২৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ ১৩:২৭

এনআরসি নিয়ে নতুন ঘোষণা: শান্ত হোক ভারত

হাসান ইবনে হামিদ

এনআরসি নিয়ে নতুন ঘোষণা: শান্ত হোক ভারত

গত ৩১ আগস্ট ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের প্রকৃত নাগরিকদের নামের তালিকা (এনআরসি) প্রকাশিত হয়েছে।

ওই তালিকায় চূড়ান্তভাবে ঠাঁই হয়েছে ৩ কোটি ১১ লাখ লোকের। তালিকা থেকে বাদ পড়েছে ১৯ লাখ ৬ হাজার মানুষ।

আসামের পর গোটা দেশেই এই এনআরসি চালু করতে বদ্ধপরিকর বলে জানিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি সরকার। ইতোমধ্যেই এ বিষয়ে একাধিক বার বার্তা দিয়েছেন দেশটির কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।

এদিকে, আসামে এই বিপুল সংখ্যক লোক বাদ যাওয়ায় বিজেপি শাসিত ওই রাজ্যে ব্যাপক বিক্ষোভের সম্মুখীন হতে হয়েছে মোদি সরকারকে। আর এই উত্তাপে বুঝি ঘি ঢেলে দেবার মতোই কাজ করেছেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অনেক নেতা। এনআরসি সম্পর্কিত তাদের বিভিন্ন বক্তব্য জনমনেও অনেক ধোঁয়াশা তৈরি করেছে বৈকি! তাই রাজনৈতিক দলের গন্ডি পেরিয়ে এনআরসি বিক্ষোভ এখন ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ভারতে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরেই বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে সরকারকে। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) নিয়েও সরব হয়েছে নানা রাজ্য। এই দু’টি ইস্যু নিয়েই উত্তপ্ত হয়েছে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাঙ্গন। প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন বিশিষ্টজন থেকে শুরু করে নাগরিক সমাজের একাংশ। পাশাপাশি, প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন রাজ্যে বিক্ষোভ-মিছিল হচ্ছে।

এনআরসি’র বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ-সহ ৭টি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তাদের রাজ্যে এনআরসি প্রয়োগ করা যাবে না বলে কার্যত হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা। এই আবহেই পিআইবি’র তরফে টুইট করে দেওয়া হল সুখবর। জানানো হল, নাগরিকত্ব প্রমাণে কেবলমাত্র একটি বা দু’টি নথিই প্রয়োজন, তার বেশি নয়! 

গত ২১ ডিসেম্বর সরকারের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, নাগরিকত্ব প্রমাণে ভারতীয় নাগরিককে জন্মস্থান বা জন্মতারিখ সংক্রান্ত প্রামাণ্য নথি অথবা একসঙ্গে দুটো জমা দিলেই হবে, অন্যকোন তথ্য প্রমাণাদির দরকার নেই। ওই একটি বা দু’টি প্রামাণ্য নথিতেই বহু তথ্য থাকে, ফলে অন্য কোনও নথিপত্রের প্রয়োজন নেই। 

এর আগে যদিও বলা হয়েছিল ১৯৭১-এর আগেকার পূর্বপুরুষের পরিচয়পত্র জমা দিতে হবে, কিন্তু নতুন ঘোষণায় তা বাতিল করা হয়েছে। পাশাপাশি, যে সমস্ত নিরক্ষর নাগরিকের কাছে জন্মস্থান বা জন্মতারিখ সংক্রান্ত কোনও নথিই নেই, তাদের জন্য ওই সম্প্রদায়ের কোনও সদস্যের সাক্ষ্যও স্থানীয় প্রশাসনের কাছে পেশ করা যেতে পারে। যদিও তা স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতিসাপেক্ষ বলে জানানো হয়েছে। নাগরিকত্ব নিয়ে যাতে কোনও নাগরিককেই অসুবিধায় পড়তে না হয়, সেজন্য এমন ব্যবস্থা বলে জানিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার।

নতুন ঘোষণায় নাগরিকত্ব আইনের ব্যাখ্যায় আরও বলা হয়েছে, ১৯৮৭ সালের ১ জুলাইয়ের আগে যারা ভারতে জন্মেছেন, তারা সকলেই এ দেশের নাগরিক। ১ জুলাই ১৯৮৭ সাল থেকে ৩ ডিসেম্বর ২০০৪ সালের মধ্যে যারা জন্মেছেন এবং যাদের বাবা-মায়ের মধ্যে কোনও একজন ভারতের নাগরিক, তিনিও ভারতীয়।

৩ ডিসেম্বর ২০০৪ সালের পরে যারা জন্মেছেন এবং যাদের বাবা-মা দু’জনই ভারতের নাগরিক কিংবা একজন ভারতীয় নাগরিক এবং অন্য জন সেই সময়ে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নন, তারাও ভারতের নাগরিক হিসেবে গণ্য হবেন।


কিন্তু সরকারের এই ঘোষণার পরও আন্দোলনকারীরা আস্থা পাচ্ছেন না। কেননা নতুন ঘোষণায়ও কিছু বিষয় অস্পষ্ট  বলে বিক্ষোভকারীদের দাবি। তারা বলছেন, ১৯৮৭ সালের ১ জুলাইয়ের আগে যখন জন্মের নথিকরণ বাধ্যতামূলক ছিল না, তখন যাদের জন্ম, তারা কী নথি দেখাবেন? তাছাড়া, ২০০৪ সালের ৩ ডিসেম্বরের পরে জন্মানো কেউ যদি বাবা বা মায়ের মধ্যে কোনও একজনকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে প্রমাণ করতে না পারেন, তা হলে তার নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। কিন্তু তিনি যেহেতু ভারতে জন্মেছেন, তাই অ-মুসলিম হলেও নিজেকে শরণার্থী হিসেবে দাবি করে নয়া নাগরিকত্ব আইনের সুবিধা নিতে পারবেন না।

এই সমস্ত জটিলতার সমাধান কী? এর উত্তরে মন্ত্রণালয় বলছে, জন্মের নথি বা স্কুলে পড়ার নথি দাখিলের মাধ্যমে নাগরিকত্বের আবেদন করা যাবে। নিরক্ষর ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে। তাদের ক্ষেত্রে জন্মের সাক্ষী থাকা কোনও ব্যক্তি বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের প্রশংসাপত্রের ভিত্তিতে নাগরিকত্বের আবেদন করা যাবে।

দেশজুড়ে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) তৈরি হওয়ার পর তাতে নাম উঠলে মিলবে ন্যাশনাল সিটিজেনশিপ কার্ড। ভোটার কার্ড বা আধার কার্ড নয়, সেটিই হবে এ দেশের নাগরিক হওয়ার পরিচয়। তবে এক্ষেত্রে নতুনভাবে পূর্ণাঙ্গ ঘোষণা কাগজেপত্রে বাস্তবায়নের দিকে তাকিয়ে বিক্ষোভকারীরা। 
আমরা হয়তো অনেকেই জানি না, প্রকাশিত নাগরিকত্বের খসড়া তালিকা (এনআরসি) প্রণয়ণের আগে আরও তিনবার এই খসড়া তালিকা প্রকাশিত হয়ছে। প্রথম খসড়ায় মোট নাম ছিল ১ কোটি ৯০ লাখ মানুষের। আসামের এনআরসি’র দ্বিতীয় খসড়ায় ২ কোটি ৯০ লাখ মানুষের নাম তালিকাভুক্ত হয়েছে এবং তৃতীয় খসড়ায় প্রায় ৪০ লাখ  নাগরিক পঞ্জিতে তালিকাভুক্ত হয়নি।

আর গত ৩১ আগস্ট সর্বশেষ যে খসড়া তালিকা প্রকাশিত হয়, তা থেকে ১৯ লাখ ৬ হাজার মানুষ বাদ পড়েছেন। এনআরসি নিয়ে অমূলক ধারণা দূর করতে সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশনাও এসেছে।

খসড়া তালিকা প্রণয়ণের শুরুতেই সুপ্রিম কোর্ট থেকে স্পষ্ট জানানো হয়েছিল, আসাম এনআরসি-তে যাদের নাম নথিভুক্ত হয়নি, তাদের সঙ্গে কোনও রকম জোরজুলুম করা যাবে না, কারণ যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে, তা একটি খসড়ামাত্র। সরকারকে সাধারণ নিয়ামক ব্যবস্থা (standard operating procedure বা SOP) তৈরির জন্য  বলা হয়েছে। 

আরও উল্লেখ করা হয়, এনআরসি প্রসেস ভারতের সুপ্রিম কোর্টের একটি বিষয় এবং পুরো বিষয়টা তাদের মনিটরিংয়ে আছে। 

একই সঙ্গে বলা হয়েছে, যাদের নাম বাদ গেছে তারা যাতে নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় সওয়াল করতে পারেন, সে ব্যাপারে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে। আর এই সওয়ালের কারণেই মূলত পর্যায়ক্রমিকভাবে চার ধাপে নাগরিক তালিকার খসড়া প্রণয়ন হয়েছে এবং বিপুল সংখ্যক জনতা এই তালিকায় স্থান পেয়েছেন। 

এবার আরেকটি ধাপ এবং সেখানেও নির্দেশনা আছে যার মাধ্যমে বাকি নাগরিকরা এই খসড়া তালিকায় নিজেদের নিয়ে আসতে পারবেন।

এবার আসছি , নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের উদ্বেগ নিয়ে। ‘পুশব্যাক টু বাংলাদেশ’ একটা বহুল আলোচিত টার্মে পরিচিতি লাভ করেছে। অনেকের ধারণা, এই বিপুল সংখ্যক জনতাকে বাংলাদেশে পাঠানো হবে। কিন্তু অনেক কারণেই নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে পুশব্যাক সম্ভব নয়। যে যে কারণে সম্ভব নয় তা তুলে ধরছি:-

প্রথমত, ভারতীয় সংবিধানের দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৫ থেকে ১১ নম্বর, অর্থাৎ মোট সাতটি ধারায় নাগরিকত্বের প্রশ্নে স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। ৫ ও ৬ ধারার তিনটি করে উপধারা আছে। ভারতের নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৭, ১৯৬০, ১৯৮৫, ১৯৮৬, ১৯৯২ এবং ২০০৩ সালে অর্থাৎ মোট সাতবার সংশোধন করা হয়েছে। তাতেও এই নাগরিকত্ব প্রাপ্তির ব্যাপারে সমস্যার সমাধান হয়নি। এবারও কতোটুকু বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে সংশয় আছে। কেননা সাম্প্রতিক আন্দোলন থেকে স্পষ্টভাবেই বলা যায়, রাজ্য সরকারকে একেবারেই পাত্তা না দিয়ে কেন্দ্র এই নীতি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। তাই এই সমস্যা সমাধানের বদলে অনেকটা স্থানীয় রাজনীতির কারণেই জনমানসে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে পুশব্যাক টু বাংলাদেশ টার্ম। 

দ্বিতীয়ত, ভারতের সুপ্রিম কোর্টে ২০১৮ সালে একটি মামলা গিয়েছে, যা পর্যালোচনা করলেও ‘পুশব্যাক টু বাংলাদেশ’ যে সম্ভব নয় এই ধারণা পাওয়া যায়। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার আবেদন জানিয়ে করা একটি জনস্বার্থ মামলা ভারতের সুপ্রিমকোর্ট খারিজ করে দিয়েছেন। সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি জেএস খেহরের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চের পক্ষ থেকে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘সত্যমেব জয়তে’র করা এ সংক্রান্ত মামলাটি খারিজ করে দেন এই বলে যে, ‘বিষয়টি ভারতীয় সংবিধানের ৩২ ধারার অন্তর্গত নয়। সে জন্য এটি আদালতের বিচারাধীন নয়।’ 

সুপ্রিমকোর্টে আবেদনকারীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ থেকে দুই কোটি বেআইনি অনুপ্রবেশকারী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে।

আসামের এনআরসি নিয়ে বহু কথা হচ্ছে। বিভিন্ন ফোরামে অনেকেই আসামের অবৈধ অভিবাসীদের ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে, আবার বাংলাদেশের সরকারি প্রতিনিধিরাও বিভিন্ন সময় তাদের বক্তব্যের মাধ্যমে এ বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থানটি পরিষ্কার করেছে যে, বাংলাদেশ মনে করে আসামের অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা বাংলাদেশি নয়। এখানে মূল ব্যাপার হচ্ছে, এই ব্যাপারে কোনও রাজ্যের মন্ত্রী, সরকারি আমলা বা রাজনৈতিক নেতারা কি বলেছে তা মুখ্য নয়, বরং গুরুত্ব দেওয়া উচিত আজ নাগাদ এই এনআরসি’র ব্যাপারে কি ভারত সরকার বাংলাদেশকে কিছু বলেছে কিনা সে ব্যাপারে! 

অবৈধ অনুপ্রবেশের বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় সরকার কখনও বাংলাদেশের কাছে কোনও আনুষ্ঠানিক অভিযোগ তোলেনি এবং কোনও কূটনৈতিক দ্বিপক্ষীয় আলোচনাতেও এ বিষয়টি কখনও উঠে আসেনি। যেহেতু ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও অভিযোগ জানায়নি, তাই এ বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনও আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করা কখনওই যুক্তিযুক্ত হতে পারে না।  

বাংলাদেশের অনেক কলামিস্টের লেখা দেখে মনে হচ্ছে, অনিবন্ধিত মানুষরা বুঝি আজই বাংলাদেশে এসে উঠছে! কেউ কেউ আবার বলেছেন যে, দিল্লির উচিত ঢাকাকে আশ্বস্ত করা। কিন্তু কেন? কিসের জন্য আশ্বস্তের দরকার পড়েছে?  তিব্বত থেকে দুই লাখ অনুপ্রবেশকারী আজ ধর্মশালায় বাস করছে। ৭০ হাজার তামিল শ্রীলঙ্কান, ৪০ হাজার রোহিঙ্গা, ১২ হাজার আফগান ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করছে। তাদের নাগরিক অধিকার সুরক্ষায় ভারত সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে আসামের ঘটনার ক্ষেত্রেও সেভাবেই সমাধান দেওয়া হবে। এটা একান্তই ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কাজেই আসামের নাগরিক নিবন্ধন নিয়ে বাংলাদেশের একজনেরও সামান্যতম উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। লক্ষ কোটি মানুষ ভারত থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আসছে, এই গুজবে কান দিবেন না। অন্যদেরও এই গুজব থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিন।

তথ্য সহায়তা: আনন্দবাজার পত্রিকা ও দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া

লেখক: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক

বিডি প্রতিদিন/কালাম

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর