১৯ মার্চ, ২০১৬ ১১:৫৪

পুলিশি পদ্ধতি ন্যায়বিচারের সহায়ক হতে হবে

মইনুল হোসেন

পুলিশি পদ্ধতি ন্যায়বিচারের সহায়ক হতে হবে

সবারই দেখতে পাওয়ার কথা, পুলিশের ঢালাও ক্ষমতা কিভাবে দেশকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও বিপজ্জনক করে তুলেছে। প্রমাণ হয়ে গেছে যে পুলিশের ক্ষমতার প্রদর্শনী প্রকৃত অপরাধীদের জন্য বিশেষ কোনো হুমকি নয়। স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে শুধু প্রকাশ্য রাজনৈতিক বিক্ষোভকে দমন করা হয়েছে।

বড় ধরনের অপরাধ করতে প্রকৃত অপরাধীদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তারা দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ফুটো করে দিয়ে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে কত সহজে ১০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হাতিয়ে নেওয়া যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিজের দায়িত্ব ভুলে গিয়ে অন্য বিষয় নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। জনগণের টাকার এত বড় ডাকাতির ঘটনাটিকে গোপন রেখে তার পক্ষে ভারত সফরে যেতে অসুবিধা হয়নি। তিনি জানতেন তার কিছু হবে না। গোয়েন্দা বিভাগকে ব্যস্ত রাখা হয়েছে রাজনীতি নিয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকে কি হচ্ছে সে সম্পর্কে তাদের কিছু জানা ছিল বলে মনে হচ্ছে না।

ব্রিটেন নিরাপত্তার কারণে বাংলাদেশ থেকে লন্ডনে বিমানযোগে পণ্য পরিবহন বন্ধ করে দিয়েছে; যদিও বিমানবন্দরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের লোকজনের বিপুল উপস্থিতি চোখ এড়ানোর মতো নয়। বিমানবন্দরে বিদেশে যাওয়ার কার্গো পরীক্ষা করা কোনো দুর্লভ টেকনোলজির বিষয় হতে পারে না— বিমানবন্দরে কর্মরত কর্মকর্তাদের সততা ও দক্ষতার বিষয়ই যথেষ্ট। এখন দেশের প্রধান বিমানবন্দর থেকে বিদেশে মালামাল পাঠানোর ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিদেশি কোম্পানিকে নিয়োগ করতে হবে।

কোনো অপরাধ ঘটে গেলে পুলিশি রাষ্ট্রের আদলে পুলিশ মামলা দায়েরে ব্যস্ত থাকে। পুলিশের কাজ যেন শুধু মামলা করা, জনজীবনের নিরাপত্তা দেখা নয়। পুলিশ নিজেরাও তাদের অবাধ ক্ষমতার সুযোগ নিচ্ছে, এতে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে পুলিশ বাহিনী এবং রাষ্ট্র। বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে পুলিশের অপরাধ দমনের সাফল্য। যদি কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করলেই মামলা হয় তাহলে পুলিশি তদন্তের প্রয়োজন থাকে না। তারপরও সম্পূর্ণ অসহায়ভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ রিমান্ডে নেওয়া হয়। পুলিশি রিমান্ড ব্যবস্থা আমাদের বিচার ব্যবস্থায় বিচার প্রার্থীর অসহায়ত্বই প্রকাশ করছে।

অপরাধীরা যখন অপরাধ সংঘটনের অফুরন্ত স্বাধীনতা ভোগ করছে তখন সঙ্গত কারণেই পুলিশের কাছে সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব বেড়ে যাচ্ছে। অন্যায়কারীদের ব্যাপারেও পুলিশের সাহায্য নিতে জনগণকে ভয় পেতে দেখা যাচ্ছে। তাদের ভীতির কারণ, পুলিশ বাস্তবে সাধারণ জনগণকে কতটা সাহায্য করতে পারবে সে ব্যাপারে সংশয়। রাজনীতির মাধ্যমে পুলিশি কর্মকাণ্ড ভীষণভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। দেশে চলছে মামলা দেওয়ার রাজনীতি। 

আমাদের বিচার ব্যবস্থা দেশের বাস্তবতা হতে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। তাহলে সুবিচার অসম্ভব হতে বাধ্য। পুলিশ মামলা দিলেই তাকে জেলে যেতে হবে, এটা তো আইনের শাসনের কথা নয়। সুবিচারের কথাও নয়। কোনো গণতন্ত্রেই বিচার ব্যবস্থা আমাদের দেশের মতো জামিন না-মঞ্জুর করা এবং পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করা দ্বারা ভারাক্রান্ত নয়। অভিযুক্তকে আত্মপক্ষ সমর্থনের স্বাধীনতা দেওয়া না হলে বিচার ব্যবস্থা স্বচ্ছতা হারায়। জামিন না-মঞ্জুর করা অপরাধ প্রতিহত করার সহজ পথ হতে পারে না। এতে বরং প্রকৃত অপরাধীরা ধরা না পড়ার এবং সাজা না পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। পুলিশি বিচার ব্যবস্থার মতো পুলিশের মাধ্যমেই অপরাধীরা রক্ষা পেতে চায়। যাতে পুলিশ মামলা না দেয় বা দিলেও চার্জশিট থেকে অব্যাহতি দেয়।

অপরাধসংক্রান্ত পুলিশি পদ্ধতি অবশ্যই সুবিচারের সহায়ক হতে হবে। পুলিশি বিচার পদ্ধতি নয়, বরং পুলিশের মাধ্যমে মানুষের অধিকার রক্ষার সক্রিয় বিচার ব্যবস্থাই সমাজকে অপরাধমুক্ত রাখতে সাহায্য করে। এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পুলিশের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি করা হয়েছে, তাদের তত্পরতাও বেড়ে গেছে। মামলার চাপে কোর্টসমূহ দিশাহারা হওয়ার উপক্রম। কিন্তু সন্ত্রাসী তত্পরতা বেড়েই চলেছে। শিশুরা পর্যন্ত খুনিদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। ব্যাংক ডাকাতি তো স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে পড়েছে। অন্যান্য অপরাধও বেড়ে চলেছে। বলা হচ্ছে খুন-খারাবির মতো অপরাধে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য ভাড়াটিয়া পাওয়া যায়। তাদের নিরাপত্তা শেষ পর্যন্ত কাজে লাগে কিনা জানি না। কিন্তু এরূপ দলবদ্ধ লোকেরা সেই আশ্বাসই দিয়ে থাকে। পুলিশের অস্তিত্ব উপেক্ষা করে প্রকাশ্যে খুন-খারাবির ঘটনা তো বেড়েই চলেছে। মোটকথা, প্রচলিত পুলিশি পদ্ধতি অপরাধ বৃদ্ধিতেই সাহায্য করছে।

বিচার ব্যবস্থায়ই পারে পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহার হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে। পুলিশকে অপরাধ দমনের শেষ ভরসা ভাবলে বিচার ব্যবস্থাই প্রহসনে পরিণত হবে। পুলিশের ওপর আস্থা রাখা সম্ভব করতে হবে। কিন্তু পুলিশকে সততার সঙ্গে কাজ করার স্বাধীনতা কতটা আমাদের দেশে রয়েছে সেটাই বড় প্রশ্ন। 

যদি বিচার ব্যবস্থা ব্যক্তিগত ও সরকার বাদী মামলায় সাধারণ মানুষকে হয়রানি করার সহজ হাতিয়ারে পরিণত হয় তবে সত্য গোপন থাকা এবং অপরাধীদের রক্ষা করার প্রবণতার কারণে ন্যায়বিচার বাধাপ্রাপ্ত হবেই। বাংলাদেশের জনগণ সেই ভোগান্তিতে ভুগছে। হয়রানিমূলক মামলা বন্ধের পথ মামলা দিয়ে জেলে আটক রাখা নয়। জামিন সহজ করার যুক্তি এখানেই।

আমাদের আচরণ এমন যে পুলিশ একটা মামলা দায়ের করার সঙ্গে সঙ্গে সাজা ভোগের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। কীভাবে জামিন নেবে, পুলিশ রিমান্ড থেকে রক্ষা পাবে এসব দুশ্চিন্তায় অভিযুক্তের জীবন দুঃস্বপ্নময় হয়ে ওঠে। এতে পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহার হয়। প্রকৃত অপরাধীরা নিরাপদ দূরত্বে থাকার সুযোগ পায়। বিপজ্জনক অপরাধী হিসেবে অতীত রেকর্ড না থাকলে অভিযুক্তকে জামিন দেওয়া উচিত। জামিনকে বিনা বিচারে সাজার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা আইনের শাসনের পরিপন্থী।

জামিন না পেয়ে কারাযন্ত্রণা ভোগকারী একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি মনে করেন যে, আমাদের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা হচ্ছে ‘আগে শাস্তি, পরে বিচার করে দেখা হবে অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী না নির্দোষ’ তাহলে তাকে দোষ দেওয়া যাবে না। জামিন প্রদানে বিরোধিতা এবং অতি সহজে পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করা আমাদের বিচার প্রক্রিয়াকে ভীতিকর ও দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফেলেছে।

পুলিশি বিচার মেনে নেওয়া সুবিচার নয়।

দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া ছাড়া কোনো দেশেই ন্যায়বিচার সম্ভব নয়। রাজনৈতিক ব্যবস্থার কারণে আমাদের দেশে ন্যায়বিচার করা অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়েছে। এখানে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে পুলিশ। এখানে আইনের শাসন ব্যবস্থা টিকে থাকার বিষয়টি অসহায়ত্বে ভুগছে। কিন্তু বিচারকরা তো হাল ছেড়ে দিতে পারেন না। আইনের শাসনভিন্ন বিচার বিভাগের তো প্রয়োজনীয়তা থাকে না।

স্বীকার না করে উপায় নেই যে, আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ন্যায়বিচার করা বিচারকদের জন্য বিরাট সাহসের ও ঝুঁকির ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। কারণ আইনের শাসন কি তা ক্ষমতাসীনদের অনেকেই বুঝতে চান না এবং তাদের অনেকেই এর প্রয়োজনীয়তাও স্বীকার করেন না। পুলিশের রাজনৈতিক বিচারের গুরুত্বই যেন তাদের কাছে বেশি। বিচার বিভাগের সংবিধান প্রদত্ত স্বাধীনতাও ভালো অবস্থায় নেই। সরকার দ্বারা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত জাতীয় সংসদ এখন সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের বরখাস্ত করার ক্ষমতা হাতে নিয়েছে। সংবিধানের রক্ষক হিসেবে বিচার বিভাগকে অবশ্যই পদানত করার এ চেষ্টা প্রতিহত করতে হবে। সংবিধান রক্ষা করা বিচার বিভাগের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা না করতে পারলে শাসনতন্ত্রও রক্ষা পাবে না।

বিচার বিভাগের ক্ষমতা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অধিকার। তাই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করার দায়িত্ব বিচার বিভাগের একার নয়। জনগণের বর্তমান অসহায় অবস্থায় বিচার বিভাগের শাসনতান্ত্রিক ও আন্তর্জাতিক শক্তি সম্পর্কে তারা আশাবাদী হতে চায়। ক্ষমতার নেশা খুব খারাপ নেশা। বিচার ব্যবস্থা এর প্রতিষেধক। সবকিছুর পরও আশার কথা, সুপ্রিমকোর্টকে ভয় করে চলতে হয় সরকারি নেতা-কর্মীদেরও। বিচার বিভাগের ওপর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ আন্তর্জাতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।   

আমাদের রাজনীতির ধরন দেখে বুঝতে হবে যে, বিচারকদেরই একটি সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। ক্ষমতাসীনরা যাতে ক্ষমতাপাগল না হতে পারেন সে জন্যই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। অর্থাৎ ক্ষমতাপাগল তারা রাজনীতিবিদ হোক বা পুলিশ হোক তাদের হাত থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করা স্বাধীন বিচার বিভাগেরই দায়িত্ব। এ জন্যই বলা হয় বিচার বিভাগের হাত অনেক লম্বা।

সুসভ্য জীবনযাপনের শর্ত হচ্ছে বিচার ব্যবস্থা দ্বারা নাগরিক অধিকারের সুরক্ষা করা। স্বাধীন দেশে বিচার ব্যবস্থাকে প্রহসনে রূপান্তরিত করার চিন্তা-ভাবনা কারও থাকার কথা নয়। জনগণ হিসেবে আমাদের প্রদত্ত শাসনতন্ত্র ও নিজস্ব শাসনতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করার ব্যাপারে আমরা নিজেদের অতিমাত্রায় ভীতু একটা জাতি হতে দিতে পারি না। সবকিছু শেষ হতে দেওয়ার আগেই আমাদের সতর্ক হতে হবে। সাহস দেখাতে হবে। সাধারণ মানুষকে সাহস দেখাতে বলা ধোঁকাবাজি, সাহস দেখাতে হবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের দায়িত্ব পালনে।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।

সর্বশেষ খবর