১১ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ১৭:১৫

‘‌রাষ্ট্রপতি কি ভোট দেয় নাকি’ বলে রেগে ফোন কেটে দেন প্রণব মুখার্জি

শঙ্খদীপ দাস

‘‌রাষ্ট্রপতি কি ভোট দেয় নাকি’ বলে রেগে ফোন কেটে দেন প্রণব মুখার্জি

প্রণব মুখার্জি

২০১৪ সালের ভোটের সময়ের কথা। দিল্লিতে রফি মার্গের অফিস থেকে বাড়ি ফিরছি। রাত তখন প্রায় ১১টা হবে। কলকাতার নিউজ ডেস্ক থেকে আমার এক সহকর্মী ফোন করলেন। বললেন, কোনও একটি বাংলা চ্যানেলে নাকি ব্রেকিং নিউজ চলছে, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ভোট দিতে কলকাতায় আসবেন। তাঁর কলকাতার বাড়ি ঢাকুরিয়ায়। তখনও ওখানকারই ভোটার ছিলেন। ফোনে সহকর্মী বললেন, দাদা এটা একটু চেক করা সম্ভব কি?

এখবর চেক করার জায়গা একটাই। খোদ প্রণব মুখার্জি। মোবাইল নম্বর বরাবরই ঠোঁটস্থ আমার। ফোন করলাম। বেশ কয়েক বার রিং হওয়ার পরে ধরলেন। আমি বললাম, ‘সরি প্রণববাবু, এত রাতে ফোন করলাম। আসলে কলকাতার একটা চ্যানেলে খবর চালাচ্ছে…।” পুরোটা শোনার আগে, ‘যত্তসব’ বলে ফোন কেটে দিলেন উনি। বুঝলাম, খুব রেগে গেছেন। তবু ফের ফোন করলাম। বললাম, “ফোনটা মনে হয় কেটে গেছিল।” রাগে গজগজ করতে করতে বললেন, “না কাটেনি। আমিই কেটে দিয়েছিলাম।” যতটা মৃদুভাবে সম্ভব বললাম, “আপনি আমার কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন, আমারই খারাপ লাগছে। কিন্তু…।” কথা শেষ করার আগেই উনি আরও চড়া গলায় বললেন, “শোনো বাপু, রাষ্ট্রপতি কি ভোট দেয় নাকি? রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন রাজেন্দ্র প্রসাদ কি ভোট দিয়েছিলেন? না ভেঙ্কটরমনকে দেখেছিলে রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে বেরিয়ে ভোট দিতে যাচ্ছেন? পারো বটে! হুঁ!” এটুকু বলেই ফের ফোন কেটে দিলেন। বুঝলাম, উনি ভোট দিতে যাবেন না। চ্যানেলের খবরটি সঠিক নয়। কলকাতা ডেস্ককেও সেটাই জানিয়ে দিলাম।

পরের দিন ছিল রবিবার। আমার ছুটির দিন। ভোর থেকে মান্ডি হাউজে রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠান ছিল, সেখানে গেছিলাম। দশটা নাগাদ দেখি রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে ফোন আসছে। প্রণব মুখার্জির প্রাইভেট সেক্রেটারি রজনীশ বললেন, “স্যার কথা বলতে চাইছেন।” বললাম, “ঠিক আছে ফোনটা ট্রান্সফার করুন।” ফোনটা তুলেই রাষ্ট্রপতি বললেন, “রাগ করেছিস নাকি”? আমি অবাক হয়ে বললাম, “কেন, রাগ করব কেন?” বললেন, “আরে গত রাতে একটু বেশিই বকাবকি করে ফেলেছি, তাই ভাবলাম তোকে ফোন করি।। ভাল মিষ্টিও এসেছে বাংলাদেশ থেকে।” আমি বললাম, “কী যে বলেন আপনি! আমারই খারাপ লাগছিল, অত রাতে আপনাকে রাগিয়ে দিলাম। কিন্তু এতটা রেগে গেলেন কেন?” বললেন, “আর বলিস না। এক মাতব্বর আমাকে রাগিয়ে দিল। তোর আগে ফোন করেছিল। আমাকে জ্ঞান দিচ্ছিল, কেন আমার ভোট দেওয়া উচিত। এটা নাকি রাষ্ট্রপতিরও নাগরিক অধিকার। ওসব শুনেই মাথা গরম ছিল। রাষ্ট্রপতি কি পার্টিসান হতে পারেন?”

প্রণব মুখার্জির সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল দীর্ঘদিনের। সাংবাদিকতার পেশায় যোগ দেওয়ার তিন বছরের মধ্যেই কলকাতা থেকে দিল্লি বদলি হয়ে যাই। যাওয়ার আগে সম্পাদক তথা প্রয়াত সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্ত একদিন ডেকে বলেছিলেন, “শোনো, দিল্লি গিয়েই প্রথমে প্রণববাবু, প্রিয়বাবু আর সন্তোষবাবুর (সন্তোষমোহন দেব) সঙ্গে যোগাযোগ করবে।” সেটাই করেছিলাম। ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসের গোড়ায় এক রবিবার সকালে প্রণব মুখার্জির সঙ্গে আমার প্রথম দেখা, তাঁর তালকাটোরা রোডের সরকারি বাসভবনে। কেন্দ্রে তখন বাজপেয়ী সরকার। প্রণববাবু সে সময়ে রাজ্যসভার সাংসদ, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য। প্রণব মুখার্জিকে উনি খুবই শ্রদ্ধা করতেন। প্রথমবার সাক্ষাৎ ছিল খুব কম সময়ের, বড় জোর ১০-১২ মিনিট। সেই শুরু।

তবে ভোট দেওয়ার প্রসঙ্গটা প্রথমে তুললাম একটা বিশেষ কারণে। আসলে প্রণববাবু যে কতটা ‘কপিবুক’ রাজনীতিক ছিলেন, এ ঘটনা দিয়েই আন্দাজ করা যেতে পারে। সাংবিধানিক ব্যবস্থা, প্রতিষ্ঠান ও সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি অগাধ মর্যাদাবোধ ছিল তার। কোনওভাবেই তা লঘু করার পক্ষে ছিলেন না তিনি, কখনওই নয়।

এতগুলো বছরে প্রণব মুখার্জিকে নিয়ে অনেক স্মৃতি। বেশিরভাগই কাজের সূত্রে। নিখাদ আড্ডার সূত্রেও যাওয়া-আসা ছিল তাঁর বাড়িতে বা রাষ্ট্রপতি ভবনে– দিনে, রাতে, এমনকি মধ্যরাতেও। মনে রেখে দেওয়ার মতো টুকরো টুকরো ঘটনাও অনেক। যেগুলোর একটার সঙ্গে অন্যটার আপাত সম্পর্ক হয়তো নেই। একটা লেখাতেও সব বলা সম্ভব নয়। তবে কয়েকটা ঘটনার কথা তুলে ধরলে রাজনীতিক প্রণববাবু সম্পর্কে অবশ্যই একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। বোঝা যেতে পারে, সত্যিকারের এক জন রাষ্ট্রনেতা ছিলেন তিনি।

নন্দীগ্রাম নিয়ে ঘটনার কথা বলি। ১৪ মার্চ ২০০৭। সংসদের বাজেট অধিবেশন ছিল তখন। পার্লামেন্টেই ছিলাম আমি, দোতলার বাড়িতে। খবর পেলাম, নন্দীগ্রামে গুলি চলেছে। পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন অনেকে। তড়িঘড়ি উপর থেকে নেমে এলাম নীচে। পার্লামেন্টের ১৩ নম্বর ঘরে প্রণব মুখার্জি বসতেন। সে সময়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন তিনি। ঘরে টোকা মেরে ঢুকে গেলাম। বললেন, হাঁফাচ্ছিস কেন? বললাম, “নন্দীগ্রামে কী হয়েছে শুনেছেন?” বললেন, “কী হয়েছে?” তখনও পর্যন্ত যেটুকু শুনেছিলাম জানালাম। শুনে বললেন, আচ্ছা। পরক্ষণেই ফোন তুলে তাঁর আপ্ত সহায়ক প্রদ্যুৎ গুহকে বললেন, বুদ্ধবাবুকে ফোন করো। মিনিট কয়েক বাদে সেই ফোন এলে বললেন, “হ্যাঁ, ওখানকার কী অবস্থা? অ্যাডেকোয়েট ফোর্স আছে তো? নাকি আরও লাগবে?”  বুদ্ধবাবু জবাবে বলেছিলেন, “পর্যাপ্ত ফোর্স রয়েছে।” প্রণব মুখার্জি এদিক থেকে বললেন, “না না এটা হতে পারে না। কোনও দরকার হলে আমাকে বলবেন।”

কেন্দ্রে তখন বামেদের সমর্থনে ইউপিএ সরকার চলছে। তাঁদের সঙ্গে সমন্বয় রক্ষার দায়িত্ব ছিল প্রণব মুখার্জির উপরেই। উনি ফোন রাখতেই বললাম, এই যে বুদ্ধবাবুকে বললেন, “না না হতে পারে না! সেটা কী?” বললেন, “একটা জায়গা মুক্তাঞ্চল হয়ে থাকবে, সেখানে আইনের শাসন থাকবে না, এটা চলতে পারে না। রাস্তা কেটে পুলিশকে ঢুকতে দেব না, প্রশাসনের কথা শুনব না। প্যারালাল ব্যবস্থা চালাব, এ সব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চলে না।” বললাম, তা বলে “পুলিশ ওরকম গুলি চালিয়ে মেরে দেবে?” বললেন, “সেটা ঠিক হয়নি। তবে আন্দোলনকারীদেরও বুঝতে হবে, মাওবাদী কায়দায় আন্দোলন-বিক্ষোভ করলে কোনও গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষেই মানা সম্ভব নয়।” সেদিন প্রণব মুখার্জির কথা পুরোপুরি মানতে অসুবিধা হচ্ছিল। কিন্তু পরে ভেবে দেখেছি, তাঁর কথাতেও যুক্তি ছিল।

পরের বছর ছিল পঞ্চায়েত ভোট। বাংলায় পরিবর্তনের হাওয়া তখনই বইতে শুরু করে দিয়েছে। যে দিন পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফল বের হবে, সেদিনই প্রণব মুখার্জির ইসলামাবাদ সফরে যাওয়ার কথা। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে প্রথমে বৈঠক হবে। তারপরে প্রেসিডেন্ট জেনারেল মোশারফের সঙ্গে একান্ত বৈঠকের কথা। তার পরে সন্ধ্যার বিমানেই দিল্লি ফিরে আসবেন। জানিয়ে রাখা ভাল, কাজ ছাড়া দিল্লির বাইরে দু’দণ্ড অতিরিক্ত সময় থাকতে রাজি ছিলেন না প্রণববাবু। তাঁর পরিবর্তে অন্য কেউ হলে ইসলামাবাদ সফর অন্তত দু’দিনের হতো। সকালে গিয়ে বিকেলে ফিরে আসতেন না।

বেলা ১১টা নাগাদই ইসলামাবাদে পৌঁছে গিয়েছিলেন প্রণব মুখার্জি। তার পরেই ইসলামাবাদ থেকে তাঁর ওএসডি (অফিসার অন স্পেশ্যাল ডিউটি)-র ফোন। পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফল জানতে চাইছেন প্রণব মুখার্জি। তখনও পর্যন্ত যতটা ফলাফল ঘোষণা হয়েছে, তা জানালাম। কারণ, গণনা চলছে। তার পর থেকে আরও অন্তত তিনবার ফোন এসেছিল ইসলামাবাদ থেকে। সবই ভোট ফলাফলের আপডেট জানতে চেয়ে। দিল্লির রাজনীতিতে সর্বক্ষণ ডুবে থাকলেও বাংলার ব্যাপারে এতটাই সজাগ ছিলেন প্রণব মুখার্জি। এমন কোনও দিন ছিল না, যেদিন কলকাতার কোনও না কোনও কংগ্রেস নেতার সঙ্গে ফোন কথা বলতেন না তিনি, বা দিল্লিতে ডেকে আলোচনা করতেন না। বরং ভাল কিছু হলে কলকাতার কয়েকজন বন্ধুবান্ধবকে খুশি হয়েই জানাতেন।

মনে পড়ে, একবার চীন সফরে গিয়েছেন তিনি। তখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। সেদিন ছিলেন দুন হুয়াংয়ে। ডিনার করছেন। ডিনার টেবিলে প্রতিরক্ষাসচিব, তৎকালীন বিমানবাহিনীর প্রধান, বেইজিংয়ের ভারতীয় রাষ্ট্রদূত নলিন সুরী প্রমুখ রয়েছেন। কলকাতা থেকে প্রদেশ কংগ্রেসের এক নেতা মোবাইলে ফোন করেছিলেন। খাবার টেবিলেই ফোন ধরে বললেন, “বল তো এখন কোথায় আছি? আমি এখন গোবি মরুভূমিতে।” আরও কিছুক্ষণ ধরে তাঁকে জানালেন, ওখানে সারাদিন কী কী দেখেছেন। মোগাও গুহাচিত্র, ক্রিসেন্ট মুন লেক। রাজনীতির কোনও কথাই বললেন না বা শুনতে চাইলেন না। কিন্তু এই যে সারাদিনে কলকাতার কারও সঙ্গে তাঁর একবার কথা হল এতেই যেন কোথাও একটা রিলিফ হল তাঁর।

প্রণব মুখার্জির ইসলামাবাদ সফরের কথায় ফিরে আসি। দিল্লিতে রাত ১০টার মধ্যে ফিরে এসেছিলেন প্রণব মুখার্জি। রাতে আরও একবার পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফল নিয়ে ওনার সঙ্গে কথা হয়। বললেন, “আজ খুব টায়ার্ড। কাল একবার আয়।”

পরের দিন রাতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। বাংলা সংবাদপত্রের আরও এক প্রবীণ সাংবাদিকও ছিলেন। প্রণব মুখার্জির সঙ্গে তাঁরও দীর্ঘদিনের যোগাযোগ ছিল। ঘরে ঢুকতে নিজেই মুশারফের সঙ্গে বৈঠকের প্রসঙ্গ তুললেন প্রণববাবু। তার পর গড়গড় বলে গেলেন কী আলোচনা হয়েছিল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে। সে কথা এখানে লেখা যাবে না। গোপনীয়তার কারণেই তা সম্ভব নয়। তবে এটুকু বলাই যায়, প্রাথমিক সৌজন্য বিনিময় সেরেই জঙ্গি অনুপ্রবেশ নিয়ে মোশারফকে কড়া কথা শুনিয়েছিলেন প্রণব। এ ব্যাপারে প্রণব মুখার্জি অনেকটাই কট্টরপন্থী ছিলেন। মুম্বাই সন্ত্রাসের পরে বলতে গেলে, রোজ তিনি বিবৃতি দিতেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। কূটনৈতিকভাবে অন্য দেশগুলোকে পাশে পেতেও সমর্থ হয়েছিলেন তিনি। প্রণব মুখার্জি পরে মজা করে বলতেন, “আমাকে আর কামান দাগতে হল না, শব্দবোমাতেই কাজ হল।”

এমনিতে বাম নেতৃত্বের সঙ্গে বরাবর ভাল সম্পর্ক ছিল প্রণব মুখার্জির। বাংলা কংগ্রেসের সময় থেকেই সেই সম্পর্কের সূত্রপাত। বিশেষ করে জ্যোতি বসু তাঁকে খুবই স্নেহ করতেন। তবে ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তি নিয়ে বাম বিরোধিতায় কিছুটা চটেছিলেন প্রণব মুখার্জি। তিনি কখনওই চাননি বামেরা সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নিক। কিন্তু তার পরেও প্রকাশ কারাট অনমনীয় থাকায় প্রণব মুখার্জিও পাল্টা জেদ ধরেছিলেন। মনে পড়ে, বাম-ইউপিএ সমন্বয় কমিটির শেষ বৈঠকে, মানে যে বৈঠকে প্রকাশ কারাট জানিয়ে দিয়েছিলেন, পরমাণু চুক্তি মেনে নেওয়া তাঁদের পক্ষে কোনও ভাবেই সম্ভব নয়, প্রণব মুখার্জি সেদিন যেন আগ্নেয়গিরি হয়ে উঠেছিলেন। রাতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেছিলাম। অসন্তোষের কথা জানাতে জানাতে অনেক রাগ প্রকাশ করছিলেন।

এ প্রসঙ্গে একটা কথা না বললেই নয়, তা হল প্রণব মুখার্জির রাগ। শুধু সাংবাদিকরা নন, কংগ্রেসের তাবড় মন্ত্রী, নেতা, সরকারের শীর্ষ আমলা—সকলেই তাঁর সঙ্গে কথা বলতে ভয় পেতেন, বুঝে চলতেন। কখন রেগে যান প্রণব মুখার্জি! আমার কখনও কখনও মনে হত, ওই রাগটা কিছুটা আরোপিত। ইচ্ছা করেই রাগ দেখান প্রণব মুখার্জি। কারণ, সারাদিনে বহু লোক তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। অনেকের অনেক কিসিমের আবদার, আর্জি থাকত। সে সব নিয়ে কেউ যেন তাঁকে বেশি বিরক্ত করতে না পারে, সে জন্যই হয়তো রাগ দেখাতেন। কিন্তু ঘরোয়া আড্ডায় প্রণব মুখার্জি ছিলেন অসামান্য। পুরনো গল্প করতে বসলে ঘড়ির দিকে তাকাতেন না। কোথা দিয়ে যে সময় চলে যেত।

তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল হাতির মতো। একবার কিছু শুনে নিলে সারাজীবন মনে রাখতেন। এ ব্যাপারে দুটো গল্প মনে পড়ছে। ২০০৪ সালে প্রথমবার লোকসভা ভোটে জিতেছিলেন তিনি। আর ভোটে জিতে শুধু প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হওয়া নয়, লোকসভায় কংগ্রেসের নেতাও করা হয়েছিল তাঁকে। প্রথমবার লোকসভা ভোটে জিতেই সভার নেতা হওয়ার রেকর্ড ভারতীয় সংসদে সেই প্রথম। সেদিন, মানে লোকসভায় তাঁকে কংগ্রেস দলনেতা হিসেবে ঘোষণা করার পরে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, “এমন নজির নিশ্চয়ই আর কোথাও নেই।” প্রণব মুখার্জি শুনেই বলেন, “না এ দেশে নেই। তবে ১৯৭৮ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এক ভদ্রলোক ভোটে জিতেই সভার নেতা হয়েছিলেন।” ইতিহাসের সন, তারিখ, ঘটনা প্রায় ঠোঁটস্থ ছিল প্রণব মুখার্জির। এমনকি পশ্চিমবঙ্গে ষাট, সত্তরের দশকে বিভিন্ন বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস নেতারা কোন আসনে কত ভোট পেয়েছিলেন, কত ভোটের ব্যবধানে জিতেছিলেন তাও বলে দিতে পারতেন প্রণব মুখার্জি।

আর একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে, তাঁর কাছ থেকেই শোনা। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর একবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনও অনুষ্ঠানে গিয়েছেন প্রণব মুখার্জি। তখন উপাচার্য তাঁকে জানিয়েছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো সব রেজাল্ট ও রেকর্ড ডিজিটাইজড করা হয়েছে। শুনেই প্রণব মুখার্জি বলেন, “আমার স্নাতকোত্তর পরীক্ষার মার্কশিট, সার্টিফিকেট সব হারিয়ে গেছে। ৭৮ সালের বন্যায় সব নষ্ট হয়ে গিয়েছে।” উপাচার্য শুনে বলেন, “কোনও অসুবিধা নেই। আপনি শুধু সালটা বলুন।” শুধু সাল নয়, প্রণব মুখার্জি তাঁর অ্যাডমিট কার্ডের নম্বর, এনরোলমেন্ট নম্বর– সবই বলে দিয়েছিলেন তখনই। পরে এ গল্পটা মনমোহন সিংহকেও শুনিয়েছিলেন প্রণব মুখার্জি। মনমোহন নাকি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন।

ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনা কেবল নয়। সরকারি ফাইলের নোটিং, বিষয়-আশয় সবই মনে রাখতে পারতেন প্রণব মুখার্জি। এমনিতেই রোজ রাত ১টা-দেড়টা পর্যন্ত বাড়ির অফিসে বসে কাজ করতেন। ক্যাবিনেট বৈঠকের আগের রাতে সব অ্যাজেন্ডাগুলো এবং সেই সব ফাইল মন দিয়ে পড়ে ফেলতেন। আর কোনও মন্ত্রী এমন করতেন বলে জানা নেই।

প্রণব মুখার্জির মতো পরিশ্রমও আর কোনও মন্ত্রীকে করতে দেখিনি। অবসর বলে তাঁর জীবনে কিছু ছিল না। তাঁর তালকাটোরা রোডের বাড়িতে শুধু তিনি আর তাঁর স্ত্রী শুভ্রা মুখার্জি থাকতেন। ছেলেমেয়েরা থাকতেন গ্রেটার কৈলাসের বাড়িতে। কাজের বাইরে পরিবারকে বিশেষ সময় কখনও দেননি। মনে আছে, সোনিয়া গান্ধী একবার উত্তরাখণ্ডে ক’দিনের ছুটি কাটাতে গিয়েছেন। সে নিয়ে কথা হচ্ছে। প্রণব মুখার্জির কাছে জানতে চেয়েছিলাম, উনি স্ত্রী পরিবার নিয়ে কখনও বেড়াতে যেতেন কিনা। শুনে উনি বলেন, “আগে কয়েকবার গিয়েছি যখন মুন্নি, বাবু ছোট ছিল। ওদের নিয়ে করনাল বা বদখাল লেকে বেড়াতে যেতাম মাঝে মধ্যে। এক দু'বার শেখ হাসিনার ছেলেমেয়েদেরও (বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) ওখানে বোটিং করতে নিয়ে গিয়েছিলাম।” বলে রাখা ভাল, করনাল বা বদখাল লেক দিল্লির একেবারেই উপকণ্ঠে। তাঁর বাড়ি থেকে গাড়িতে বড়জোর চল্লিশ মিনিটের রাস্তা। এবং এই হল প্রণব মুখার্জির পারিবারিক বেড়ানোর গল্প। তাঁকে সেদিন বলেছিলাম, “স্রেফ এই কারণেই আপনার বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যেতে পারত কিন্তু!” শুনে হো হো করে হেসেছিলেন প্রণব মুখার্জি।

২০১১ সালে বিধানসভা ভোটের ফল প্রকাশের পরে যারপরনাই আনন্দিত ছিলেন প্রণব মুখার্জি। সেদিন কলকাতা থেকে যাঁরা তাঁকে ফোন করছিলেন, তাঁদের সকলের সঙ্গে কথা বলেন প্রণব মুখার্জি। তবে তার মধ্যে একটা ফোনে বিশেষ আহ্লাদিত হয়েছিলেন। তাঁর এক অনুগামী তাঁকে ফোন করে বলেন, “আপনি কি খেয়াল করে দেখেছেন, সিপিএমের থেকে বেশি আসনে জিতেছে কংগ্রেস? উনি শুনে বলেন, তাই নাকি! ভেরি গুড, ভেরি গুড!” মাত্র ৬১টি আসনে লড়ে কংগ্রেস যে সিপিএম-কে ছাপিয়ে যাবে, কল্পনাও করতে পারেননি তিনি।

আগেই বলেছি, ২০০৭ সালেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ ছিল তাঁর। কারণ, প্রণব মুখার্জি বুঝে গিয়েছিলেন, সরকারের ১ নম্বর ব্যক্তি তাঁর আর হওয়া হবে না। মনে পড়ে, ২০০৭ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পর সংসদের যৌথ সভায় যেদিন প্রতিভা পাটিলের শপথ গ্রহণ হয়েছিল, সে দিন লম্বা আড্ডা চলেছিল তাঁর সঙ্গে। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পর ঘোড়ায় টানা গাড়ি চড়ে রাইসিনা পাহাড়ে ফিরে যাচ্ছিলেন প্রতিভা। তা দূরদর্শনে লাইভ দেখাচ্ছিল। পার্লামেন্টে প্রণব মুখার্জির ঘরে তখন দূরদর্শনই খোলা ছিল। তা দেখতে দেখতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে ঘিরে নানান প্রথার কথা গল্পের মতোই শোনাচ্ছিলেন তিনি।

পাঁচ বছর পরেই সে ঘটনা ফিরে আসে প্রণব মুখার্জির জীবনে। দেশের রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হন প্রথম কোনও বাঙালি। ২০১২ সালের ২৫ জুলাই রাষ্ট্রপতি পদে শপথ নিয়েছিলেন তিনি। তবে রাইসিনা হিলসে গিয়ে প্রথম প্রায় মাস খানেক তিনি গেস্ট উইংয়ে থাকতেন। কারণ, রাষ্ট্রপতি ভবনে রাষ্ট্রপতির থাকার মূল অংশে তখনও নতুন রঙ করার কাজ চলছে। শপথ নেওয়ার দু’দিন পরই রাইসিনায় গিয়েছিলাম। রবিবার সকালে। গেস্ট উইংয়ে তাঁর স্টাডিতে পৌঁছে বলি, “ভাবতেই অবাক লাগছে, দেশের রাষ্ট্রপতির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছি। কোনওদিন স্বপ্নেও ভেবেছি কি?” উনি বললেন, “তুই তো বারুইপুরে বড় হয়েছিস। আমার জার্নিটার কথা তাহলে ভাব। সেই কীর্ণাহার থেকে উঠে এসেছি।” ওই সময়ের কীর্ণাহারকে প্রত্যন্ত বললেও কম বলা হয়। সহজ ছিল না কিন্তু। সেদিন রাষ্ট্রপতি ভবনের গেস্ট উইং নিজেই ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন তিনি।

রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়েও নিজেকে সব সময়ে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করে যেতেন প্রণব মুখার্জি। সমাজের সব স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলতেন। রাইসিনা পাহাড়ে গেট তিনিই প্রথম খুলে দিয়েছিলেন সাধারণ মানুষের জন্য। এমনিতেই উনি কেন্দ্রে মন্ত্রী থাকার সময়ে দেখেছি, তাঁর বাড়িতে রাত ১০টা-১১টা পর্যন্ত লোকজন আসতেন। কংগ্রেসের ছোট, বড় নেতা, মন্ত্রী থেকে শুরু করে ব্লক স্তরের নেতা পর্যন্ত সকলের জন্য দরজা খোলা ছিল। রাষ্ট্রপতি ভবনে ততটা সম্ভব ছিল না, তবু তার মধ্যেও রোজ বহু মানুষের সঙ্গে দেখা করতেন তিনি। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরেও সঙ্গে পুরনো মোবাইল ফোনটা রাখতেন। তাতে কেউ ফোন করলে সেটা ধরতেন। মজা করে উনি বলতেন, “আগের রাষ্ট্রপতিরা নাকি মোবাইল ফোন ব্যবহার করতেন না। কিন্তু আমি করি। আরে বাপু সংবিধান প্রণেতারা তো কখনও ভাবতে পারেননি একদিন মোবাইল ফোন আসবে। তাই রাষ্ট্রপতির মোবাইল ব্যবহারে কোনও বাধা নেই।”

এমনিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল। সাউথ ব্লকের সঙ্গে রাইসিনা হিলসের সুষ্ঠু বোঝাপড়া ছিল তাঁর জমানায়। সম্ভবত একবারই বিরোধ তৈরি হয়েছিল দুই অফিসের। সেটা ২০১৫ সালের কথা। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে প্রণব মুখার্জিকে অনুরোধ করেছিল, ইসরায়েল সফরে যেতে। তা এক কথায় নাকচ করে দিয়েছিলেন তিনি। সে কথা সবিস্তারে আমাকে বলেছিলেন প্রণব মুখার্জি। তাঁর মত ছিল, ইন্দিরা গান্ধীর সময় থেকে ভারতের বিদেশনীতির যে ধারা চলছে, তা এভাবে নষ্ট করা যায় না। তিনি এর শরিক হতে পারবেন না। দেশের সরকার যদি তাঁকে ইসরায়েলের সঙ্গে প্যালেস্টাইন সফরে যাওয়ার অনুমতি দেয়, তবেই তিনি সফরে যাবেন, নইলে নয়। সে খবর ‘এক্সক্লুসিভ’ ছিল আমার। দিল্লির অলিন্দে তা নিয়ে হইচইও পড়ে গিয়েছিল। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে কীভাবে সেই খবর বেরোল তা নিয়েও উদ্বিগ্ন ছিল সাউথ ব্লক। তবে শেষ পর্যন্ত প্রণব মুখার্জির জেদ মেনে নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। শুধু ইসরায়েল নয়, ভারসাম্যের কূটনীতিতে সেই সফরে ফিলিস্তিন ও জর্ডানেও গিয়েছিলেন প্রণব মুখার্জি।

রাষ্ট্রপতি ভবনে তার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর থেকেই প্রণব মুখার্জির শরীর খুব একটা ভাল যাচ্ছিল না। ততদিনে আমি দিল্লি থেকে ফের কলকাতায় বদলি হয়ে এসেছি। কলকাতায় এলেই তাঁর ঢাকুরিয়ার বাড়িতে ডাকতেন। শেষবার তাঁর সঙ্গে ভাল করে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল, সম্ভবত গত বছর পূজোর ঠিক পরে, বিজয়ায়। প্রণববাবুকে দেখে সেদিন মনখারাপই হয়েছিল। কানে কম শুনছিলেন। শরীরটাও আগের থেকে অনেকটা ভেঙে গেছিল। তার পর আর কলকাতা সফরে আসা হয়নি প্রণব মুখার্জির। আমারও আর দিল্লি যাওয়া হয়ে ওঠেনি। সেই শেষ দেখা তাঁর সঙ্গে।

বিডি-প্রতিদিন/শফিক

সর্বশেষ খবর