অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের মধ্যে জীবনের নয়, মৃত্যুর অন্বেষা। সুপ্রাচীন অ্যাবরিজিনালদের সঙ্গে সারা দিন কাটালাম। গায়ের মধ্যে মাটি মেখে তারা গান-বাজনা করে সুপ্রাচীন সুরে, সারাদিন ধূমপানের মধ্যে কাটায়। বলে, আমরা সুখে আছি। মৃত্যুর সঙ্গেই আছি, তোমরা আছ জীবনের অর্জন নিয়ে, আমরা মৃত্যুকে ভালোবাসি। অস্ট্রেলিয়ার নতুন প্রজন্ম এখন আর খ্রিস্ট ধর্মের মধ্যে তেমন কিছু খুঁজে না পাওয়ায় ছুটে চলেছে ডেভিল অর্থাৎ শয়তানের উপাসনার মাঝে। ওদের চার্চও আছে। গোপনে বিশেষ দিবসে মিলিত হয় ডেভিল উপাসকরা। ডেভিলের উপাসনার সভায় আমি উপস্থিত। এও কি সম্ভব? একটি সিডির জন্য ছবি তোলা হবে, সেখানে ডেভিলের একটি ভূমিকা আছে, পুলিশদের এভাবে বলা হয়েছে। তাই ব্রিসবেন শহরের পশ্চিম প্রান্তে এক পোড়ো বাড়িতে এ সভা।
পৃথিবীর নামকরা তিনজন অপআত্মাকে সাদরে আহ্বান জানান হয়েছে। তারা আছে কি নেই বোঝা যাচ্ছে না, তবে একজনকে শনাক্ত করা আমার পক্ষে সুবিধাজনক মনে হলো, তিনি হলেন আমাদের কোচবিহারের কালীমন্দিরের কালী দেবী। শুনেছি ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ কিছু দিন কালীর সাধনা করেছিলেন। তাতে তার আত্দিক উন্নতি হয়েছিল কিনা জানা যায়নি, তবে কালীর অপর পারে যিনি তার স্রষ্টা, তার নির্দেশে বহু দিন তার স্বরোদে আর মন বসেনি। তার আধ্যাত্দিক জীবনে কালী সহসাই এসে সহসাই বিদায় নেয়। কোরআন শরিফে আল্লাহ বলেছেন, লাত-উজ্জা-মানাত এগুলো কাল্পনিক নাম। ওদের কোনো ক্ষমতা নেই, যদি থাকত তাহলে এতদিনে ওরা কাবা শরিফ অধিকার করত এবং স্বস্থানে জায়গা দখল করত। মানুষের মনের বিকার ওগুলো। নানা মূর্তিতে মন অধিকার করতে আসে।
তবে কোচবিহারের লৌকিক দেবতা নিয়ে আমার বিশেষ আগ্রহ, কারণ ভাওয়াইয়া ও চটকা নিয়ে গবেষণা করেছি। যদি লৌকিক দেবতা নিয়ে লেখাপড়া না করি, গবেষণা হবে অসম্পূর্ণ। ছোটবেলায় 'মাসান' নামে একটি গালিতে অভ্যস্ত হতে হয়েছে। আমার একমাত্র ফুফু তার ছোট ছেলেকে ডাকতেন : মান্টু, ওরে 'মাসান', এদিকে আয়, অর্থাৎ সবাই ফর্সা, মান্টু খানিকটা কালো ছিল বলে তার ওই উপাধি। 'মাসান' দেবী ভীষণ কালো। হাঁড়ির নিচের দিকটার চেয়েও। 'মাসান' শিবের অনুসারীর নাম, যিনি কোচবিহারের বলরামপুর ও আশপাশের গ্রামে বিশেষ প্রতিপত্তি বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছিলেন। 'মাসান' আমার কাছে ভীতপ্রদ, তিনি যখন তখন কাউকে বধ করার ক্ষমতা রাখতেন। সেই বয়সেই আমি 'মাসান' দেবীর মাচানে গিয়ে উল্টো ভেংচি দিতাম। কিছুই বলত না, স্বপ্নে রাতে তাড়া করত। বলত, তুই ভেংচি দিয়েছিস, তোর এত বড় সাহস! ওই বড় দোলাবাড়িটার কাছে রাতেরবেলা একলা এলে তোকে মজা দেখাব।
সরস্বতীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো ছিল। বিদ্যাপাতা বইয়ের মধ্যে রেখে দিতাম। কখনো দ্বিতীয় হইনি। সরস্বতীকে ভালোই লাগত। শিল্পী হৈমন্তী শুক্লার বাসায় গিয়ে বিরাট একটি সরস্বতীর মূর্তি পেলাম। সরস্বতীকে ভালো লাগার কথা জানাতে সে চমকে উঠল। বলল, সরস্বতীকে ঘরে রেখেছি সংগীতের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবে, কোনোদিন অনুভবে পাইনি। আসল কথাটা হলো : অনুভবে পাওয়া। আল্লাহকেও পাব না, যদি তাকে অনুভবে না পাই। সবচেয়ে বড় কথাটা এখানেই।
কাজী নজরুলের নানা লেখায় ওরা এসে ভাগ বসিয়েছে বৈকি। কেউ জিজ্ঞাসা করেছেন যে, আমি ওই নিয়ে কোনো গবেষণায় ব্যাপৃত আছি কিনা। বলেছি ওগুলো রেখেছি আগামী প্রজন্মের ভালো রিসার্চারদের জন্য। নজরুলের লেখায় দেব-দেবী উপস্থিত, জানামতে অপর কোনো হিন্দু লেখকও এত বিপুলসংখ্যক দেব-দেবীকে হাজির করতে পেরেছেন কিনা সন্দেহ। কারণ কী? অল্প বয়স থেকেই নজরুল ছিলেন 'লেটো' দলের গায়ক ও পরে উপস্থাপক। যারা গান শুনতে এসেছেন রাতে তারা চেনেন তাদের দেব-দেবীকে, যাদের বন্দনা না হলে 'লেটো' গান মাঠে মারা যাবে। বাল্যকাল থেকেই তাই নজরুল দেব-দেবীদের কিঞ্চিত দক্ষিণা দিয়ে এসেছেন।
ভারত সরকার থেকে নজরুলের উপরে যে মূল্যবান অ্যালবামটি প্রকাশিত হয়েছে, যার একটি কপি আমি পেয়েছি, তাতে নজরুলের ঘরে যে দেবীর ছবি তোলা হয়েছে তা সম্পূর্ণ বানোয়াট। পরিপূর্ণ 'অথরিটি' নিয়ে কথাটা বলছি। এটি মেলা থেকে কেনা একটি পুতুল, যার পেছনে নজরুল একদিনও সময় দিয়েছেন বলে কেউ প্রমাণ দিতে পারবে না। যদিও তার একজন গুরু তাকে কয়েকদিন গঙ্গা ঘাটে যাওয়া-আসার সবক দিয়েছিলেন। ওটি ধোপে টেকেনি, তাই নজরুলের আধ্যাত্দিকতার উন্নয়নে এটির কোনো ভূমিকাই ছিল না। তিনি ছিলেন বহুদিন নির্বাক। কেন, তা জানি না। আমার ঘরেও বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আনা ছোট বড় পুতুল, বুড়াবুড়ি, সং ইত্যাদি অসংখ্য সংগ্রহ। লোকশিল্পের উপাদান হিসেবে। ফেলে দি' নি', এখনো আছে। কোনোদিন মনেও হয়নি যে এরা আমার সামান্যতম উপকার অথবা অপকার করার ক্ষমতা রাখে। ওরা পুতুল। নজরুলও তেমনটি জানতেন বলে আমার ধারণা।
অস্ট্রেলিয়ায় যারা ডেভিলের উপাসনা করছে, করুক না। যে মৃত্যুর অন্বেষায় তারা সেখান থেকে আত্মার শান্তি বহুদূরের পথ। ওদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি। গাঁজাজাতীয় কিছু সেবন করা ছাড়া ওরা শান্তি পায়নি। বিভীষিকার মধ্যে কাটছে তাদের দিনরাত্রি। আমার মতো অভাজনের কাছেও দীক্ষিত হওয়ার জন্য শত ব্যক্তি প্রস্তুত। বললাম : জানি না। তার দেখা পাইনি।
পিছিয়ে নেই আমরাও। ইন্টারনেটের দোকানে প্রচলিত ধর্মের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন কেউ। তাদের জন্য অজানিত মৃত্যুর পরোয়ানা। আসল সত্য যার কাছে, সে আছে নিশ্চুপ।
লেখক : সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।