১৬ জানুয়ারি, ২০১৬ ১৬:০২

উত্তপ্ত দশদিগন্ত! প্লিজ মাথা ঠাণ্ডা রাখুন!

গোলাম মাওলা রনি

উত্তপ্ত দশদিগন্ত! প্লিজ মাথা ঠাণ্ডা রাখুন!

প্রধানমন্ত্রী প্রদত্ত এবারের ভাষণটি ছিল বেশ তাত্পর্যময় এবং ইঙ্গিতপূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে আয়োজিত জনসভায় ভাষণরত প্রধানমন্ত্রীকে বেশ ক্লান্ত এবং ত্যক্ত-বিরক্ত বলেই মনে হচ্ছিল। তার কণ্ঠস্বরে মান-অভিমান, গোসা এবং খেদ ছিল— ছিল বাহারি অভিযোগ। অন্যান্য অনুষ্ঠানে তিনি সাধারণত প্রাসঙ্গিক বিষয় অর্থাত্ অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু নিয়ে কিছু বলার পরপরই বিরোধী দল বিশেষত জামায়াত-বিএনপি নিয়ে ঝাঁজালো বক্তব্য দেন।  সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা নিয়েও নাতিদীর্ঘ বক্তব্য রাখেন। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সেদিনের জনসভায় তিনি আন্দোলনরত ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়ে নানা ধরনের কথাবার্তা বলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর দিয়ে মেট্রোরেলের রুট নিয়ে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধেও তিনি একাধিক কথা বলেন। বক্তব্যের একপর‌্যায়ে তিনি আক্ষেপের সুরে বলতে থাকেন— যার জন্য চুরি করি সে-ই বলে চোর।

প্রধানমন্ত্রীর আক্ষেপের সুনির্দিষ্ট কতগুলো কারণও রয়েছে। সর্বস্তরের সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন বাড়ানোর পাশাপাশি বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনও বাড়িয়েছেন। সরকারি হিসাব মতে, এই বৃদ্ধির হার গড়ে ১২৬%-এর চেয়েও বেশি। সরকার দাবি করছে, এ ধরনের ব্যাপক বেতন বৃদ্ধি বাংলাদেশ তো নয়ই, ইতিপূর্বে পৃথিবীর কোনো দেশেই ঘটেনি। কাজেই সরকার বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী আশা করেছিলেন, বেতনভাতা বৃদ্ধির পর চারদিকে ধন্য ধন্য রব পড়ে যাবে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেতন বৃদ্ধির কারণে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে আনন্দ মিছিল করবেন এবং ঘুষ-দুর্নীতি বাদ দিয়ে যার যার কর্মস্থলে অধিক মনোযোগ, যত্ন এবং পরিশ্রমসহকারে প্রজাতন্ত্রের সেবা করবেন।

২০১৬ সালে এসে সরকার যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে তাতে বেতন বৃদ্ধি তো দূরের কথা— পূর্বেকার বেতনভাতা নিয়মিত পরিশোধই রীতিমতো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা কিংবা অনিশ্চয়তার কথা না হয় বাদই দিলাম। দেশের মোট রাজস্ব আদায় এখন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দেশজ উত্পাদন বা জিডিপির পরিমাণ বাড়লেও সরকারের রাজস্বে কোনো প্রভাব ফেলবে না। কারণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কৃষিজ উত্পাদন, গবাদিপশু লালন-পালন, খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের আয়-রোজগার থেকে সরকার কোনো অর্থ লাভ করে না। সরকারের আয়ের প্রধান উৎস হলো আমদানি করা পণ্যের বিপরীতে আদায়কৃত আবগারী শুল্ক, ভ্যাট এবং অগ্রিম আয়কর। এরপর রয়েছে বিক্রয় পর‌্যায়ে আদায়কৃত ভ্যাট এবং আয়কর। দেশের রপ্তানি খাত থেকে খুব সামান্য হারে অগ্রিম আয়কর আদায় ছাড়া অন্য কোনো শুল্ক সরকার পায় না। ফলে রাজস্ব আদায়ের সীমিত ক্ষেত্র নিয়ে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি রীতিমতো একটি অতি দুঃসাহসিক কর্মে পরিণত হয়েছে।

বর্তমান সরকার প্রথম মেয়াদে অর্থাত্ ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ক্ষমতায় আসার পর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। বিশেষ করে প্রাথমিক এবং গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা পদে কয়েক লাখ নতুন মুখ নিয়োগ লাভ করে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ডাক্তার এবং কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যকর্মী মিলিয়ে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত লোকবলের সংখ্যাও প্রায় দুই লাখ। পুলিশ, আনসার, বিডিআর এবং সেনাবাহিনীতে নিয়োগ লাভ করে কয়েক লাখ নতুন জনশক্তি। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, রেলওয়েসহ সরকারের অন্যান্য বিভাগ-অনুবিভাগে নিয়োগকৃত নতুন লোকবলের কারণে সরকারের ব্যয় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। কেবল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা বাবদ সরকারকে ব্যয় করতে হয় জাতীয় বাজেটের ৩৩% অর্থ যা দুনিয়ার কোথাও নেই।

বর্তমান সরকারের আমলে সরকারি প্রতিষ্ঠানে বিপুলসংখ্যক জনবল নিয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রের কতটুকু লাভ হয়েছে কিংবা দেশের বেকার সমস্যার কতটুকু উপশম হয়েছে এমন বিষয়াদি নিয়ে জনগণ মাথা ঘামায় না। অন্যদিকে সরকারের রাজনৈতিক ফায়দা কতটুকু হাসিল হলো তাও বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু ব্যয় বৃদ্ধির কারণে রাষ্ট্র যে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে তা বেশ স্পষ্ট।

আমাদের সামাজিক জীবন, বিয়েশাদি, পূজা-পার্বণ এবং অন্যান্য আনন্দ অনুষ্ঠান পালনে গত দুই বছরে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বিশেষত মন্ত্রী-এমপিরা অনেক অনুষ্ঠানের শোভাবর্ধন করতেন। মাঝেমধ্যে ডাকসাইটে সামরিক-বেসামরিক আমলাদেরও দেখা যেত অনুষ্ঠানের মধ্যমণি হিসেবে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্বেকার সেই সামাজিক রীতিটির কবর রচনা হয়েছে। আজ আর অনুষ্ঠানগুলোতে মন্ত্রী-এমপি এবং আমলাদের তেমনটা দেখা যায় না। হয়তো তাদের দাওয়াত প্রদান করা হয় না, নতুবা দাওয়াত পাওয়ার পরও তারা আসেন না। অনুষ্ঠানের বাইরে রাস্তাঘাট, হাটবাজার, পার্ক এবং বিনোদন কেন্দ্রগুলোতেও তারা যান না। কদাচিত্ কোথাও যদিবা তাদের দু-একজনের দেখা মেলে তাহলে দেখা যায়, হয় তাদের কেউ চেনেন না বা না চেনার ভান করেন নতুবা তারা চান না লোকজন তাদের চিনুক এবং তাদের পদপদবি জেনে ফেলুক। ক্ষমতাসীন ক্ষমতাবান লোক এবং সাধারণ মানুষের মাঝে উপরোক্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব, ভয়ভীতি এবং দূরত্ব যতটা না সমস্যার সৃষ্টি করছে তার চেয়েও বেশি সমস্যা দেখা দিয়েছে সরকারের মদদপুষ্ট আমলা-কর্মচারী, পেশাজীবী এবং রাজনৈতিক কর্মীর মধ্যে। আমলারা মনে করছেন তাদের কারণেই সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব অবশ্য আমলাদের এই দাবি সর্বান্তকরণে মেনে নিয়েছেন। সচিব পর‌্যায়ের কর্মকর্তা তো দূরের কথা, বর্তমান এমপি-মন্ত্রীদের কোনো ডিসি-এসপি পাত্তা দেন এমন দৃশ্য বিরল। অন্যদিকে, উপজেলা পর‌্যায়ের নির্বাহী কর্মকর্তা এবং থানার ওসিরা এমপিকে কি মনে করেন তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন। যেসব মন্ত্রী-এমপির মান-সম্মানবোধ রয়েছে, কিংবা যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার যোগ্যতা রাখেন তারা কৌশলে গা বাঁচিয়ে কোনো মতে টিকে রয়েছেন। অন্যদিকে বিনাভোটে নির্বাচিত করুণাপ্রাপ্তরা পথেঘাটে হরহামেশা অপমানের শিকার হচ্ছেন। সচিবালয়ের উপসচিব কিংবা যুগ্ম সচিব পর‌্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য কোনো কোনো এমপির পূর্বানুমতির দরকার হয়ে পড়ে...।

বর্তমান সরকারের কোনো এমপি-মন্ত্রী, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র কিংবা জেলা পরিষদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ গত দুই বছর ধরে ভুলেও কোনো সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে ক্ষমতা বা প্রভাব দেখাতে চেষ্টা করেননি। অন্যদিকে, মন্ত্রী-সচিবের পুরনো দ্বন্দ্ব এখন নেই বললেই চলে। কিছু কিছু মন্ত্রণালয় তো সচিবদের অঙ্গুলি হেলনে চলছে। অর্থ, শিক্ষা, স্বরাষ্ট্র এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের কতটুকু ক্ষমতা, প্রভাব এবং নিয়ন্ত্রণ রয়েছে তা নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের কথা না হয় বাদই দিলাম। ক্ষমতার বলয় থেকে রাজনীতিবিদদের বাদ দিয়ে আমলারা এবার নিজেদের মধ্যে শুরু করেছেন দ্বন্দ্ব এবং রেষারেষি। সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছে অনেকগুলো গ্রুপ। প্রথম গ্রুপিংটি হলো ক্যাডারভিত্তিক গ্রুপ— তারপর ব্যাচভিত্তিক উপগ্রুপ। জেলা, বিভাগ এবং ধর্মভিত্তিক গ্রুপও বেশ সক্রিয়। ক্ষমতাসীন দলের মদদপুষ্ট এবং বিরোধী দলের মদদপুষ্ট গ্রুপ রাজনীতি এখন নেই বললেই চলে। বর্তমান জমানায় সবকিছুই সরকারি দলের পরিচয়ে চলে। তবে এ ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য বিপরীতমুখী বিবর্তন ঘটে গেছে। পূর্বে সরকারি দলের মদদপুষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মূল দলের কোনো রাজনৈতিক নেতার অঙ্গুলি হেলনে চলতেন আর এখন শোনা যাচ্ছে, কর্মকর্তাদের এই গ্রুপের সঙ্গে ওমুক নেতা রয়েছেন।

ক্ষমতার রাজ্যে একক কর্তৃত্ব ভোগকারী সরকারি কর্তারা বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা, গোত্র, দল-উপদল এবং স্তরে বিভক্ত হয়ে একে অপরের ওপর ক্ষমতাবান হওয়ার চেষ্টা করছে। নিজেদের ক্ষমতাবান, ঐশ্বর্যবান এবং প্রভাবশালী প্রমাণ করার জন্য তারা নানান অনৈতিক এবং প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের আশ্রয় নিচ্ছেন প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে দুর্বল করার জন্য। বাংলাদেশের এই মুহূর্তের রাজনৈতিক ক্ষমতার একমাত্র প্রতিভূ হলেন প্রধানমন্ত্রী। কাজেই তার বাসভবন এবং কর্মস্থলকেন্দ্রিক ক্ষমতার বলয় সৃষ্টি করে ধুরন্ধর কর্মকর্তারা নানামুখী তত্পরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তারা সবার আগে চেষ্টা করেন যে কোনো মূল্যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একবারের তরে হলেও দেখা করার জন্য। পরের ধাপে তারা প্রধানমন্ত্রীর কার‌্যালয় বা বাসভবনের স্টাফদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন এবং সেই সুবাদে মাঝেমধ্যে ওখানে ঢুকে ২-১ কাপ চা খেয়ে আসেন। এরপর তারা ঢাকঢোল পিটিয়ে সবাইকে গণভবন এবং প্রধানমন্ত্রীর কার‌্যালয়ের নানা কল্পকাহিনী বানিয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে শুনাতে থাকেন। তাদের গল্প-স্বল্প শুনে দুর্বল চিত্তের আমলা তো দূরের কথা— অনেক মন্ত্রী-এমপিও দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যান।

গত দুই বছরে প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে দলীয়করণ, কাজ না করে প্রমোশন প্রাপ্তি, নির্ভয়ে অন্যায় করার দম্ভ এবং প্রতিপক্ষকে বোকা বানিয়ে নাজেহাল করার দক্ষতার কারণে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে সহসা নিস্তার লাভের কোনো উপায় নেই। সরকারি প্রশাসন যন্ত্র নিয়ন্ত্রণের একমাত্র মাধ্যমটি হলো সুষম রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। কোনো সরকার যদি রাজনৈতিক ভিত্তি এবং ক্ষমতা হারিয়ে টিকে থাকার জন্য আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তবে আমলারা সেই সুযোগটি গ্রহণ করেন পুরোমাত্রায়। বর্তমান সরকার সরকারি কর্মচারীদের বেতনভাতা বৃদ্ধি করে যে কৃতিত্ব নিতে চাচ্ছে আমলারা তা স্বীকার করতেই রাজি নন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ তো দূরের কথা উল্টো তারা মনে করছেন সরকার নিজেদের টিকে থাকার স্বার্থেই বেতনভাতা বৃদ্ধি করেছে।

এদিকে বেতন বৃদ্ধি নিয়ে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তর, ক্যাডার এবং নন-ক্যাডার সার্ভিস, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকমণ্ডলীর মধ্যে যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে তার পেছনে রয়েছে প্রশাসন ক্যাডারের একশ্রেণির কর্মকর্তার বাড়াবাড়ি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ, বেতন কমিশনের সুপারিশ এবং মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের পরামর্শকে উপেক্ষা করে যে বেতন কাঠামো ঘোষণা করা হয়েছে তাতে বেশির ভাগ মানুষ খুশি হওয়ার পরিবর্তে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। এখন সরকার যদি মাথা ঠাণ্ডা রেখে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা না করে তবে বেতন বৃদ্ধির ঘটনা সরকারের জন্য বুমেরাং হয়ে যাবে।

প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে যে ক্ষোভ এবং বিরক্তি প্রকাশ করেছেন তাতে মনে হচ্ছে তিনি সহজে দাবিগুলো মেনে নেবেন না। প্রথমত, তিনি যদি শিক্ষকদের দাবি মেনে নেন তাহলে অন্যান্য ক্যাডার এবং নন-ক্যাডার কর্মকর্তারা রাস্তায় নেমে আসবেন। এ অবস্থায় কোনো সরকারের পক্ষে সব মহলকে খুশি করা সম্ভব হবে না। রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একবার যদি সরকারকে পেয়ে বসেন তাহলে তাদের হাত থেকে কোনো অবস্থাতেই রেহাই পাওয়া যাবে না। সরকার এই মুহূর্তে কাউকেই খেপাতে চাইবে না— তবে প্রয়োজন হলে একপক্ষ দ্বারা অপরপক্ষকে দমন অথবা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে। শিক্ষকরা বলছেন, তারা মর‌্যাদার জন্য লড়াই করছেন। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শিক্ষকদের মর‌্যাদার ভিত্তি কেবল তারা নিজেরাই। অন্য কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী তাদের তুলনা পর্যন্ত করতে নারাজ। এ অবস্থায় শিক্ষকরা তাদের দাবি আদায়ের জন্য দেশব্যাপী সর্বাত্মক অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের ডাক দিয়ে নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছেন।

শিক্ষকদের ধর্মঘটের পরিণতি কী হতে পারে তার ইঙ্গিতও প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন তার সেদিনের বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, শিক্ষকদের এই ধর্মঘটে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া এবং পরীক্ষায় ব্যাঘাত ঘটাবে। তাই ছাত্রছাত্রীরা কিছুতেই ধর্মঘট করতে দেবে না। এ থেকে অনুমান করা যাচ্ছে যে, সরকারি মদদে একশ্রেণির ছাত্রছাত্রী সরাসরি ধর্মঘটী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামবে। অন্যদিকে বিগত দিনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বহুবার বিভিন্ন ইস্যুতে শিক্ষক ধর্মঘটে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকার ধীরে চলার নীতি অথবা শক্তি প্রয়োগের নীতি প্রয়োগ করে সফল হয়েছিল। আমার আশঙ্কা— সরকার যদি তার অতীত সফলতার ওপর ভিত্তি করে সময়ক্ষেপণ করে অথবা শক্তি প্রয়োগের নীতি অনুসরণ করে তবে পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।

কারণ, এই দিন আর সেই দিন এক নয়। সেসব দিনগুলোতে সরকারের ক্ষমতার ভিত্তি ছিল অতীব মজবুত আর নৈতিক মনোবল ছিল শতভাগ সুদৃঢ়। অন্যদিকে সরকারকে হটিয়ে দেওয়ার জন্য একটি পক্ষও মাঠে ছিল না।  অতীতের সেসব দিনের সঙ্গে তুলনা করলে বর্তমানের পরিস্থিতি একেবারেই উল্টো। সরকারের চারপাশের দশদিগন্ত নানা ক্ষোভ-বিক্ষোভে ফুঁসছে। দেশ-বিদেশের চক্রান্তকারীরাও সরকারকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করছে। কাজেই মাথা গরম করা যাবে না এবং মুখে যা আসে তাই বলা যাবে না। মাথা ঠাণ্ডা রেখে পুরো  পরিস্থিতি সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলেই সব পক্ষের জন্য সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল নিশ্চিত করা যাবে।


লেখক : কলামিস্ট।


বিডি-প্রতিদিন/ ১৬ জানুয়ারি, ২০১৬/ রশিদা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর