২৯ অক্টোবর, ২০১৫ ১১:২০

চাঁদের আলোতে মৃত্যু দেখা

নঈম নিজাম

চাঁদের আলোতে মৃত্যু দেখা

সেদিন আকাশে জ্যোৎস্না ছিল। মনে হচ্ছিল আকাশ ফেটে বেরুনো চাঁদের আলো ভাসিয়ে নেবে সব কিছু। সময়টা ২০০৭ সাল। কুমিল্লা থেকে ঢাকা ফিরছি। মেরামতের জন্য বন্ধ ছিল দাউদকান্দি ব্রিজ। কুমিল্লা ক্লাব থেকে বের হলাম রাত ১২টায়। আমার সঙ্গে নাঙ্গলকোটের আওয়ামী লীগের দুই নেতা, শহীদুল ইসলাম পাটোয়ারী ও সলিমুল্লাহ মিয়াজি বাচ্চু। তারা গাড়িতে ওঠেই বললেন, আজ না গেলে হয় না। আমি বললাম, আজ ভরা জ্যোৎস্না। রাস্তায় গাড়ির সানরুপ খুলে দেব। চাঁদের আলো খেতে খেতে যাব ঢাকায়। তারা আপত্তি করলেন না। গাড়ি চলছে ঢাকার পথে। কুমিল্লা পার হতেই চারদিকে খোলা প্রান্তর। সারি সারি ধান খেত। কোথাও জলাশয়। মাঝে মাঝে ঘরবাড়ি। গাড়িতে সিডি প্লেয়ারে গান বাজছে... ‘এমনও বরষা ছিল সেদিন...।’ ফোন বেজে ওঠল। হঠাৎ এ সময় খবর পেলাম আমাদের বন্ধু খলিল মারা গেছেন। জানাজা হবে সকালবেলা নাঙ্গলকোটের গ্রামের বাড়িতে। আসর জমানো যুবক ছিল খলিল। সেই খলিল নেই। আমরা ঢাকা ফিরব না কুমিল্লায় ফেরত যাব চিন্তায় পড়ে গেলাম। তিনজনই মন খারাপ করলাম। কিন্তু আমাদের আর ফেরা হলো না। ঢাকার পথেই আমাদের গাড়ি ছুটছে। কিন্তু পথে দুটি ঘটনা ঘটল। যার কোনো ব্যাখ্যা নেই। অথবা আছে। প্রথমটি ভৈরব ব্রিজ পার হতেই। পাশের লরি থেকে একটি বড় কনটেইনার ছিটকে পড়ল আমাদের গাড়ির পাশ ঘেঁষে। চমকে উঠলাম সবাই। বেঁচে গেলাম, ড্রাইভার গাড়ি এগিয়ে নিয়ে চলল। আমরা কিছুটা ভয় পেলাম। দ্বিতীয়টি কালিগঞ্জ পার হওয়ার পর। ড্রাইভার ঘুম চোখে গাড়ি সড়কের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে, আমরা তিনজন একসঙ্গে চিৎকার করে উঠলাম। চিৎকারে কাজ হলো। কোনোমতে গাড়ি আবার মূল সড়কে ফিরে এলো। খলিলের মৃত্যু এবং এ দুটি ঘটনার কি কোনো ব্যাখ্যা আছে? দুনিয়া বড়ই রহস্যময়।

কুমিল্লা-১১ আসনের এমপি জয়নাল আবেদীন ভূইয়ার মৃত্যুর পরের ঘটনা। নাঙ্গলকোট থেকে ঢাকায় ফেরার পথে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কুমিল্লায় তিনি মারা যান। হৃদরোগে আক্রান্তের ৩০ মিনিট আগেও আমার সঙ্গে কথা হয়েছিল। ঢাকা আসছেন। জরুরি কথা আছে আমার সঙ্গে। বসবেন। এটিএন বাংলাতে কাজ করি তখন। জয়নাল ভাইয়ের মৃত্যুর পর নিকটজনরা আমাদের সতর্ক করলেন, সাবধান! জয়নাল ভাই একা থাকতে পারবেন না। সঙ্গী-সাথী খুঁজবেন। কাউকে না কাউকে নিয়ে যাবেন। তাই হলো। কয়েক মাস পরই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন আমাদের এক সঙ্গী মমিন। জয়নাল ভাইয়ের সঙ্গে সারাক্ষণ লেগে থাকতেন। ঢাকায় ব্যবসা করতেন। জয়নাল ভাই তার অফিসে বসতেন মাঝে মাঝে। জানি এ ঘটনারও কোনো ব্যাখ্যা নেই। ছোটবেলায় আমি কিছুদিন হাসপাতালে ছিলাম। আমার পাশের বেডে এক ভদ্রলোক ছিলেন। তিনি আমাকে বই পড়তে দিতেন। আমার বই পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে। ভদ্রলোক এক রাতে মারা গেলেন। সকালে ঘুম থেকে ওঠে জানলাম, মানুষটি চলে গেছেন। রাতেই পরিবার-পরিজন লাশ নিয়ে গেছে। ভীষণ মন খারাপ হলো। তারপর কিছুদিন দেখতাম ভদ্রলোক বসে আছেন তার বেডে। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন মিটমিট করে। আমি ভয় পেতাম। বিষয়টি ডাক্তারকে বললাম। ডাক্তার বললেন হেলুসিনেশন। সেই হেলুসিনেশন কাটাতে আমার সময় লেগেছিল। আমার শ্বশুর সাখাওয়াত হোসেন ভূঁইয়া মারা গেলেন গত সপ্তাহে। তিনি অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। মৃত্যুর সময় আমি পাশে ছিলাম। ইউনাইটেড হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়েছেন টানা ২৫ দিন। তার চার সন্তান দেশের বাইরে থাকে। কুয়েত থেকে এলো বড় ছেলে। বাকি দুই ছেলে লন্ডন থেকে। তিনি সবার সঙ্গে কথা বলেছেন। অপেক্ষা করেছেন কানাডা থেকে ছোট মেয়ে আসার। সেই মেয়েটিও আসার একদিন পরই তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে বড় মেয়ে ফরিদা ইয়াসমিনকে কাছে টানলেন। আদর করলেন। বিদায় নিলেন। তারপর চলে গেলেন। আমার বাবা মোখলেসুর রহমান ভূঁইয়ার মৃত্যুর সময়ও পাশে ছিলাম। বাবা মারা গেছেন খবর শুনেই দ্রুত গ্রামের বাড়ি গেলাম। গিয়ে দেখলাম তিনি তখনো মারা যাননি। শেষ মুহূর্ত। আমাদের সঙ্গে কথা বললেন। কাছে টানলেন। তারপর চলে গেলেন।

প্রয়াত কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের মৃত্যুর ঘটনা মনে পড়ছে। ২০০৮ সালে তিনি সুইডেন গেলেন পানিবিষয়ক একটি সম্মেলনে যোগ দিতে। সেখান থেকে যান যুক্তরাষ্ট্রে। ছিলেন পুত্র সাইফুল ইসলাম সিদ্দিকের বাসায়। এক সকালে আমি তার পাঠানো ই-মেইল পড়ছিলাম। তিনি জানিয়েছেন, নিউজার্সিতে রমজান মাস কাটাবেন। ঈদের পর ফিরবেন দেশে। আমি উত্তর লিখছিলাম, তখনই ফোনে জানলাম কামরুল ইসলাম সিদ্দিক আর নেই। দুনিয়াটা আসলেই সাময়িক। এত লড়াই, এত সংগ্রামের কোনো মানে হয় না। মানুষের সম্পর্ক অনেক ঠুনকো। কারণ মানুষ খুব দ্রুত পরিবর্তনশীল। কিছু মানুষ একটি নির্দিষ্টগণ্ডিতে নিজেকে আবদ্ধ রাখতে পারে না। অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারে না। সামান্য বিষয়কে উসিলা করে নিজেকে বদলে দেয়। খোলস পরিবর্তনেই আনন্দ। এক জীবনে মানুষ অনেক কিছু পায় না। এক বয়সে জীবনের গতিতে লাগাম আসে। জীবনের প্রতি বিরক্ত হয়ে কবি নজরুল একদিন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। দীর্ঘসময় বাকরুদ্ধ ছিলেন। কবি কি টের পেয়েছিলেন তার এমন হবে? না হলে তিনি লিখলেন কেন, ‘যদি আর বাঁশি না বাজে আমি কবি বলে বলছি না, আমি আপনাদের ভালোবাসা পেয়েছিলাম সে অধিকারে বলছি, আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন। আমায় ভুলে যাবেন।... আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরবে অভিমানে চিরদিনের জন্য চলে যাব।’ নজরুল তার জীবদ্দশায় প্রিয় সন্তানকে হারিয়েছিলেন। ছোটবেলায় হারিয়েছিলেন বাবা-মাকে। পারিবারিক মৃত্যুর কষ্ট নজরুলের চেয়ে বেশি ছিল রবীন্দ্রনাথের। রবি ঠাকুর মাত্র ১৪ বছর বয়সে মা সারদাসুন্দরী দেবীকে হারান। আর স্ত্রী মৃণালিনীর মৃত্যু হয় মাত্র ৩০ বছর বয়সে। রবীন্দ্রনাথের জন্য আরেকটি কষ্টের মৃত্যু ছিল বৌদির আÍহত্যা। যা কঠিনতম ছিল তার জন্য। প্রথম জীবনে বৌদি কাদম্বরি দেবীই তাকে লেখালেখিতে উৎসাহিত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের জীবনের সুখের চেয়ে দুঃখ ছিল বেশি। শুধু স্ত্রী নয়, সন্তানের মৃত্যুও তাকে ব্যথিত করেছিল। মেয়ে রেনুকা দেবী রানী, মাধবীলতা, পুত্র শমিন্দনাথের মৃত্যুর যাতনা ছিল ভয়াবহ। রবীন্দ্রকন্যা রানীর বিয়ে হয়েছিল ১০ বছর বয়সে। এ বিয়েতে রবীন্দ্রনাথের মত ছিল না। কিন্তু অনেকটা স্ত্রীর চাপেই বিয়েতে তিনি মত দিয়েছিলেন। তার হলো যক্ষা। কলকাতায় নিয়ে গেলেন কবি তাকে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। চলে গেলেন মেয়েটি। কবি পরিবারে যক্ষার আক্রমণ বারবার এসেছিল।

রবীন্দ্রনাথ অনেকগুলো বর্ষার গান লিখেছিলেন। শমিন্দনাথ একদিন বাবাকে বললেন, বর্ষার গান নিয়ে একটা উৎসব হোক না। পুত্রের উৎসাহে এরপর থেকে বর্ষা মঙ্গল ও বসন্ত উৎসব শুরু। রবীন্দ্রনাথ কলকাতা যাচ্ছিলেন। পুত্র বলল, বন্ধুদের সঙ্গে যাবে ভাগলপুর। সাত দিন পর রবীন্দ্রনাথ টেলিগ্রাম পেলেন শমিনের কলেরা হয়েছে। কবি গুরু ছুটলেন। যখন পৌঁছলেন জানলেন, সব শেষ। তার প্রিয় সন্তানের দেহ শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিকালেই শান্তিনিকেতনের পথ ধরলেন কবি। বোলপুর স্টেশন থেকে শান্তিনিকেতনের দূরত্ব মাইল দেড়েক। ক্ষিতিমোহন সেন, বিধুশেখরসহ অনেক সহকর্মী স্টেশনে এসেছেন কবিকে নিয়ে যেতে। তারা শমিনের মৃত্যুর খবর জানতেন না। তারা জানতেন শমিন কবির সঙ্গেই ছিলেন। ভাগলপুরে পুত্র আর পিতা ছিলেন কলকাতায়। শেষ দেখাও তাদের হয়নি। একজন প্রশ্ন করলেন, শমিন কোথায়? কবি কথা বললেন না। ভারাক্রান্ত মনে পালকি কিংবা ঘোড়ার গাড়িতেও চড়লেন না। তিনি হাঁটতে শুরু করলেন। সেদিন আকাশে ছিল জ্যোৎস্না। চারদিকে সুনসান নীরবতা। কবি কারও সঙ্গে কথা না বলে হাঁটছেন। চাঁদের আলোতে চারদিক মাখামাখি। জ্যোৎস্না রাতে নির্বাক কবি। বাড়ি ফিরে দোতলায় উঠার সময় কবি সবার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, শমিনকে রেখে এসেছি।

কবির জীবনে আরও শোক ছিল। যক্ষা কবির পিছু ছাড়েনি। এর কয়েক বছর পর প্রিয় কন্যা মাধবীলতা যক্ষায় আক্রান্ত হলেন। কন্যার জামাতার সঙ্গে কবির ভালো বনিবনা ছিল না। এই কারণে জামাই যখন হাইকোর্টে প্রাকটিস করতে যেতেন কবি আসতেন কন্যার কাছে। দুপুর বেলা কন্যা বাবাকে পাখা দিয়ে বাতাস করতেন। বাপ কন্যার গল্প হতো অনেক। একদিন দুপুরে কবি আসলেন কন্যার বাড়িতে। চিৎকার আর কান্না শুনলেন ভিতর বাড়ি থেকে। কবি বুঝলেন এই কন্যাটিও তাকে ফাঁকি দিয়েছে। তিনি আর গাড়ি থেকে নামেননি। বিকালে বিচিত্রা ক্লাবে গেলেন কবি। মনটা ভীষণ খারাপ। কিন্তু কাউকে কিছু বলছেন না। দু-একজন জানত মাধবীলতা আর নেই। কবি লিখলেন, ‘হে মাধবী দ্বিধা কেন, আসিবে কি ফিরিবে কি/ আঙ্গিনাতে বাহিরিতে, মন কেন গেল ঠেকি।’ কবির জীবনে প্রথমে গেলেন স্ত্রী, তারপর একটি মেয়ে। তারপর ছেলে। এরপর আরেকটি মেয়ে। এভাবেই যেতেই থাকল। কবি বেঁচে ছিলেন ৮১ বছর। কন্যার স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ার বিষয়টিও কবিকে কষ্ট দিয়েছিল। এক পুত্র, এক কন্যা নিয়ে মীরা বাবার কাছে চলে আসেন। কবি আঁকড়ে ধরলেন নাতি, নাতনি আর কন্যাকে। কিন্তু কবির জীবনের শেষ কষ্টটিও এখানে। আবার যক্ষার আক্রমণ। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল মীরা দেবীর ছেলে নীতু। শেষ বয়সে নাতির এই মৃত্যুশোক কবিকে ভারাক্রান্ত করে। ভেঙে পড়েন কবি।

মৃত্যু নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের অনেক আক্ষেপ ছিল। কষ্ট ছিল। ক্যান্সার আক্রান্তের পর লেখকের আক্ষেপগুলো অনেক বেশি আকারে বেরিয়ে আসে। তার শেষ লেখাগুলোতে ছিল বেঁচে থাকার আকুতি। একটা কচ্ছপের জীবন সাড়ে তিনশত বছর। মানুষ কেন এত অল্প সময় বাঁচে? মৃত্যুর কিছুদিন আগে হুমায়ূন আহমেদ ওয়াশিংটন যান। পারিবারিক এক বন্ধুর বাড়িতে জমে ওঠে আড্ডা। স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন খালি কণ্ঠে গান গাইলেন, ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়রে... সূরা ইয়াসিন পাঠ করিও বসিয়া কাছায়...’ শাওন গাইছেন। হুমায়ূন কাঁদছেন। চোখের পানি মুছছেন। আহারে এই দৃশ্যটি ইউটিউবে দেখার পর আমার অনেক দিন মন খারাপ ছিল। আহারে আমাদের চাঁদের আলো বুঝানো, বৃষ্টির আনন্দ জানানো মানুষটি শিশুর মতো চোখ মুছছেন। মৃত্যু মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়? হুমায়ূন এই নিয়ে লিখেছেন তার আকাশ জোড়া মেঘে, ‘অসম্ভব ক্ষমতাবান লোকেরা প্রায় সময় নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যায়।’ দেবী বইতে লিখেছেন, ‘মৃত্যুর সময় পাশে কেউ থাকবে না, এর চেয়ে ভয়াবহ বোধহয় আর কিছুই নেই। শেষ বিদায় নেওয়ার সময় অন্তত কোনো একজন মানুষকে বলে যাওয়া দরকার নিঃসঙ্গ ঘর থেকে একা একা চলে যাওয়া যায় না, যাওয়া উচিত নয়। এটা হৃদয়হীন ব্যাপার।’


লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

 
বিডি-প্রতিদিন/ ২৯ অক্টোবর, ২০১৫/ রশিদা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর