২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ১৫:১৪

আমি আজ বেজায় খুশি

অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত

আমি আজ বেজায় খুশি

২০১৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে সৌদি গ্রান্ট বা জাপানিজ গ্রান্টের বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রপাতি ক্রয়, অনুদান বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ করার জন্য কিছু পাওয়া যায় কিনা তা নিয়ে শেরেবাংলা নগর ইআরডিতে যাই। সেখানে আমার সঙ্গে অনেকেরই কথা হয়। একজন আমাকে বললেন, সৌদি গ্রান্টের জন্য না গিয়ে আপনি জাইকার কাছ থেকে সাহায্য নিতে পারেন। তারপর জাইকার ডেস্ক অফিসার এবং জয়েন্ট সেক্রেটারি দুজনের কাউকে না পেয়ে আমি কোরিয়ান

KOICA’র এক প্রকল্প কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করি। নেপথ্য উদ্দেশ্য, পৃথিবীর সর্বাধিক অটিস্টিক বাচ্চার দেশ কোরিয়ার সঙ্গে কিছু করা যায় কিনা। ২০১১ সালে শুরু করা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নেতৃত্বে অটিজমের ব্যাপারে কিছু করার চেষ্টা করছিলাম। সে ব্যাপারে কোরিয়ান ডেস্কের কর্মকর্তা যুগ্ম সচিব আসিফ ভাইয়ের (সম্ভবত অ্যাকাউন্টস ক্যাডারের) রুমে গিয়ে আমার মনেই হয়নি তিনি একজন আমলা। বরং নিজেই আগ্রহী হয়ে একের পর এক প্রাপ্তির পথ দেখিয়ে চললেন। কিছুক্ষণ পর একটি টেলিফোন এলো। ওই টেলিফোনের জবাবে তিনি বললেন, আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছি। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কোন ডেলিগেট? তিনি জবাব দিলেন, ‘স্যার আপনি বসেন’। ইতিমধ্যে কোরিয়ান একটা ডেলিগেট চট্টগ্রাম থেকে এলেন। তারা চট্টগ্রামে সম্ভবত পানি শোধনাগারে কাজের ব্যাপারে গিয়েছিলেন। তাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ বসার পর তিনি আমাকে বললেন স্যার আপনি চলে যান।

আসিফ ভাই আমাকে বললেন, আপনি কি বিকাল ৫টা থেকে ৭টার মধ্যে তাদের আপনার প্রত্যাশা জানাতে পারবেন? আমি সম্মতি জানালাম। আপনার তো চেম্বার আছে! আমি বললাম, তারপরও আমি আমার টিম নিয়ে বসে যাব। বিকালে আমরা অপেক্ষা করছি। আমার সঙ্গে ছিলেন প্রো-ভিসি অধ্যাপক রুহুল আমিন মিঞা, পরিচালক পরিদর্শন অধ্যাপক আবু শফি আহমেদ আমিন, প্রধান প্রকৌশলী শ্রীকান্ত এবং পরিচালক পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অধ্যাপক আবু নাসের রিজভীসহ কয়েকজন। আসিফ ভাই মি. মাইকেল নামে একজন আর্কিটেক্ট, হ্যান্স নামে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং কোরিয়ান এক্সিম ব্যাংকের একজন প্রতিনিধিকে নিয়ে এসে হাজির হলেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, স্যার আপনি কথা বলেন আপনার কি দরকার, কি চান। তখন আমি তাদের বললাম যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি জায়গা আছে, সেখানে একটি সুপার স্পেশালাইজড হসপিটাল করতে চাই। অর্থাত্ এর ভিতরে যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে সব কিছুই আসবে। সুতরাং শুধু যন্ত্রপাতি চেয়ে আর লাভ কি? কোরিয়ান ডেলিগেট বললেন, কোন জায়গাতে হবে? তোমাদের দেশে জায়গা এক্যুজিশান করতে এত সময় লাগে, টাকা ফেরত চলে যায়। কারণ তোমার দেশ জায়গা একোয়ার করতে সাত থেকে দশ বছর সময় নেয়। কিন্তু জায়গা একোয়ার করে বুঝিয়ে দিতে পারে না। এ কথা বলেই চট্টগ্রামে কোরিয়ান ইপিজেডের উদাহরণ টানলেন। উদাহরণের পরিপ্রেক্ষিতে আমি তাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেবিন ব্লকের উত্তর পাশে জায়গায় নিয়ে গেলাম। জায়গা দেখানোর পর তাদের অসম্ভব পছন্দ হলো। প্রফেসর হ্যান্স আমাকে কয়েকবার জিজ্ঞাসা করলেন, এই জায়গা কি তোমাদের? আমি তাকে যতই বলি আমাদের, তখন তিনি বলেন তোমরা কি এই জায়গা আমাকে দিতে পারবে? আমি বললাম জি, এক্ষুনি জায়গা দিতে পারব যদি তুমি চাও। তুমি কি প্রজেক্ট করবা আমাকে বল। তাতেও তার অবিশ্বাস দূর হলো না। পরিশেষে আমাদের ইঞ্জিনিয়ার শ্রীকান্ত তাকে জায়গার সব কাগজ, জমির মাপ যখন দেখাল এবং জায়গাটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সহায়তায় ১০% মূল্যে ক্রয়কৃত। তখন তারা কনভিন্স হলেন।

বলা বাহুল্য, কোরিয়ান এই ডেলিগেটের জন্য আমি আসিফ ভাইয়ের কাছ থেকে যখন বেরিয়ে আসি তখন প্রায় দুইটা-আড়াইটা বাজে। এসে তাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করলাম এবং সেই খাওয়া-দাওয়া এমনভাবেই করা হয়েছিল যে, কোরিয়ান ডেলিগেটরা একেকজন দুটো করেও রূপচাঁদা মাছ ভাজি খেয়েছিলেন। বাঙালি খাবার খেয়ে তারা ভীষণ তৃপ্ত হয়েছিলেন। তারপর শুরু হলো আসিফ ভাইয়ের সহায়তায় যোগাযোগের পালা। ওই সময় ইআরডির সচিব ছিলেন বর্তমান মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ স্যার। আজাদ স্যারের প্রেরণা ও আন্তরিকতা তুলনাহীন ছিল। আজাদ স্যার আসিফ ভাইকেও নির্দেশ দিলেন যে, যত তাড়াতাড়ি পারেন এই জায়গাতে প্রজেক্টটা করে দেন। ইতিমধ্যে অনেক যোগাযোগ হলো। একপর্যায়ে কোরিয়া এক্সিম ব্যাংকের নতুন ডেলিগেট এলো। তারা দেশে ফিরে একটা ফরম পাঠিয়ে দিল পূরণ করার জন্য। ফরম পূরণ করতে আমাদের যথেষ্ট হিমশিম খেতে হলো। ফরম পূরণকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম প্রধান এবং তার কর্মীবাহিনী অসম্ভব সাহায্য করেছিল। বলা বাহুল্য, আমি ওই সময় উপাচার্য কিংবা শিক্ষক প্রাণ গোপাল হিসেবে তাদের কাছে অত্যন্ত সমাদৃত ছিলাম। আমাকে সাহায্য করতে কেউ কোনো দিন না বলেনি। অনেক যোগাযোগের পর প্রথম মিটিংটি হলো ২০১৩ সালের ডিসেম্বর 1st Concept meeting between  ERD, BSMMU এবং কোরিয়ান এক্সিম ব্যাংকের প্রতিনিধিদের নিয়ে। যেখানে EULJI University-GK FS (Feasibility Study)র জন্য নিয়োগ করা হলো।

ইউলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদা মোতাবেক আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক তথ্য ও পরিসংখ্যান তাদের কাছে পাঠানো হয় জানুয়ারি ২০১৪ সালে। উভয়পক্ষের যাচাই-বাছাই শেষে প্রথম কিক অব মিটিং অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে। তথ্য ও পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ শেষে কার্যক্রম স্থির করা হয়। ২০১৪ সালের মার্চ মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষের নেতৃত্বে প্রকল্পের কাজ করার জন্য নতুন এক কমিটি গঠন করে দেয়। অধ্যাপক জুলফিকার রহমান খানের নেতৃত্বে আমাদের টিমের সঙ্গে কোরিয়ান টিমের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ হয় এবং তৃতীয় কিক অব মিটিং-এ দু’দলের চুলচেরা বিশ্লেষণের মধ্যে সেপ্টেম্বর ২০১৪ সালে MOD স্বাক্ষরিত হয় ERD, KEXIM, MOHFW এবং BSMMU-এর মধ্যে। যার ফলশ্রুতিতে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে কোরিয়ান  EXIM ব্যাংক সহজ শর্তে লোন মঞ্জুরি করে। জানুয়ারি ২০১৫-তে উচচ তৈরির কাজ শুরু হয় এবং আমার কার্যকাল মার্চ ২০১৫-তে প্রথমDPP-তে অনুমোদিত হয়।

সর্বশেষ বর্তমান প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত সবাইর অক্লান্ত পরিশ্রমে গত ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ পূর্ণাঙ্গ অনুমোদন পায়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম প্রধান নীরু শামসুন্নাহার আপা, প্ল্যানিং কমিশনের উপ-প্রধান ফরিদসহ প্রত্যেকেই পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা এবং ইআরডির প্রত্যেকের সহযোগিতা বলার অপেক্ষা রাখে না। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত যে সব স্বাস্থ্য সচিব দায়িত্বে ছিলেন যথাক্রমে হুমায়ূন কবির স্যার এবং বর্তমান সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম সাহেবের আন্তরিকতা প্রশংসাতীত। ২০১৪ সালে কাজটি সুষুমভাবে চালিয়ে নেওয়ার জন্য আমি কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক জুলফিকার রহমান খানকে কোরিয়ান প্রধানের সঙ্গে যোগাযোগের অতিরিক্ত দায়িত্ব দিই। অধ্যাপক জুলফিকারকে সহযোগিতার জন্য একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. নূর এলাহী মিমকে তার কাজের অতিরিক্ত হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করি। কারণ সে আইটিতে খুবই পারদর্শী যা চিকিত্সকদের মধ্যে বিরল। ফেব্রুয়ারি ২০১৩ থেকে আমার অবসরের দিন ২৪ মার্চ, ২০১৫ পর্যন্ত ন্যূনতম ১০টি সভা হয়েছিল দুপক্ষের মধ্যে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে সব সময়ই পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, ইআরডি উইং, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় উপস্থিত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্দেশনা দিতেন। এত বিশাল অংকের টাকা, স্বল্প সুদে, চল্লিশ বছরে দেও এবং যার প্রথম ১৫ বছর কোনো সুদ দিতে হবে না, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য খুবই সৌভাগ্যের ব্যাপার। ইচ্ছা করলে বর্তমানে চলমান পরীক্ষা-নিরীক্ষার চার্জ এবং সরকারি নিয়মে সিট ভাড়া নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই টাকা পরিশোধ করতে পারবে, যদিও সাধারণত সরকারই তাই করে থাকে। এ জন্য আমি আজ বেজায় খুশি।

ওই প্রকল্পের আওতায় জরুরি মেডিকেল কেয়ার সেন্টার, গ্যাস্ট্রো এন্টেরোলজি ইন্টারভেনশন, হেপাটোবিলিয়ারি সেন্টার, চাইল্ড অ্যান্ড মাদার হেলথ কেয়ার সেন্টার, কার্ডিও সেরিব্রোভাসকুলার সেন্টার, কিডনি ডিজিসেস সেন্টার, আইসিইউ, কেন্দ্রীয় ডায়াগনোস্টিক ও প্যাথলজি বিভাগ স্থাপন। সেই সঙ্গে ক্লিনিক্যাল রিসার্চের মাধ্যমে, এভিডেন্স বেসড মেডিসিন পদ্ধতি চালু করা। জটিল রোগের উন্নত সেবা প্রদান করে বিদেশের ওপর নির্ভরতা কমানোসহ স্বাস্থ্য সেবার মান বাড়াতে কার্যকর রেফারেন্স লিংকেজ তৈরি করা হবে। গত ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ১ হাজার ৩৬৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকার এ প্রকল্প অনুমোদন দেয়। প্রকল্পটি একনেকে পাস হয়েছে শুনে আনন্দে উদ্বেলিত, যখন দেখব প্রকল্প পূর্ণাঙ্গ হাসপাতালে রূপ নিয়েছে, পর্বতশৃঙ্গে বসে প্রার্থনা করব তার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারের, পরিশেষে এদেশের আপামর জনগণের স্বাস্থ্যসেবার উত্কর্ষতা দেখলে বলব, ‘হে স্রষ্টা আমাকে আর পুনর্জন্ম দিও না, আমি এখন শান্তিতে থাকতে চাই, অনেক শ্রম দিয়েছি।’

দুঃখ পাব যদি আমাদের চিকিত্সক, চিকিত্সাকর্মীদের (হেলথ কেয়ার প্রভাইডার যার মধ্যে নার্স, চিকিত্সক, ওয়ার্ড বয়, সুইপার, আয়া) অবহেলায় যদি নতুন এই হাসপাতালটির অবক্ষয় হয়। আমি বিশ্বাস করি আমার উত্তরসূরি নতুন প্রশাসন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এ কাজ ত্বরান্বিত করবেন যাতে করে এ দেশের দরিদ্র, নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো ন্যূনতম ব্যয়ে সন্তোষজনক চিকিত্সা এবং চিকিত্সাকর্মীদের উপদেশ ও সহানুভূতি নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি যেতে পারে। পরিশেষে আমার হূদয় এবং আমার স্বপ্নের এ বিশ্ববিদ্যালয়টি যেন এদেশের জনগণের শেষ আশা এবং ভরসার কেন্দ্রস্থান এবং রোগীদের তীর্থভূমিতে পরিণত হয়। পরম করুণাময় স্রষ্টা আমাদের মন-মানসিকতার পরিবর্তন করে, মাদার তেরেসার সেই অমোঘ বাণী ‘Give, Give and Give, until it hurts মন্ত্রে উজ্জীবিত করে তোলে। গীতায় উদ্ধৃত ‘ফুলকে দেখ কিভাবে স্বমহিমায় প্রস্ফুটিত হয়ে বাগান তথা পরিবেশের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, সৌরভ ছড়িয়ে, নিঃশব্দে ঝড়ে যায়।’ আমরা চিকিত্সক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা যেন তাই করি।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর