জল বায়ু মাটি
রোজ সকালে তুমি কোরান পড়, বাইবেল পড়, ত্রিপিটক পড়, গীতাও পড়,
আর আদর্শলিপি আর রবীন্দ্রনাথ আর ফেসবুক আর পুরনো চিঠি
রোজ সকালে তুমি ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করো, গোলাপ জলে গোসল করো
আর বৃষ্টির আর ঝর্ণার আর রৌদ্রজলে সাঁতার কাটো, আর ক্রিসেন্ট লেকে
রোজ সকালে তুমি বাজারে যাও, রান্না করো, চুল বাঁধো, বিপির ওষুধ খাও
আর গান শোন আর ছবি আঁকো, আর কবিতা লেখো আর পার্কে হাঁটো
ঘড়ি দেখো, ডায়াবেটিস দেখো, আয়না দেখো, স্বপ্নও দেখো, ভিডিও দেখো
রোজসকালে তুমি উড়াল সড়কে চড়ে আকাশ ধরে ফুঁ দিয়ে উড়াও মেঘ;
রমনার প্রাচীন বটের কলমে সরোবরের স্বচ্ছজলে সবুজ ঘাসে লেখো
জয় বাংলা; হারিয়ে যাওয়া পল্টন ময়দান খোঁজো পুরনো পত্রিকার ভাঁজে
রোজ সকালে তুমি পেটের ভেতর পৃথিবী দেখার অপেক্ষমান শিশুকে নিয়ে
বাসে চড়ো; ট্রাক সেলের চা’ল কিনতে লাইনে দাঁড়াও; মাথার ওপর রোদের
সামিয়ানা; রাতের বাসি ভাত-তরকারি নিয়ে গার্মেন্টসে দৌড়াও, প্রাইভেট
পড়তে যাও, অংক স্যারের ভ্রুকুটি, মাসপয়লা, বাবার পকেট শুন্য,
মায়ের আঁচলের গিট ভরসা আর মাটির ব্যাঙ্কে জমানো খুচরো পয়সা
রোজ সকালে তুমি বুকের দুধে মিটাও সন্তানের ক্ষুধা আর সকাল পান করে
হাওয়ায় উড়াও ঈশ্বরের পিপাসা আর শোক ও শ্রদ্ধা আর কালের খেয়া
রোজ সকালে তুমি খবরের কাগজ দেখতে দেখতে এক দৌড়ে পৃথিবী
ঘুরে আসো; রামপুরা টিভি স্টেশনের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ভাপা পিঠা খেতে খেতে
আস্ত নদী বোতলে ভরে নাও, আইবুড়ো পাহাড় ভরে রাখো কাঁধের ঝোলায়
রোজ সকালে তুমি সূর্যের ডিমে ওম দাও আর আকাশ নিড়ানি দাও
আর দুধে জল আর ধর্মকে সুড়ঙ্গে নাও আর ল্যাপটপে পুরনো জুতাজোড়া
রোজ সকালে তুমি ধানমন্ডির লেকপাড়ে দাঁড়িয়ে স্বপ্নের গালে উল্কি আঁকো,
আর সেই বাড়ির আঙিনায় উঁকি দাও; আর স্বকালের গালে কষে চড় দিয়ে
কাঁদো আর চিৎকার করে বলো বঙ্গবন্ধু সবার জল বায়ু মাটি ও আকাশ।
* * *
বঙ্গনামা
আঁধার ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে আছেন ভূমিপুত্র
হিমালয়ের দীর্ঘ ছায়ার চেয়েও দীর্ঘতর
তার ছায়া নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে।
বৃষ্টির জলে স্বপ্ন ভেজে চোখের গভীরে।
শিউলি ঝরা সকালের নরম রোদ ঝাউবনে
হাত বাড়ালে তিনি করতালি দিয়ে প্রবল
উৎসাহ দেন দিগভ্রান্ত পাখিদের।
শ্রাবণ-বর্ষার মতো কখনো ফুরায় না তার গল্প।
পদ্মা মেঘনার জলতরঙ্গের মতো স্বপ্নরা
ছড়িয়ে পড়লে চারদিক শ্রাবণের বৃষ্টির ভেতর
অশ্রু ঢোকে, মেঘের ভেতরে মেঘ।
বাজ পড়ার শব্দে মাটিও জড়িয়ে ধরে তাকে।
ডানা ভেঙে কাদাজলে পড়ে থাকা মোহিনী
প্রজাপতির জন্য চোখ বুজে যখন বাঁশিতে
ফুঁ দেন তিনি, একে একে দুলে ওঠে
নিস্তেজ লাউডগা, শীর্ণ নদীর জলধারা।
আমাদের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখেছেন শ্রেষ্ঠসুন্দর।
* * *
তুমিই বাংলাদেশ
স্বদেশের একবুক কষ্ট তোমার অকাল প্রস্থান।
মৃত্যুভয় ছিল না বলে কী অনায়াসে
মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলে সেই কালরাতে
শেষ শ্রাবণের ঘনমেঘের আঁধারে
তোমার বুকে ওরা গুলি চালালো
বিদীর্ণ হলো বাংলাদেশ।
অবিনাশী হবে বলে কী সহজে বিনাশ
করেছিলে ভয়; কোটি প্রাণে স্বপ্ন পুরে
দিয়েছিলে দিশা; অশ্রুশিখায় উজ্জ্বল
তোমার কীর্তি স্বাধীন বাংলাদেশ।
একাত্তরে ফাল্গুনের সেই তপ্ত বিকেলে
তোমার চোখে ভেসে উঠেছিল স্বাধীনতা;
রমনার আকাশছোঁয়া তোমার তর্জনি যেন
স্বাধীন বাংলার পতাকা!
কী দ্বিধাহীন দীপ্তকণ্ঠে ঘোষনণা করেছিলে
‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।’
রাতের আঁধারে শত্রু হানা দিলে রুক্ষচৈত্রের
বাতায়নে ডাক দিয়ে যাও নতুন বৈশাখের!
অতঃপর যুদ্ধদিন শেষে বেদনা-মোড়ানো পৌষে
এলো মুক্তি, ফিরে এলে তুমি, সঙ্গে নতুনদিন।
তোমার কাছে আমাদের অনেক ঋণ
কোনদিন শোধ হবে না।
স্বদেশের একবুক কষ্ট তোমার অকাল প্রস্থান
তোমার মৃত্যু স্বদেশের অশ্রু;
তুমিই তো বাংলাদেশ।
* * *
তিনি আছেন
তিনি আছেন মার্চের তপ্ত দুপুরে
অশ্রুভেজা ডিসেম্বরের শান্ত বিকেলে।
তিনি আছেন দেবদারু সবুজ ছায়া হয়ে
পাখির কাকলীতে শান্ত দীঘির কোমল
অধরে তার ছায়া ভালোবাসা হয়ে আছে।
তিনি আছেন বলে
কবিতা লেখা
কখনো শেষ হয় না
তার গল্প মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
* * *
শ্রাবণ দিনের দুঃখ
শ্রাবণ আমার দুঃখের দিন কাঁদতে আসে
দুঃখের দিনগুলো সব হাওয়ায় ভাসে
শ্রাবণে পিতার সিথানে বৃষ্টি ঝরে
প্রান্তরে তার পদচিহ্ন; সে তো ঘরে ঘরে
পিতার নিঃশ্বাসে সোঁদা মাটির গন্ধ
তার তৃষ্ণিত ঠোঁটে খরায় বৃষ্টির আনন্দ।
শ্রাবণ মেঘেরা শোকের অশ্রুতে ভেজায় রোদের শরীর
পিতার ভুরুর কোণে এলেবেলে দীর্ঘপথের ছায়া
সবুজ ঘাস ধুলো, অসীম নির্জনতার অপরূপ মায়া
যেন রোদ্দুর ঘ্রাণ; যেন জ্যোৎস্নার শব্দ ভাঙে নদীর।
আমার শ্রাবণদিন সমান দুঃখের দিনরাত
পিতার শোকে পরিত্যক্ত কুয়োর জঠরে লুকায় চাঁদ।
* * *
সেই বাড়ি
লেকঘেঁষা দক্ষিণমুখি সেই বাড়ি নতুন
জন্মের আঁতুরঘর হলো; তারপর,
গৃহজনের গুচ্ছমৃত্যু দর্শনের বেদনায়
নিমগ্ন এক করুণ উপাখ্যান।
লতাগুল্ম ঘেরা বাড়ির খোলা ছাদ ছুঁয়েছে
আকাশ থেকে নেমে আসা জলবতি মেঘ
উড়ে উড়ে ক্লান্ত পোষা কবুতর, অস্থির চড়ুই,
ধবধবে বিড়ালছানা; পূর্ণিমা রাতে নীলশাদা
জ্যোৎস্নায় অযুত তারার ভ্রুকুটিতেও
কী অবিচল গৃহী।
তাকে ভালোবাসতো আদিগন্ত শস্যভূম
আর নদী, নওগাঁর চাষী, ধরলার মাঝি
হাতিয়ার জলদাস এবং আদমজীর শ্রমিকের মতো
তিনিও তাদের ভালবেসেছেন আমৃত্যু।
তিনিই তো উত্তম যিনি পরের মধ্যে
নিজেকে খুঁজেছেন। সেই গৃহী
রবীন্দ্রনাথ ভালোবেসে বৃষ্টিভেজা নিঝুম রাতে
খোলা ছাদে হাঁটতেন একাকী দু’চোখে
আঁধারের আলো ; স্বপ্নরা সাঁতার কাটতো। বুকের
গহীনে যেন জেলবাসের দিনে
অশ্রুসজল গৃহিণীর প্রেরণা।
সেই বাড়ি অযুতলক্ষ পূর্ণিমায় ভিজে
রৌদ্রের ঘ্রাণ মেখে নিজেকে করেছে বাতিঘর।
সেই বাড়ির সদর দরোজায় সমবেত মুখেরা পরস্পর
বলে এখানেই থাকতেন আমাদের লোক।
* * *
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা