২ নভেম্বর, ২০১৫ ১৩:০৩
টরেন্টোর চিঠি

পাগলরা শেষ ঘটনাটাই কেবল মনে রাখে!

শওগাত আলী সাগর

পাগলরা শেষ ঘটনাটাই কেবল মনে রাখে!

গ্রামের হাটে ঘুরে বেড়ানো পাগলিটাকে একদিন তুলে নেয় প্রভাবশালী পরিবারের এক যুবক। পাশবিক অত্যাচার শেষে আবার রেখে যায় হাটের মুখে। কিছুটা পথ যাওয়ার পর আবার ফিরে আসে সে যুবক। কষে কয়েকটা থাপ্পড় লাগিয়ে দেয় পাগলিটাকে। যুবকের সঙ্গে থাকা আরেক তরুণ জানতে চায়, পাগলিটাকে তো ধর্ষণই করলি, আবার মারলি কেন?

পাগলরা শেষ ঘটনাই কেবল মনে রাখে। নির্বিকার চিত্তে জবাব দেয় যুবক।

- মানে?

- মানে একদম সহজ।  আমি থাপ্পড় না মারলে পাগলি সবাইকে ধর্ষণের কথা বলে বেড়াত। এখন থাপ্পড়ের কথা বলবে, ধর্ষণের কথা তার আর মনে থাকবে না।

আমাদের অবস্থা ওই পাগলির মতো। আমরা প্রতিনিয়ত ধর্ষিত হই, সেই ধর্ষণের কথা ভুলিয়ে দিতে আমাদের কষে থাপ্পড় মারা হয়। আমরা সেটা নিয়েই কথা বলতে থাকি।

একদিন আগেও আমরা ফেনীর মায়ের গর্ভে শিশু খুন নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছিলাম। এর আগে মাগুরায় মায়ের গর্ভে এক শিশু গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। এবার মাতৃগর্ভে খুন করা হলো এক শিশুকে। জম্মের আগেই খুন হয়ে যাওয়ার মধ্যে একটা অভিনবত্ব আছে বৈকি। সন্ত্রাসের এই ‘ক্রিয়েটিভিটির’ জন্য ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররা পুরস্কার দাবি করতে পারে নিঃসন্দেহে। যে কথা বলছিলাম। ফেনীর মায়ের গর্ভে খুন হয়ে যাওয়া শিশুটিকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ফুসফুসানি শুরু হয়েছিল। বেশ কঠিন কথাবার্তা বলতে শুরু করেছিলেন বিভিন্নজন। এরই মধ্যে খুন হয়ে গেলেন শামসুল আরেফিন দীপন। সঙ্গে সঙ্গে আমরা মাতৃগর্ভে শিশু খুন ভুলে গিয়ে দীপনকে নিয়ে আহাজারি শুরু করেছি। আমরা জানি, কেউ এসে কষে আরেকটা থাপ্পড় না দেওয়া পর্যন্ত দীপনকে নিয়ে আমাদের আহাজারি চলতে থাকবে। এই আহাজারিগুলো যে কেবল নীরব কান্না হয়েই থাকবে, বিক্ষোভের কোনো স্ফুলিঙ্গ সেখান থেকে তৈরি হবে না, কিংবা তৈরি হতে দেওয়া হবে নাÑ সেটা আমাদের শাসকরা ভালোই বুঝে গেছেন। নইলে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের পরও সরকার এতটা নিস্পৃহ থাকতে পারত না।

যে কোনো খুনের মামলার তদন্ত কিংবা বিচারে খুনের মোটিভ যেমন বিবেচনায় নেওয়া হয়, তেমনি খুনের ‘বেনিফিসিয়ারি’ কে বা কারা, সেটিও গুরুত্ব দেওয়া হয়। সাবেক রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেননি। আমরা তবু তাকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত করি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রধানতম বেনিফিসিয়ারি হিসেবেই জেনারেল জিয়াকে খুনিদের কাতারে ফেলা হয়। মুক্তমনা লেখকদের হত্যার এই মহোৎসবের বেনিফিসিয়ারি কে? কারা? তাদের কি আমরা খুনিদের কাতারেই বিবেচনা করব? যেমনটি করি বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়াকে?

ব্লগার, মুক্তমনা লেখকদের হত্যাকাণ্ডে রাষ্ট্রের তথা সরকারের ভ‚মিকা কী? একের পর এক ব্লগার-মুক্তমনা লেখক খুন হয়ে যায়, রাষ্ট্র কোনো খুনিকেই চিহ্নিত করতে পারে না, গ্রেফতার করতে পারে না। সরকার কি সত্যি এতটা অক্ষম? নাকি ইমরান এইচ সরকার যে অভিযোগ করেছেন, ‘ব্লগার হত্যায় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা আছে’Ñ সেটাই সত্য। ব্লগারদের যারা খুন করেছে তারা এই দেশেরই সন্তান। খুন করার পরও তারা এই সমাজেই বসবাস করে। অথচ রাষ্ট্র তাদের চিহ্নিত করতে পারে না, গ্রেফতার করতে পারে না। তা হলে রাষ্ট্রের এত গোয়েন্দা সংস্থা, নানা ধরনের বাহিনী পুষে কি লাভ? সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি সত্যিই এতটা অক্ষম? নাকি তাদের এ ব্যাপারে বেশি দূর এগুতে দেওয়া হয় না। কোনটা সত্য?

সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মুক্তমনা লেখকদের খুনিদের চিহ্নিত করতে না পারলেও একটি গোষ্ঠী কিন্তু নিজ থেকেই সব সময় খুনগুলোর দায়দায়িত্ব স্বীকার করে নেয়। এ পর্যন্ত প্রতিটি খুনের পর সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই ‘আনসার আল ইসলাম’ নামের একটি গ্রুপ হত্যাকাণ্ডের দায়দায়িত্ব স্বীকার করে নিয়েছে। কিছু দিন আগ পর্যন্ত পুলিশও আনুষ্ঠানিকভাবে ‘আনসার আল ইসলাম’-এর ওপর খুনের দায়দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলত। এখন অবশ্য তারাও আর এ নামটি উচ্চারণ করছে না। র‌্যাব-পুলিশের জন্য এটি একটি অস্বস্তিকর অবস্থা তো বটেই। কিছু দিন আগেও তারা ‘আনসার আল ইসলামের’ নাম অনায়াসে বলে দিতে পারত। এখন কারা খুন করেছে, সে ব্যাপারে বলার মতো কোনো তথ্যই তাদের কাছে আর থাকছে না। একটা রাষ্ট্রের নিয়মিত বাহিনী এতটা অক্ষম হয় কীভাবে?

আচ্ছা, এই ‘আনসার আল ইসলাম’ জিনিসটা কি? আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা এবং মিডিয়ার কাছে এটি ইসলামিক স্টেট একটি সহযোগী জঙ্গি সংগঠন। তাদের আধ্যাÍিক নেতা মুফতি জসিম উদ্দিন রহমানী পুলিশের হাতেই আছে। কিছু দিন আগে সরকারের এক প্রতিমন্ত্রীর আত্নীয় আটক হয়েছিলেন আরেক ব্লগার হত্যা মামলায়। পুলিশ আমাদের জানিয়েছিল, প্রতিমন্ত্রীর এই আত্নীয়প্রবরটি আনসার আল ইসলামের কেউকেটা। আওয়ামী লীগের নতুন সহযোগী সংগঠন ওলামা লীগ সংবাদ সম্মেলনেই দাবি করেছে, ওলামা লীগের অপর অংশ আসলে ‘আনসার আল ইসলাম’। তার মানে কি? মানে হচ্ছে, আনসার আল ইসলাম সম্পর্কে পুলিশ, ক্ষমতাসীন মহলের কেউ কেউ ওয়াকিবহাল আছেন। তা হলে ব্লগার-মুক্তমনা লেখকদের খুনিরা ধরা পড়ে না কেন?

ক্ষমতাসীন সরকারের মন্ত্রী, নেতাদের কাছে অবশ্য আনসার আল ইসলাম হচ্ছে বিএনপি-জামায়াত-শিবিরেরই একটি অংশ। আমরা আমাদের সরকারের নেতা-মন্ত্রীদের কথাই বিশ্বাস করব। আমরাও ধরে নেব আনসার আল ইসলাম আসলে বিএনপি-জামায়াত জোটের একটি জঙ্গি সংগঠন। ক্ষমতায় না থাকা বিএনপি-জামায়াত জোটের এত দাপট যে, একটি রাষ্ট্র, একটি সরকার তার কাছে অসহায়? নেতা-মন্ত্রীরা জানেন, কারা খুন করছে, বক্তৃতা-বিবৃতিতে সেটি বলছেনও। অথচ খুনিদের ধরতে পারছেন না, খুন ঠেকাতেও পারছেন না। সরকার তাদের টিকিটিও স্পর্শ করতে পারে না! এমন ‘অক্ষম’ সরকার  নিয়ে আমরা কী করব?

কাউকে কাউকে বলতে শুনি, সাকা-মুজাহিদের রায় সামনে সে জন্য দীপনকে খুন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মাহাবুবুল হক শাকিল বলেছেন, শেখ হাসিনার অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। মন্ত্রীদের কেউ কেউ বলছেন, সরকারকে অস্থিতিশীল করতে দীপনকে খুন করা হয়েছে। সরকারের ভাবনা চিন্তারও কিন্তু একটা বিপজ্জনক দিক আছে। একটা সরকার যখন সারাক্ষণ ‘ষড়যন্ত্র, ষড়যন্ত্র’ জপতে থাকে এবং সেই ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়, তখন সেই সরকারকে নিয়ে জনগণের চিন্তিত না হয়ে উপায় থাকে না।

তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সঙ্গে যারা ব্লগার মুক্তমনা লেখকদের হত্যাকে মিলাতে চান, তাদের সঙ্গে আমি দ্বিমত পোষণ করি। বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগের কোনো নেতা গ্রেফতার হলে তারা কিন্তু লেখক সাংবাদিকদের পেটাতে যেতেন না। তারা রাস্তায় গাড়ি ভাঙতেন, বিআরটিসি বাসে আগুন দিতেন।  যুদ্ধাপরাধের বিচারের সঙ্গে  মুক্তমনা লেখকদের হত্যাকে জড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে এক ধরনের ক‚টকৌশল আছে বলেই মনে হয়।

সব ধরনের ক্ষোভ, হতাশা, অবিশ্বাস নিয়েও আমাদের রাষ্ট্রের সামনেই দাঁড়াতে হয়, আমরা রাষ্ট্রের সামনেই দাঁড়াতে চাই। একের পর এক ব্লগার মুক্তমনা হত্যা, একটিরও বিচার তো দূরের কথা খুনিদের গ্রেফতার না হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের একটা জিনিস খুব জানতে ইচ্ছা করে। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সত্যিকার অর্থে কতটা তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছে? তাদের তদন্ত কি তথাকথিত আনসার আল ইসলামের স্বীকারোক্তিকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে? নাকি তৃতীয় কোনো পক্ষের সম্পৃক্ততার সম্ভাবনাটিও বিবেচনায় ছিল?  নাকি তারা কেবলই সময় কেটে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন, অপেক্ষায় থাকেন?

                লেখক : টরেন্টোর বাংলা পত্রিকা ‘নতুন দেশ’-এর সম্পাদক।

সর্বশেষ খবর