২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ১০:২৭
কলকাতার চিঠি

ন্যাড়া বেলতলায় ক’বার যায়?

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

ন্যাড়া বেলতলায় ক’বার যায়?

নির্বাচন সামনে আসা মাত্রই বঙ্গেশ্বরী এক ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক খেলায় মেতে উঠেছেন। টেনে এনেছেন বাংলাদেশকেও। তার দফতর নবান্নে বসে তিনি বাংলাদেশি নাগরিকদের পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে জেলা শাসকের কাছে আবেদন করলেই নাগরিকত্ব পাবেন বলে ঘোষণা করেছেন। তার এ ঘোষণা যে কত বড় অসত্য, অসাংবিধানিক এবং দেশবিরোধী তা তিনি হয়তো বুঝতেও পারেননি। একটি আঞ্চলিক দল এবং অঙ্গরাজ্যের প্রধানের এ মন্তব্যের অর্থ বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত করা। আর দেশের নাগরিকত্ব দেওয়ার অধিকার কি কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের মুখমন্ত্রীকে দিয়ে দিয়েছে! তার যে কত শিক্ষার অভাব তা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহলে পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। তিনি সাম্প্রদায়িকতার উদ্দেশ্যে এবং সংখ্যালঘু ভোট পাওয়ার জন্য ওই বিবৃতি প্রচার করেছেন। কদিন আগেই অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘুদের ওপর সমীক্ষার যে রিপোর্ট দিয়েছেন, তাতে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পদে পদে সংখ্যালঘুদের কীভাবে প্রতারিত করেছেন। বাঙালি মুসলিমরা মমতার এ ধাপ্পায় এতটুকু উল্লসিত নয়। কয়েকজন মৌলভি জানিয়েছেন, ন্যাড়া কবার বেলতলায় যায়? তিনি শুধু অসদুদ্দেশ্যে ধর্মকে সুড়সুড়ি দিয়ে ভোট বৈতরণী পার হতে চান। কোনো বিদেশি নাগরিককে ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার ক্ষমতা জেলা শাসক কেন, রাজ্য সরকারেরও নেই। বাংলাদেশসহ বিশ্বের কোনো দেশের লোক যদি ভারতের নাগরিক হতে চায় তাহলে তাদের সেই অঙ্গরাজ্যগুলোর স্বরাষ্ট্র ও রাজনৈতিক বিষয়ক দফতরকে চিঠি লিখতে হয়। সে চিঠি যায় দিল্লির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটির কাছে পাঠায়। কমিটি সব দিক বিবেচনা করে যদি মনে করে তাদের নাগরিকত্ব দিলে দেশের নিরাপত্তা এবং সংবিধান লঙ্ঘিত হবে না, তাহলেই তারা নাগরিকত্ব পেতে পারেন। কোনো জেলা শাসক নাগরিকত্ব দিতে পারেন না। এ সবই মমতার নির্বাচনী চাল। কেন এ চাল? ১৯৪৭ সালে বঙ্গভঙ্গের পর উত্তর বিহার থেকে লাখ লাখ বিহারি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে যান। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা আলবদর, আলশামস, রাজাকারের ভূমিকা নেন। এরা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাই করেননি, লাখ লাখ হিন্দু-মুসলমানকে খুন করেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা কলকাতা এবং আশপাশে এসে আশ্রয় নেন। বিহারে থাকাকালে তাদের কোনো না কোনো আত্মীয় চটকলে কাজ করতেন বা কল বিক্রি করতেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা কলকাতার পার্ক সার্কাস, খিদিরপুর, বারাকপুর এবং সীমান্ত জেলগুলোয় আশ্রয় নেন। ওইসব এলাকা থেকে হাজার হাজার রেশন কার্ডের দরখাস্ত জমা পড়ে। কলকাতার গোয়েন্দা দফতর রাজ্য খাদ্য দফতরকে সতর্ক করে বলে, এরা একশভাগই ওপার বাংলা থেকে আসা বিহারি মুসলমান। আমি তখন ঢাকায়। কলকাতায় এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী সন্তান তৎকালীন খাদ্য সচিব সুনীলবরণ রায় আমাকে ডেকেছিলেন। তিনি আমাকে একটা ফাইল দিয়ে বললেন, পড়ে দেখুন। সে এক অদ্ভুত ব্যাপার। খুলেই বলি। রাজ্য গোয়েন্দা দফতর খাদ্য দফতরকে রিপোর্ট দিয়েছিল, যাদের রেশন কার্ড দেওয়া হচ্ছে তারা সবাই পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা বিহারি মুসলমান। সুনীলবাবু জেলা শাসকদের নির্দেশ দেন রেশন কার্ড বণ্টন বন্ধ করতে। ওই সময় কলকাতার এন্টালি অঞ্চলের সিপিআই বিধায়ক ড. এ এম ও গনি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের কাছে গিয়ে অভিযোগ করেন হিন্দু অফিসাররা মুসলিমদের রেশন কার্ড দিচ্ছেন না। সিদ্ধার্থ শঙ্কর তখন সুনীলবরণের সেই নির্দেশ বাতিল করে আবার রেশন কার্ড দিতে বলেন। সেই রেশন কার্ডের ওপর ভরসা করেই ভারত ও বাংলাদেশবিরোধী রাজাকাররা ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া শুরু করে। তাদের আত্মীয়স্বজনরাই এখন কলকাতায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। খাগড়াগড়সহ রাজ্যের বিভিন্ন নাশকতামূলক কাজে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারা সব বিহারি মুসলমান। মমতা নিজেই তার বিবৃতিতে বলেছেন, যেসব রাজাকারের ভোটার কার্ড এবং রেশন কার্ড আছে, তাদেরই ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া উচিত। এরাই যে তার ভোটার তা মমতা খুব ভালো জানেন। কারণ বাঙালি মুসলমানরা মমতাকে ভোট দেন না। তারা কংগ্রেস এবং বামপন্থিদেরই ভোট দেন। তাই আসন্ন ভোটে বাঙালি মুসলমানদের ভোট পাওয়ার জন্য ভুয়া ভোটার আনতে তিনি এ লোভ দেখিয়েছেন। খাগড়াগড় কাণ্ডের পরই জঙ্গিবাদি জামায়াতের সঙ্গে তার জোট স্পষ্ট হয়ে গেছে। মমতার এ উক্তির নেপথ্যে কাজ করেছে তার দুই বিহারি সংসদ সদস্য সুলতান আহমেদ ও ইদ্রিশ আলি। এদের আত্মীয়রা এখনো ঢাকায় আছেন। তৃণমূলের হয়ে এরাই জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি তিস্তা চুক্তির আপত্তি করেছেন। তিনি জানেন না ভারত এবং বাংলাদেশ দুটি স্বতন্ত্র দেশ। তাই তিনি দুম করে বলে দিলেন জেলা শাসকরাই বাংলাদেশিদের নাগরিকত্ব দেবেন। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা নিজের প্রিয় মাতৃভূমির মাটি কামড়ে পড়ে আছেন। কারণ বাংলাদেশই তাদের নিজেদের দেশ। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। তারা কিন্তু এ দেশে মমতার দ্বারস্থ হন না। তারা বাংলাদেশেই স্বচ্ছন্দ।

শুধু নির্বাচন নয়, আরও কিছু আছে কিনা তা আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। তার পাঁচ বছরের কীর্তি পশ্চিমবঙ্গকে ধ্বংস করে দিয়েছে। মানুষ মুক্তি চাইছে। তা বুঝতে পেরেই তিনি বাংলাদেশের তাস খেলছেন। মমতা জানেন না, তার মুখ্য সচিবও বোঝেন না। তার জানারও কথা নয়। ১৯৭২ সালে ঢাকায় ইন্দিরা-মুজিব চুক্তিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে— ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চের পর বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কোনো নাগরিক ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন না। তাদের পাসপোর্ট ভিসা নিয়ে যাতায়াত করতে হবে। এ চুক্তি দুই দেশের সংসদেও গ্রহীত হয়েছে। মমতার উপদেষ্টারা, বিশেষ করে এ রাজ্যের মুখ্য সচিব কেন তাকে বলেননি, ৪৪ বছর ধরে যারা পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন তারা ঘুষ দিয়ে চোরা পথেই এসেছেন। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এবার বোঝা উচিত যে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর এ ধরনের প্রলাপ দুই দেশের সম্পর্কে ফাটল ধরতে পারে। ওয়াকিবহাল মহল মনে করেন মমতার এ সিদ্ধান্ত পুরোপুরি ভোটকেন্দ্রিক। তারা অন্য গন্ধও পাচ্ছেন। বিরোধীরা বলছেন, দুই দেশের মধ্যে বিরোধ জিইয়ে রাখার জন্যই বাংলাদেশের লোকদের এ দেশে বেআইনিভাবে ঢোকার ব্যবস্থা করতে সীমান্ত পুলিশদের আর অসুবিধা হবে না। মমতার এ উক্তিকে যারা প্রকারান্তরে সমর্থন করেছেন নির্বাচনে তাদের দুটি ভোটও যদি বাড়ে তাহলে তারা বলতে পারবেন, রাজনাথ সিংয়ের জন্যই বাংলাদেশিরা এ দেশের নাগরিকত্ব পেয়েছেন। সুতরাং মমতা যে তাস খেলেছেন তাতে সাম্প্রদায়িকতার বিষই ছড়ানো হবে। তা এ দেশ মেনে নেবে না।

 

বিডি-প্রতিদিন/ ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/ রশিদা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর