিক শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার স্বার্থে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তেই এটা করা হচ্ছে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষণ এবং উচ্চ আদালতের নজিরকে অবজ্ঞা করাটা সমীচীন হতো না।
পাঁচ. নির্বাচন কমিশনে শুনানিতে গত রবিবার সৈয়দ আশরাফ যুক্তি দিয়ে বলেছেন, যেহেতু লতিফ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের কেউ নন, তাই তার সংসদ সদস্য পদে থাকারও কোনো আইনগত অধিকার নেই। অন্যদিকে ধর্মদ্রোহী লতিফ সিদ্দিকী প্রকাশ্যে দম্ভোক্তি করে বলেছেন, তার সদস্যপদ বাতিলের কোনো ক্ষমতা আওয়ামী লীগের নেই। তবে নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে ২০০০ সালে বিএনপি থেকে নির্বাচিত কিশোরগঞ্জ-২ আসনের তৎকালীন এমপি মেজর (অব.) আখতারের সদস্যপদ শূন্য ঘোষণার নজিরটি অনুসরণ করা। তখন বিএনপির চিঠি পেয়ে স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ইসিকে সিদ্ধান্ত দিতে বললে ইসি দুই পক্ষের শুনানি করেই মেজর (অব.) আখতারের সদস্যপদ শূন্য ঘোষণার রায় দিয়েছিল। তাই এবারও ইসি 'সংসদ সদস্য (বিরোধ নিষ্পত্তি) আইন, ১৯৮০' অনুসরণ করে আওয়ামী লীগের অনুরোধের বাইরে যাবে না বলে ধরে নেওয়া যাচ্ছে।
ছয়. প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে কটূক্তি করে লতিফ সিদ্দিকী বলেছিলেন 'জয় কে? সে সরকারের কেউ নয়'। দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ অর্থাৎ জয়কে অবমাননার অপরাধে লতিফ সিদ্দিকীর সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যপদ বাতিল করা হয়েছে। দল থেকেও তাকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। মন্ত্রিত্ব থেকেও অপসারণ করা হয়েছে তাকে। অথচ তার প্রধান অপরাধ ছিল ইসলাম অবমাননা। মহানবী (সা.), হজ, তাবলিগ নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতিতেও আঘাত দিয়েছেন তিনি। অথচ এ অপরাধে তার কোনো বিচার বা শাস্তি হয়নি। সব মামলায় একযোগে জামিন পেয়ে লতিফ সিদ্দিকী এখন মুক্ত। তার বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোও যে আইনে ও প্রক্রিয়ায় করা হয়েছে তাতে এখন তার শাস্তি হওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। এখন তো এ নিয়ে সরকারি দলের কেউ আর কোনো টুঁ-শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করেন না। তাই প্রশ্ন জাগে, লতিফ সিদ্দিকীকে ক্লিন সার্টিফিকেট দেওয়ার অংশ হিসেবে কি তার এমপিত্ব বাতিল করে নতুন করে এমপি করার প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে? তার শূন্য আসনে এবার উপনির্বাচন দিয়ে স্বতন্ত্র এমপি হিসেবে তাকে কি আবার সংসদে নিয়ে আসা হচ্ছে? উপনির্বাচনে লতিফ সিদ্দিকীর এমপিত্ব লাভ সহজ করতে দলের মধ্য থেকে দুর্বল কাউকে কি দলীয় মনোনয়ন দিয়ে জনগণকে আইওয়াশ করা হচ্ছে? উত্তর পেতে হলে অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক : সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
ই-মেইল : [email protected]