২ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:৩৬

কূটনীতিতে দ্বৈত চ্যালেঞ্জ দিয়ে শুরু ২০২০ সাল!

হাসান ইবনে হামিদ

কূটনীতিতে দ্বৈত চ্যালেঞ্জ দিয়ে শুরু ২০২০ সাল!

২০১৯ সালের খতিয়ানটা উল্টালে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের মাঝে যে চ্যালেঞ্জগুলো আমরা দেখি তার মধ্যে এনআরসি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন অন্যতম। শুধু দুই দেশের সরকার না বরং জনগণের মাঝেও এক উদ্বেগ নিয়ে ২০২০ সালের আগমন ঘটেছে। 

বছরের একদম শেষপ্রান্তে এসে দ্বি-পক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা বড় রেখা টেনে দিয়েছে এনআরসি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। এক ধরনের প্রকাশহীন অনুভূতির মাঝেই বছরের শেষ সময়টুকু পাড় করল এ দুই দেশ। কিন্তু বিদায়ী বছরের প্রায় পুরোটা সময় পূর্ববর্তী বছরের ধারাবাহিকতায় প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় ছিল। 

২০০৯ সালের পর থেকে একের পর এক ঘটনা ও দ্বি-পক্ষীয় সম্পর্কের সমাধান ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের উত্তর-পূর্বের জঙ্গিদের দেশছাড়া করা,  ট্রানজিট দেওয়া,  আন্তর্জাতিক মঞ্চে দিল্লির পাশে থাকা।

অপরদিকে, ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে দিল্লি ঢাকার বাইরে না যাওয়া, বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য পরিকাঠামো খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ সহায়তা, বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়িয়ে দেওয়া এবং সবশেষে  মহাকাশ প্রযুক্তিতে ভারতের সাহায্য করার ইচ্ছে প্রকাশ করা এক ভিন্ন বার্তাই দেয়।

কিন্তু সম্প্রতি এই সম্পর্কের মাঝে দেয়াল হিসেবে দাঁড়িয়েছে এনআরসি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন!  
ভারতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার আসামে ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস (এনআরসি) করেছে। বিজেপি নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ভারতের পার্লামেন্টের উভয়কক্ষে পাস করেছে। তারপর রাষ্ট্রপতি সই করায় বিলটি আইনে পরিণত হয়। ১৯ লাখ লোক কোনও কাগজপত্র দেখাতে না পারায় তারা এনআরসি থেকে বাদ পড়ে গেলেন। এ আইন নিয়ে গোটা ভারতে তুলকালাম, ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আন্দোলন এই ইস্যুতে হচ্ছে, যা এখনো চলমান। ফলে বাংলাদেশে নতুন করে অনুপ্রবেশসহ বিভিন্ন ধরনের প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

নতুন এ পরিস্থিতি বাংলাদেশ কিভাবে মোকাবেলা করবে সেটি বিরাট এক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। তবে বছরের শেষভাগে নরেন্দ্র মোদির সরকার এনআরসি ইস্যুতে নতুন ঘোষণাও দিয়েছে। গত ২১ ডিসেম্বর সরকারের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণায় থেকে জানানো হয়, নাগরিকত্ব প্রমাণে ভারতীয় নাগরিককে জন্মস্থান বা জন্ম তারিখ সংক্রান্ত প্রামাণ্য নথি অথবা একসঙ্গে দুটো জমা করালেই হবে। অন্যকোন তথ্য প্রমাণাদির দরকার নেই। ওই একটি বা দু’টি প্রামাণ্য নথিতেই বহু তথ্য থাকে, ফলে অন্য কোনও নথিপত্রের প্রয়োজন নেই। এখন দেখার বিষয়, এই ঘোষণার পর কতটুকু শান্ত হয় ভারত! কেননা ইতোমধ্যে এই এনআরসি ইস্যুতে এক ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে, যা সরকার এবং জনগণের মাঝে এক দূরত্ব তৈরি করে দিয়েছে। তাই এই সম্পর্কের মাঝে দাঁড়ানো দেওয়াল ভাঙতে হলে ভারত সরকারকে আরও কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। কেননা জনগণের আস্থা অর্জনের বিকল্প আর কিছুই হতে পারে না! 

এদিকে, কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সাম্প্রতিক অতীতে যে মন কষাকষি চলছিল তাতে ঘৃতাহুতি হয়েছে নয়া নাগরিকত্ব আইন পাস। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশকে এক বন্ধনীতে রেখে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বার বার উল্লেখ, ফের ভারত থেকে শরণার্থী যাওয়ার আশঙ্কা, শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক কলকাতা সফরে কেন্দ্রের কোনও প্রতিনিধির না থাকা— সব মিলিয়ে বাংলাদেশে ভারত-বিরোধিতা তীব্র হয়েছে। তার জেরে সম্প্রতি দু’জন বাংলাদেশের মন্ত্রী এবং একটি সরকারি প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশ সফর বাতিল করে দিয়েছে ঢাকা। এই অবস্থায় প্রতিবেশীদের মধ্যে একমাত্র ভরসাযোগ্য রাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের চলতি গ্রহণ-দশা কাটাতে, বাড়তি পদক্ষেপ করতে চাইছে সাউথ ব্লক।

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর মার্চে বাংলাদেশ সফর অবশ্যই সেই উদ্যোগের প্রধান বিষয় হিসেবে তারা দেখছেন। তাছাড়া কূটনীতিকরা বলছেন, হর্ষবর্ধন শ্রিংলাকে পরবর্তী বিদেশ সচিবের দায়িত্বে এনেও বাংলাদেশ-সহ প্রতিবেশী দেশগুলোকে বার্তা দিতে চাইছে মোদি সরকার। বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং শ্রীলঙ্কার ভারপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব হিসেবে আগে বিদেশ মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছেন হর্ষবর্ধন।

ঢাকায় শুধু ভারতীয় হাইকমিশনারের দায়িত্বই সামলাননি, সে দেশে তার জনপ্রিয়তাও ছিল বিপুল। তাই কূটনীতিক ও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে কাজ করা রাষ্ট্রচিন্তকরা হর্ষবর্ধন শ্রিংলাকে বিদেশ সচিবের দায়িত্ব দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের মান ভাঙাতে চাইছে ভারত। এমনটাই মনে করছেন তারা।

এটা সত্যি যে, ভারত-বাংলাদেশ ২০২০ সাল শুরু করতে যাচ্ছে নতুন কিছু চ্যালেঞ্জ নিয়ে। তার মধ্যে এনআরসি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন যে অন্যতম তা আগেই উল্লেখ করেছি। বাকি রইল তিস্তা।  তিস্তা চুক্তি দুই দেশের প্রধান আলোচ্য বিষয়, এ নিয়ে জল বহুদূর গড়িয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে আন্তরিক থাকলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কারণে আটকে আছে তিস্তা তা কম বেশি সবারই জানা। ২০১৮ সালের ভারত সফরে প্রধানমন্ত্রী এক সমাবর্তনে অংশ নিয়ে সেখানে এক বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘অনেক অর্জনের মধ্যে কিছু বকেয়াও রয়েছে, যা উল্লেখ করে এমন সুন্দর অনুষ্ঠানের অঙ্গহানি করতে চাই না আমি!’  

এই বক্তব্য কিসের ইঙ্গিত বহন করে  তা পুরো সম্মেলনস্থলের সকলেই বুঝতে পেরেছিলেন! শুধু তাই না সেই সফরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিটিংয়েও এই তিস্তা নিয়ে খুঁনসুটি করতে ভুলেননি শেখ হাসিনা। মূলত খুব আন্তরিকতার সঙ্গেই প্রতিবারের আলোচনায় তিস্তা এসেছে পরোক্ষভাবে। তিস্তা নিয়ে উভয় দেশের আন্তরিকতার কোনও ঘাটতি নেই কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সাংবিধানিক ক্ষমতা কিছু কিছু ক্ষেত্রে এতোই প্রকট যে প্রাদেশিক সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে তাদের ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেক কিছু দ্রুততার সঙ্গে করা সম্ভব হয়ে উঠে না। তবে আমরা আশা রাখব এই জটিলতা কাটিয়ে ভারত সরকার দ্রুতই তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন করবে।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিস্তা ছাড়াও অসংখ্য অমীমাংসিত বিষয় ছিল যা মীমাংসিত হয়েছে এবং কিছু বিষয়ে এখনও দু’দেশের মধ্যে বোঝাপড়া ঠিকমতো হয়ে উঠছে না। তবে উভয় দেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে প্রাধান্য দিয়েই সেই সমস্যাগুলোকে সমাধান করতে চাইছে। ভারত-বাংলাদেশ বিশ্বাস করে যে, সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কই পারে সকল সমস্যা সমাধান করতে। এই বিশ্বাস থেকেই ছিটমহল সমস্যা, সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ, অর্থনৈতিক ট্রানজিট বিরোধ, বন্দি বিনিময় চুক্তির কার্যকারিতা, সীমান্ত হত্যাসহ বিভিন্ন সমস্যার সমাধান হয়েছে।
মূলত ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এক নতুন মাত্রায় উন্নীত হয় ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর। এর আগে ভারত-বাংলাদেশ বন্দী বিনিময় চুক্তির কার্যকারিতা প্রত্যক্ষভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছিল না। অবশেষে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ভারত সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ২০১৫ সালে  বাংলাদেশের কারাগারে থাকা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার (ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম) শীর্ষ নেতা অনুপ চেটিয়াকে ভারতের কাছে প্রত্যর্পণ করা হয়। 

অর্থনৈতিক ট্রানজিট নিয়েও দু’দেশের মধ্যে শীতল একটা সম্পর্ক চলছিল। অবশেষে ট্রানজিট দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নতুনভাবে মোড় নেয়। শুধু আর্থিকভাবে নয়, দীর্ঘ মেয়াদেও লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে এই ট্রানজিটের মাধ্যমে। তবে উভয় দেশকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে যেন সন্ত্রাসীদের চারণভূমি না হয়ে উঠে এই ট্রানজিট করিডোর। 

দু’দেশের সম্পর্কের মাঝে বিষফোঁড়া হল সীমান্ত হত্যা, সীমান্ত হত্যা নিয়ে দু’দেশের সম্পর্ক প্রায়ই উত্তপ্ত হয়ে উঠে। তবে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, সীমান্ত হত্যা বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই আছে। যেমন, আমেরিকা-মেক্সিকো সীমান্তকে বলা হয় মৃত্যুফাঁদ। কারণ পৃথিবীর সবচাইতে বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটে এই সীমান্তে। অতীতে যেখানে সীমান্ত হত্যা ছিল প্রতি বছরে প্রায় ১০০ এর উপরে বর্তমানে তা নেমে এসেছে ৩০ এর নীচে। 

যাই হোক, কোনও হত্যাকাণ্ডই কাম্য নয় এবং এই সীমান্ত হত্যা বন্ধে দু’দেশকে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাই। উল্লেখ্য, পূর্বের যেকোনও সময়ের চেয়ে বর্তমানে এই সীমান্ত হত্যা অনেক কম। তবে এই সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোটায় নিয়ে আসতে হবে।

২০১৪ সালের ৮ জুলাই নেদারল্যান্ডসের স্থায়ী সালিসি আদালতের রায়ে বঙ্গোপসাগরের বিরোধপূর্ণ ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা বাংলাদেশ পেয়েছে। বাকি ছয় হাজার ১৩৫ বর্গকিলোমিটার পেয়েছে ভারত। এই রায়ে উভয় রাষ্ট্রই খুশি এবং দু’দেশই একে বিজয় হিসেবে দেখছে। এই বিজয় বন্ধুত্বের বিজয়, এই বিজয় বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের বিজয়। কেননা, তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যা, যা উভয় রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল, তা আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্পত্তি হল।

ছিটমহল সমস্যার সমাধান আসে ২০১৫ সালে। ২০১৫ সালের ১ আগস্ট রাত ১২:০১ মিনিটে দুই দেশ ঐতিহাসিক মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির আওতায় একে অন্যের অভ্যন্তরে থাকা নিজেদের ছিটমহলগুল পরস্পরের সঙ্গে বিনিময় করে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি ছিটমহল ভারতের ভেতরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল, ছিটমহল বিনিময়ের ফলে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল (৭১১০ একর জমি) ভারতের অংশ হয়েছে। আর ভারতের ১১১টি ছিটমহল (১৭,১৬০ একর জমি) বাংলাদেশের অংশ হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারত নিজেদের সাবলীল সম্পর্ক ধরে রেখেই সমস্যার মূলোৎপাটন করেছে।  

বিগত বছরগুলোতে বিশেষ করে ২০০৯ থেকে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এক অনন্য উচ্চতায় স্থান করে নিয়েছে। এই সম্পর্ক এক ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে হাসিনা-মোদির হাত ধরে। একের পর এক দ্বিপক্ষীয় সমস্যার সমাধান করেছেন তারা। তাই ২০১৯ সালের শেষভাগে এসে দ্বি-পক্ষীয় সম্পর্কে যে উত্তাপ ছড়িয়েছে তা খুব একটা কাম্য নয়। বিগত দশ বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক যে উচ্চতায় স্থান করে নিয়েছে সে সূত্র ধরে এটা বলাই যায়, ২০২০ সাল এক নতুন উত্তাপে শুরু হলেও তা খুব একটা স্থায়ী হবে না।  আমরা আশা রাখছি, এনআরসি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে সকল জটিলতা খুব দ্রুতই  কাটিয়ে উঠবে ভারত। ‘গণভবন’ থেকে ‘জনপথ রোড’ এর দূরত্ব আসবে কমে ,  নতুন বছরে দ্বি-পক্ষীয় সম্পর্কের এক নব সূর্যের অপেক্ষায় আমরা!

লেখক: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক

বিডি প্রতিদিন/কালাম

সর্বশেষ খবর