গত ৩১ আগস্ট ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের প্রকৃত নাগরিকদের নামের তালিকা (এনআরসি) প্রকাশিত হয়েছে। ওই তালিকায় চূড়ান্তভাবে ঠাঁই হয়েছে ৩ কোটি ১১ লাখ লোকের। তালিকা থেকে বাদ পড়েছে ১৯ লাখ ৬ হাজার মানুষ। এনআরসি নিয়ে ভারতের রাজনীতি বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি এখন আসাম কেন্দ্রিক। এই নাগরিকত্ব নিবন্ধন হালনাগাদ নিয়ে নানা জনের নানা প্রশ্ন এবং এর ঢেউ ইতিমধ্যে এসে উপচে পড়েছে বঙ্গোপসাগরের উত্তর পাড়েও! ফলে বাংলাদেশের মানুষের মাঝেও এক চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। রোহিঙ্গা সমস্যা যখন নাকের ডগায় তখন নতুন কোন সমস্যায় কি জড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশ? অনেকের মনেই এ প্রশ্ন জন্ম নিয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশে থাকা ভারতবিরোধী একটি চক্রের ক্রমাগত অপপ্রচার এ সমস্ত উদ্বেগকে আরও রসালো করে তুলছে। তাই এ বিষয়ে বিস্তারিত লেখার সময় এসেছে।
প্রথমেই বলে নেয়া দরকার সম্প্রতি প্রকাশিত নাগরিকত্বের খসড়া তালিকা (এনআরসি) প্রণয়ণের আগে আরও তিনবার এই খসড়া তালিকা প্রকাশিত হয়ছে। প্রথম খসড়ায় মোট নাম ছিল ১ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষের। আসামের এনআরসি-র দ্বিতীয় খসড়ায় ২ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষের নাম তালিকাভুক্ত হয়েছে। এবং তৃতীয় খসড়ায় প্রায় ৪০ লাখ নাগরিক পঞ্জীতে তালিকাভূক্ত হয়নি। আর গত ৩১ আগস্ট সর্বশেষ যে খসড়া তালিকা প্রকাশিত হয় তা থেকে ১৯ লাখ ৬ হাজার মানুষ বাদ পড়েছেন। এখন প্রশ্ন হলো, এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর জন্য ভারতীয় আইন কি বলছে? এনআরসি নিয়ে সবার অমূলক ধারণা দূর করতে শুরুতেই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা এবং এই নাগরিকত্ব তালিকা নিয়ে ভারতীয় আইনের দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক।
আইনে আরও আছে, এনআরসি থেকে বাদ পড়াদের নিজেদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণ করার জন্য আগামী ১২০ দিনের মধ্যে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আবেদন জানাতে হবে। এই সময়সীমা আগে ছিল ৬০ দিন। কিন্তু সূত্র মারফৎ জানা যাচ্ছে, এই আবেদনের সময়সীমা পুনর্বিবেচনা করা হতে পারে। উল্লেখ্য, আবেদনের জন্য ৩১ অগাস্ট থেকেই ১২০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গিয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে যেহেতু এনআরসি-র কো-অর্ডিনেটর প্রতীক হাজেলাকে প্রথমে এনআরসির তথ্য সুরক্ষিত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে এনআরসি তালিকা থেকে যাদের নাম বাদ পড়েছে, তাদের হাতে একটি নথি তুলে দেওয়া হবে। সেই নথির মাধ্যমেই তারা বিশেষ আদালতে আবেদন করতে পারবেন। তাই এই কাজ সম্পূর্ণ করাই এখন ‘ফার্স্ট প্রায়োরিটি’। আর সে কারণেই এই প্রক্রিয়ার জন্য ১২০ দিনের সময়সীমা পুনর্বিবেচনা করা হবে এবং যেদিন থেকে আবেদনকারীরা হাতে তারা ওই নথি পৌঁছে দেবেন, তারপর থেকে এই ১২০ দিনের কাউন্টডাউন শুরু করা হবে। আবার বিশেষভাবে তৈরি ট্রাইব্যুনাল ছাড়াও তারা হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টেও আপিল করতে পারবেন।
আসামে অনেক দশক ধরে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল কাজ করছে কিন্তু সংখ্যায় মাত্র ৩০০টি। এনআরসি থেকে বাদ পড়া নাগরিকদের সুবিধার কথা চিন্তা করে সরকারের পক্ষ থেকে আরো একটি ঘোষণা এসেছে। কিছুদিনের মধ্যে সরকার আরও এক হাজার ট্রাইব্যুনাল তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে - কারণ এনআরসি থেকে বাদ পড়া লাখ লাখ মানুষের মামলা এই আধা-বিচারিক ট্রাইব্যুনালগুলোকে সামলাতে হবে।
নাগরিকত্বের তালিকা থেকে বাদ পড়াদের কী করণীয় তা নিয়ে সরকারের একগুচ্ছ ঘোষণা এসেছে এবং নিম্ন আয়ের মানুষদের ট্রাইব্যুনালে মামলা লড়ার সব খরচ সরকার বহন করবে বলে ঘোষণাও দিয়েছে। এই যুগান্তকারী ঘোষণা এনআরসি থেকে বাদ পড়াদের ক্ষেত্রে আলাদা সুবিধা সৃষ্টি করবে বৈকি!
এনআরসি অনিবন্ধিতদের স্ট্যাটাস তবে কী হবে?- এই প্রশ্নটা অনেকের মনেই। শেষ পর্যন্ত যাদের নাম লিস্টে উঠবে না, তারা কী করবে এবং তাদের নিয়ে কী করা হবে? বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ফেরত না নিলে তাদের কি নো-ম্যানস-ল্যান্ডে পুশব্যাক করা হবে? তাদেরকে কি অনাগরিক হিসেবে গণ্য করা হবে? এই প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর হবে না। আমি ইতোমধ্যেই উল্লেখ করেছি, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনাতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে এমনকি আসামের মুখ্যমন্ত্রীও বলেছেন অনাগরিক পরিস্থিতির মতো কিছু ঘটবে না। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার ক্ষেত্রে ভারতের অন্যান্য প্রান্তের অভিবাসীদের মতো নির্ধারিত আইন অবশ্যই থাকবে। তবে সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা দিয়েছে, মানবিক জায়গা থেকে বিবেচনা করেই সবার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তাই যারা পুশব্যাক হবে বলে চিন্তা করছেন তারা ভুলের মধ্যে আছেন। কেননা এনআরসি তৈরি আসাম থেকে শুরু হলেও উদ্বাস্তু সমস্যা কিন্তু দেশের অন্যত্রও আছে। তাদের ক্ষেত্রেও তো পদক্ষেপ নেয়া হবে। কেননা এই সমস্যা পশ্চিমবঙ্গে আছে, বিহারে আছে, পাঞ্জাবে, তামিলনাড়ুতে আছে, ত্রিপুরা মহারাষ্ট্রে আছে…। এক জায়গায় চালু হলে নিশ্চয়ই অন্য জায়গাতেও চালু হবে। তখন এই কোটি কোটি জনতাকে নিশ্চয়ই ভারত সরকার বের করে দিতে পারবে না, তাদের ক্ষেত্রে একটা সমাধান সরকারকে বের করতেই হবে।
‘পুশব্যাক টু বাংলাদেশ’ এটাই কী তবে সমাধান?- চারদিকেই প্রশ্ন উঠেছে, তবে কী পুশব্যাকেই সমাধান খোঁজা হবে! কিন্তু এ যে বহু কঠিন। পুশব্যাক ইস্যুতে একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই, জাতীয় নাগরিক পঞ্জির তালিকা থেকে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদের পরিবারবর্গের নাম বাদ পড়েছে। এখন এর সমাধান কী? তবে কি আপনারা বলবেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতির পরিবারকেও সেই দেশ থেকে পুশব্যাক করা হবে! যাই হউক, এই পুশব্যাক হচ্ছে একটি রাজনৈতিক গুটি, রাজনৈতিক দলগুলো যে যার সুবিধেমতো বিবৃতি দিচ্ছে এই পুশব্যাক নিয়ে। ‘পুশব্যাক টু বাংলাদেশ’ যে যে কারণে সম্ভব নয় তা তুলে ধরছি।
প্রথমত, ভারতীয় সংবিধানের দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৫ থেকে ১১ নম্বর, অর্থাৎ মোট সাতটি ধারায় নাগরিকত্বের প্রশ্নে স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। ৫ ও ৬ ধারার তিনটি করে উপধারা আছে। ভারতের নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৭, ১৯৬০, ১৯৮৫, ১৯৮৬, ১৯৯২ এবং ২০০৩ সালে অর্থাৎ মোট সাতবার সংশোধন করা হয়েছে। তাতেও এই নাগরিকত্ব প্রাপ্তির ব্যাপারে সমস্যার সমাধান হয়নি। সমস্যা সমাধানের বদলে জনমানসে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এই অতিকথা যে, কাতারে কাতারে বাংলাদেশি উদ্বাস্তুদের জন্য দরজা খোলা রাখা শুধু অর্থহীনই নয়, এ দেশের অর্থনীতির জন্য এবং জনবিন্যাসের ভারসাম্যর পক্ষে বিপজ্জনক। কিন্তু পুশব্যাক সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়ত, ভারতের সুপ্রিম কোর্টে ২০১৮ সালে একটি মামলা গিয়েছে যা পর্যালোচনা করলেও ‘পুশব্যাক টু বাংলাদেশ’ যে সম্ভব নয় এই ধারণা পাওয়া যায়। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার আবেদন জানিয়ে করা একটি জনস্বার্থ মামলা ভারতের সুপ্রিম কোর্ট খারিজ করে দিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জেএস খেহরের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চের পক্ষ থেকে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘সত্যমেব জয়তে’র করা এ-সংক্রান্ত মামলাটি খারিজ করে দেন এই বলে যে, ‘বিষয়টি ভারতীয় সংবিধানের ৩২ ধারার অন্তর্গত নয়। সে জন্য এটি আদালতের বিচারাধীন নয়।’
সুপ্রিম কোর্টে আবেদনকারীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ থেকে দুই কোটি বেআইনি অনুপ্রবেশকারী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে।
আসামের এনআরসি নিয়ে বহু কথা হচ্ছে। বিভিন্ন ফোরামে অনেকেই আসামের অবৈধ অভিবাসীদের ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে, আবার বাংলাদেশের সরকারি প্রতিনিধিরাও বিভিন্ন সময় তাদের বক্তব্যের মাধ্যমে এ বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থানটি পরিষ্কার করেছে যে, বাংলাদেশ মনে করে আসামের অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা বাংলাদেশি নয়। এখানে মূল ব্যাপার হচ্ছে, এই ব্যাপারে কোন রাজ্যের মন্ত্রী, সরকারী আমলা বা রাজনৈতিক নেতারা কি বলেছে তা মুখ্য না। বরং গুরুত্ব দেয়া উচিত ভারত সরকার বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কি বলছে!
আজ নাগাদ এই এনআরসি’র ব্যাপারে কি ভারত সরকার বাংলাদেশকে কিছু বলেছে? না বলেনি। অবৈধ অনুপ্রবেশের বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় সরকার কখনো বাংলাদেশের কাছে কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ তোলেনি এবং কোনো কূটনৈতিক দ্বিপক্ষীয় আলোচনাতেও এ বিষয়টি কখনো উঠে আসেনি। যেহেতু ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো অভিযোগ জানায়নি, তাই এ বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করা কখনোই যুক্তিযুক্ত হতে পারে না।
বাংলাদেশের অনেক কলামিস্টের লেখা দেখে মনে হচ্ছে, অনিবন্ধিত মানুষরা বুঝি আজই বাংলাদেশে এসে উঠছে! কেউ কেউ আবার বলেছেন যে, দিল্লির উচিত ঢাকাকে আশ্বস্ত করা। কিন্তু কেন? কিসের জন্য আশ্বস্তের দরকার পড়েছে? তিব্বত থেকে দুই লাখ অনুপ্রবেশকারী আজ ধর্মশালায় বাস করছে। ৭০ হাজার তামিল শ্রীলঙ্কান, ৪০ হাজার রোহিঙ্গা, ১২ হাজার আফগান ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করছে। তাদের নাগরিক অধিকার সুরক্ষায় ভারত সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে আসামের ঘটনার ক্ষেত্রেও সেভাবেই সমাধান দেয়া হবে। কাজেই আসামের নাগরিক নিবন্ধন নিয়ে বাংলাদেশের একজনেরও সামান্যতম উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। লক্ষ কোটি মানুষ ভারত থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আসছে, এই গুজবে কান দিবেন না।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা