১ অক্টোবর, ২০২০ ১২:৪৩

আমলা রাজ্যে রাজনীতিবিদ যখন কামলা!

বাণী ইয়াসমিন হাসি

আমলা রাজ্যে রাজনীতিবিদ যখন কামলা!

বাণী ইয়াসমিন হাসি

বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র দর্শনের অন্যতম একটি অনুষজ্ঞ হচ্ছে সৎ প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত করা। আমলাদের দৌরাত্ম্য থেকে বের হতে না পারলে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না। পদ নেই, তবু প্রমোশন। গণতন্ত্রের জন্যও ব্যাপারটা ক্ষতিকর। নিরপেক্ষ আমলাতন্ত্র ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ছাড়া আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যত অর্থনৈতিক উন্নয়নই করুক, জনগণের কল্যাণ করতে পারবে না। আমরা জানি সুষ্ঠু গণতন্ত্রের স্বার্থেই প্রয়োজন দক্ষ আমলাতন্ত্র। সেই আমলাতন্ত্রের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রজাতন্ত্রের সেবক হিসাবে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করবেন।

আমাদের প্রশাসনের অবস্থা বুঝতে হলে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ল্যান্ট প্রিচেটের একটি তত্ত্ব খুবই প্রযোজ্য। তিনি বলেছেন, বিশ্বের বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশে পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুকরণ করা হয়েছে, কিন্তু পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাণশক্তি এখানে নেই। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে তিনি বলছেন আইসোমরফিক মিমিক্রি, অর্থাৎ সমরূপ কিন্তু কার্যক্ষমতাহীন এমন একটি অবস্থা। ধারণাটা নেওয়া হয়েছে বিবর্তনবাদী জীববিদ্যা থেকে। সেখানে দেখা যায়, অনেক সময়ে অনেক প্রাণী ভান করার চেষ্টা করে। যেমন একধরনের সাপ আছে, যাদের বিষ নেই। এই সাপগুলোকে মানুষ মেরে ফেলবে সে জন্য দেখা গেল, তারা নীল হয়ে গেছে। দেখলে মনে হয় এগুলো অসম্ভব বিষাক্ত। কিন্তু আসলে মোটেই তা নয়। বাংলাদেশে বর্তমানে যে ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলো ওই সাপগুলোর মতো। দেখে মনে হয় সবই ঠিক আছে, আসলে মোটেই ঠিক নেই। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশরা এ দেশে প্রতিষ্ঠা করে গেছে। ব্রিটিশ শাসনের মূল ভিত্তি ছিল আইসিএস অফিসাররা। এক হাজার আইসিএস অফিসার দিয়ে তারা সারা ভারতবর্ষ শাসন করত। এই শাসনের মূল লক্ষ্য ছিল: উন্নতি হোক বা না হোক, দেশবাসীকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। সেই নিয়ন্ত্রণে তারা রেখেছে, কিন্তু প্রকৃত অর্থে প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলেনি। এ অবস্থায় আইসোমরফিক মিমিক্রির ধরনের সমাধান করতে হলে দেশীয় আবহাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন করে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে।

বাংলাদেশে বর্তমানে যে আমলাতন্ত্র আছে, সেটাও আইসোমরফিক মিমিক্রি। বাইরে থেকে দেখতে মনে হয়, এটা সঠিক আমলাতন্ত্র। এখানে নিয়োগ হয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে, এখানে সরকারি কর্মচারীদের পদোন্নতি হয় আইন মেনে, আইন মেনে তারা কাজ করে যান। কিন্তু আসলে এগুলো কোনটাই সত্যি না। তবে আমরা অভিধানে বর্ণিত কিংবা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞার আলোকে উপস্থাপিত ‘আদর্শ আমলা’র সন্ধান বড় বেশি পাই না। আমরা সাধারণ অভিজ্ঞতায় দেখি আমলা হচ্ছে সরকারি চাকরি করা বড় বড় পদবিধারী ক্ষমতাধর মানুষ। যাদের কাছে সাধারণ মানুষ সহজে যেতে পারে না। তাদের স্যার, মহোদয় ইত্যাদি সম্মানসূচক বিশেষণ যোগ করে অত্যন্ত আদবের সঙ্গে সম্বোধন করতে হয়। তারা সব সময় একটা অদৃশ্য প্রাচীর রচনা করে চলেন। যেখানে সাধারণের প্রবেশাধিকার নেই। ফলে মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে আমলারা সবসময়ই একটা নেতিবাচক ভাবমূর্তির চরিত্র। যাদের মানুষ সমীহ করে, কিন্তু ভালোবাসে না !

আমাদের দেশের সরকারি কর্মকর্তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা ভোগ করেন, অনেকে ক্ষমতার দাপটও দেখান। তারা সব সময় চান আলাদা গুরুত্ব, আলাদা মর্যাদা, বাড়তি সুযোগসুবিধা। এই বাড়তি মর্যাদা ও সুযোগসুবিধা ভোগ করতে গিয়ে তাদের অনেকেই সাধারণ মানুষকে বিড়ম্বনায় ফেলেন। অথচ তাদের সেটা করার কথা না। জনসেবা, জনকল্যাণ, জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করাই যাদের একমাত্র কাজ হওয়ার কথা। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী বা রাষ্ট্রের এসব স্থায়ী কর্মচারীদের ইংরেজিতে বলা হয় পাবলিক সার্ভেন্ট বা জনগণের চাকর। তাদের একমাত্র কাজ জনগণের সেবা করা। কারণ তাদের বেতন-ভাতা হয় সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায়।

উল্লেখ্য, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নীতি নির্ধারণ করেন রাজনৈতিক নেতারা। আর সেই নীতি বাস্তবায়ন করেন প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। এদের আমলা বলা হয়। ‘আমলা’ আরবি শব্দ। এর অর্থ আদেশ পালন ও বাস্তবায়ন। শব্দগতভাবে তাই যে সকল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সরকারের আদেশ পালন ও বাস্তবায়ন করে তাদেরকে আমলা বলে। এই আমলাদের সংগঠন বা আমলা-সমাজের নাম বুরোক্রেসি বা আমলাতন্ত্র। জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েবার সর্বপ্রথম আমলাতন্ত্রকে একটি আইনগত ও যুক্তিসংগত মডেল হিসেবে উপস্থাপন করেন। তার তত্ত্ব অনুযায়ী, আধুনিক ধনতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র প্রশিক্ষিত প্রশাসক এবং কর্মীদের একটি সংগঠন হিসাবে চিহ্নিত। যার মাধ্যমে যুক্তিবাদী আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই আধিপত্য গড়ে ওঠে কর্তৃত্বের উপর নির্ভর করে।

আমাদের দেশে বেশিরভাগ আমলা এখন ‘নব্য জমিদারের’ ভূমিকায় অবতীর্ণ। তারা নিজেরাই নিজেদের নামে নানা ধরনের ‘মহত্ত্বের ছায়া’ আরোপ করে থাকেন। আমলাদের কাছ থেকে মানুষ ‘নিরপেক্ষতার নৈতিকতা’ আশা করে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা ঘটে না। তারা নিজেরাই ক্ষমতাবান হিসেবে আবির্ভূত হন। ক্ষমতার অপব্যবহার, সমাজে নিজেদের ‘ব্রাক্ষ্মণ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা, যুক্তির জোরের পরিবর্তে ‘জোরের যুক্তি’ প্রতিষ্ঠা করা–এগুলো শেষপর্যন্ত কোন ভালো ফল বয়ে আনে না। এতে জনরোষ সৃষ্টি হতে পারে। এটা রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যের জন্য মোটেও ভালো না। এমনকি আমলাদের নিজস্ব স্বাস্থ্যের জন্যও তা ভালো না। কাজেই কোথাও যেন কোনরকম বাড়াবাড়ি না হয়, তারা নিজেরা নিজেদের স্বর্গের দেবতা মনে করে ফুল-চন্দনচর্চিত আসনে অধিষ্ঠিত না করেন, সেদিকে নজর দেওয়ার সময় এসেছে।

আমলাদের নিজের দিকে তাকানোর সময় এসেছে। নিজেদের ‘আচরণ’ বদলানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। আমলাদের সম্পর্কে দার্শনিক কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন, ‘নিজেদের নাককেই তারা কর্তব্যের অস্ত্র মনে করেন এবং সব ব্যাপারেই সেইসব অস্ত্রের প্রয়োগ ঘটান। এই নাক গলানোর কর্মকাণ্ডই তাদের কাছে জাতীয় স্বার্থ এবং নিয়মের অর্থ’। তিনি আরও বলেছিলেন, আমলারা সম্পূর্ণভাবে কর্তৃত্বের পূজারি। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মত ব্যবহার করে এই আমলাসমাজ। লেনিনও আমলাদের সম্পর্কে একই রকম নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতেন।

রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতার সুযোগে আমলাতন্ত্র তার নখদন্ত প্রবলভাবে প্রকাশ করতে শুরু করে। আমলাতন্ত্রের দৌরাত্ম্য দেখে অনেকে একে ‘আমলাশাহীও বলে থাকেন। মিশেলসের তত্ত্ব অনুযায়ী দুর্বল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র তখন গোষ্ঠীতন্ত্রে পরিণত হয় এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বকে কুক্ষিগত করে তোলে। আমাদের দেশে আমলাদের তেমন রূপই আমরা বারবার দেখি। তাই তো অনেকে আক্ষেপ করে বলেন, ‘দেশ তো মন্ত্রীরা চালান না, আমলারা চালান’।

এই করোনা সংকটকালে সরকারি আমলাদের মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বলে জনপ্রতিনিধিরা অভিযোগও করেছেন। সচিবালয় ও মাঠ পর্যায়ে আমলাতন্ত্রের দাপটে চরম হতাশা তৈরি হয়েছে। অনেক সচিবই মন্ত্রীদের পর্যন্ত গুরুত্ব দেন না। সিদ্ধান্ত নেন নিজেদের মত করে। এতে উপেক্ষিত মন্ত্রী দুঃখ করেন বিভিন্ন মহলে। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের মত মাঠ পর্যায়েও কর্মরত অনেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা জনপ্রতিনিধিদের তোয়াক্কা করেন না। কেউ কেউ অতি উৎসাহ নিয়ে যোগ দেন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে। অনেক কর্মকর্তাই নিজের অতীত রাজনৈতিক অবস্থান তুলে ধরতে ব্যস্ত। তারা বর্তমান পরিচয় দিতে চান না। তারা আচরণে, কার্যক্রমে চলেন রাজনৈতিক কর্মীর মত করে। আমলাদের সীমাহীন ক্ষমতা প্রদর্শন করার কারণে মন্ত্রী, এমপি, সিটি মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়ররা অনেক সময় নিজের কর্মীদের কাছে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন।

আমলা রাজ্যে রাজনীতিবিদ আজ কামলার ভূমিকায় অবতীর্ণ। এটার পরিণাম মোটেও সুখকর কিছু হবে না। দিনশেষে একজন রাজনীতিবিদের দায়বদ্ধতা থাকে তার কর্মীর কাছে আর জনপ্রতিনিধির জবাবদিহিতা থাকে তার ভোটার বা জনগণের কাছে। কিন্তু আমলারা সব জবাবদিহিতার উর্ধ্বে। তাদের  কমিটমেন্টের জায়গাটাও বড্ড নড়বড়ে। ক্ষমতা যার; তখন তার। এখন সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে সুবিধাবাদী সুযোগসন্ধানী আমলাতন্ত্র নাকি দলের পরীক্ষিত নেতা জনপ্রতিনিধি ? কাকে মাথায় তুলবেন আর কাকে মাটিতে রাখবেন সেটা ভাবারও সময় এসেছে।

লেখক: সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট। 

বিডি প্রতিদিন/হিমেল

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর