২১ জানুয়ারি, ২০১৬ ১০:৩৭
টরেন্টোর চিঠি

পুলিশের কর্মকাণ্ড তদারকির জন্য চাই পৃথক প্রতিষ্ঠান

শওগাত আলী সাগর

পুলিশের কর্মকাণ্ড তদারকির জন্য চাই পৃথক প্রতিষ্ঠান

শহরের অভিজাত ও ব্যস্ততম শপিং মল— ইয়র্কডেল মল। ঠিক দুপুর ১টায় মলের নিরাপত্তা রক্ষীর ফোন আসে পুলিশের কাছে। যতটা সম্ভব দ্রুততম সময়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায় পুলিশের একজন কর্মকর্তা। মলের নিজস্ব দুই নিরাপত্তা রক্ষীর সহায়তায় পুলিশ ১৭ বছরের এক তরুণকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের সময় তরুণটির কাছে থাকা রিভলবার থেকে গুলি বেরিয়ে একজন নিরাপত্তাকর্মীর গায়ে লাগে। কিন্তু পরনে বুলেট প্রুফ জ্যাকেট থাকায় তার তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। টরেন্টো পুলিশ গ্রেফতার হওয়া তরুণটিকে নিয়ে যায় ৩২ ডিভিশনের অফিসে। সেখানে যাওয়ার পর পুলিশ টের পায় তরুণটির পায়ে গুলি লেগেছে। দ্রুত তাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় শহরের সানিব্রুক হাসপাতালে। একই সঙ্গে ডাকা হয় স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন ইউনিটকে (এসইইউ)।

স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন ইউনিট কেন? বেআইনি অস্ত্রসহ গ্রেফতার হওয়া তরুণটির অপরাধের তদন্তের চেয়েও সামনে চলে আসে তরুণটির পায়ে কীভাবে গুলি লেগেছে সেই প্রশ্নটি। গুলির ঘটনাটি কি পুলিশ করেছে? কিংবা পুলিশের কি কোনো সম্পৃক্ততা আছে?— এসব প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে পুলিশের কাছেও। ফলে তরুণটির পায়ে গুলি দেখার সঙ্গে সঙ্গেই ৩২ ডিভিশনের পুলিশ স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন ইউনিটকে খবর দেয়।

স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন ইউনিট হচ্ছে কানাডার পুলিশের অপরাধ তদন্তের স্বাধীন ও অত্যন্ত শক্তিশালী একটি সংস্থা। পুলিশ সার্ভিস অ্যাক্টের আওতায়ই পরিচালিত হয় এই সংস্থা। তার কাজ হচ্ছে কোনো ঘটনায় পুলিশের বাড়াবাড়ির আলামত থাকলে সেই ঘটনা তদন্ত করে পুলিশের ভূমিকা নির্ধারণ করা। পুলিশ কোনো ক্রিমিনাল অফেন্স করেছে কিনা তা দেখা। এই ইউনিটের তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হলে প্রয়োজনীয় শাস্তির সুপারিশ তারাই করে এবং সুপারিশ কার্যকর করা হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, কোনো ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে তদন্ত করার জন্য দাবি জানাতে হয় না, দেনদরবার করতে হয় না। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই এই ইউনিট তদন্তে নেমে যায়। ইয়র্কডেল মলের ঘটনায় তরুণটির পায়ে গুলির জন্য তরুণটিকেই দায়ী করতে পারত পুলিশ। কিন্তু পুলিশ নিজেই স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন ইউনিটকে ডেকে এনেছে— এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারের কোনো দায়দায়িত্ব আছে কিনা তা নির্ধারণ করতে।  না, বাংলাদেশে পুলিশের বিরুদ্ধে আনা কোনো অভিযোগ তদন্তের জন্য আলাদা কোনো বিভাগ তো দূরের কথা পুলিশের অভ্যন্তরীণ তদন্ত করানোটাই অনেক কঠিন কাজ। শুধু পুলিশ বলি কেন, সরকারি কোনো সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে সহজে পাত্তা পাওয়া যায় না। কিন্তু সরকারের আর দশটা বিভাগ আর পুলিশের মধ্যে তফাৎ আছে। পুলিশ নিজে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত, রাষ্ট্র তথা জনগণের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্বও তাদের হাতে। তাদের যে কোনো স্খলন পুরো জাতিকেই বিপর্যয়ে ঠেলে দিতে পারে। তা ছাড়া পুলিশের হাতে থাকে বৈধ অস্ত্র আর হাতকড়া। এ দুটি সে যে কোনো মুহূর্তেই ব্যবহার করতে পারে। আর যে কোনো মুহূর্তে ব্যবহার করতে পারে বলেই পুলিশের কাজের বিশেষ তদারকি ও জবাবদিহি থাকা দরকার। কেননা, অস্ত্র ও হাতকড়া— এ দুটির যথেচ্ছা ব্যবহার শুরু হলে নাগরিকদের জন্য সেটি ভয়াবহ হয়ে উঠতে বাধ্য। কিন্তু পুলিশের কাজের তদারকি ও জবাবদিহি মনে হচ্ছে খোদ পুলিশের বড় কর্তাও চান না। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা রাব্বীকে তুলে নিয়ে ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে চাঁদা আদায়ের চেষ্টা ও নির্যাতনের ঘটনায় সারা দেশ যখন ক্ষুব্ধ, তখন পুলিশের আইজি অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তার পক্ষে সাফাই বক্তব্য নিয়ে হাজির হয়েছেন। তিনি অভিযুক্ত মাসুদ শিকদারকে নির্দোষ মনে করছেন— পুলিশের নিজস্ব তদন্তের রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে। শুধু মাসুদ শিকদারকে নির্দোষ সার্টিফিকেট দিয়েই ক্ষ্যান্ত হননি আইজিপি, তিনি নির্যাতিত ব্যাংক কর্মকর্তা ফৌজদারি অপরাধ করেছেন বলেও মন্তব্য করেছেন। পুলিশ বাহিনীর সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে আইজিপির এই বক্তব্য মোটেও কাঙ্ক্ষিত নয়। সারা দেশে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার দায়ে পুলিশের একশ্রেণির অসাধু, দুর্নীতিবাজ সদস্য তার এ বক্তব্যে উৎসাহ পাবেন। সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের মনে হয়েছে, আইজিপি মাসুদ শিকদারদের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন। একটি বাহিনীর সব সদস্যই সাধু হবে এমনটা আমরাও আশা করি না। কিন্তু অপরাধী সদস্যদের পক্ষে বাহিনীর সর্বোচ্চ ব্যক্তি অবস্থান নিলে, পুরো বাহিনীতেই অপরাধ প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।

আইজিপির অভিযোগ অনুসারে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা রাব্বী যদি সত্যিই ‘ফৌজদারি’ অপরাধ করে থাকেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। কিন্তু একজন নাগরিককে ধরেই অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগেই পুলিশ কেন নির্যাতন করবে, কেন ক্রসফায়ারের হুমকি দেবে, কেন চাঁদা চাইবে— এসব প্রশ্নের উত্তরও কিন্তু আইজিপি সাহেবকেই দিতে হবে। তার আগে পুলিশের কাজকে নিবিড় তদারকির মধ্যে রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে। আর সেজন্যই স্বাধীন একটি ‘স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন ইউনিট’ গঠনও জরুরি। যে প্রতিষ্ঠানটি নির্ভয়ে, নির্মোহভাবে পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগের তদন্ত করবে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করবে আর নির্দোষ প্রমাণিত হলে তাও ঘোষণা দিয়ে জানাবে। 

লেখক : টরেন্টোর ‘নতুন দেশ’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক

 

বিডি-প্রতিদিন/ ২১ জানুয়ারি, ২০১৬/ রশিদা

সর্বশেষ খবর