২৬ এপ্রিল, ২০২১ ০৫:৪৭

আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কর্মীরা কোন আপোষ চান না

বাণী ইয়াসমিন হাসি

আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কর্মীরা কোন আপোষ চান না

বাণী ইয়াসমিন হাসি

নানা আলোচনা সমালোচনার মধ্যে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেছেন এর আমির জুনায়েদ বাবুনগরী। রোববার রাতে এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “দেশের বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এর কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের পরামর্শক্রমে বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হইলো।”

নতুন একটি আহ্বায়ক কমিটির মাধ্যমে হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে বলে জানান বাবুনগরী।
হেফাজতে ইসলামের ফেসবুক পাতায় এক মিনিট ২৪ সেকেন্ডের এক ভিডিও বার্তায় বিবৃতিটি পড়েন তিনি।

নতুন কমিটি গঠনের ছয় মাস পার হওয়ার আগে নরেন্দ্র মোদির সফরকেন্দ্রিক বিক্ষোভ থেকে সহিংসতার ঘটনার পর পুলিশি অভিযানে চাপে থাকার মধ্যে বাবুনগরীর এই ঘোষণা এলো। তার এই বার্তা প্রচারের কয়েক ঘণ্টা আগেই কওমি মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের সব ধরনের রাজনীতি ‘মুক্ত’ রাখার ঘোষণা দেয় মাদ্রাসাগুলোর নীতি নির্ধারণী বোর্ড আল হাইআতুল উলয়া লিল জামি’আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের আমির ছিলেন চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক শাহ আহমদ শফী।

তিনি গত বছর মারা যাওয়ার পর নানা আলোচনার মধ্যে গত ১৫ নভেম্বর সম্মেলনে বাবুনগরীকে আমির করে হেফাজতের ১৫১ সদস্যের নতুন কমিটি গঠিত হয়েছিলে। দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকা হেফাজতের নেতারা গত বছরের শেষ দিকে ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধীতায় নেমে ফের আলোচনায় আসে। সংগঠনটির নেতা মামুনুল হক ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার হুমকি দিয়েছিলে। পরে তিনি হেফাজতের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিবের পদ পাওয়ার পাশাপাশি ঢাকা কমিটির সাধারণ সম্পাদকও হন।  

গত মাসের শেষ দিকে মোদির সফরের বিরোধীতায় নেমে নতুন করে আলোচনায় আসে হেফাজতে ইসলাম। সংগঠনটির বিক্ষোভ ও হরতালে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামে সহিংসতায় বেশ কয়েকজন নিহত হয়।

২০১৩ সালে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিতে মতিঝিলের শাপলা চত্বরসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে তাণ্ডব চালানো এ সংগঠনের নেতারা এবার রাজনৈতিক অভিলাষ নিয়ে মাদ্রাসা ছাত্রদের উসকানি দিয়ে মাঠে নামিয়েছিলে বলে পুলিশের ভাষ্য। গত কয়েক দিনে হেফাজতে ইসলামের বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাকে নাশকতা ও সহিংসতার মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যারা বিভিন্ন কওমি মাদ্রাসার সঙ্গে যুক্ত এবং বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক সংগঠনের নেতৃস্থানীয় পদে রয়েছেন।

একটু পেছনে ফেরা যাক। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। এরই ভিত্তিতে এক পক্ষকাল সময়ের ভেতর ’৭১-এর ১০ এপ্রিল প্রণীত হয়েছিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, যা ছিল নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক, সামাজিক ও আইনগত ভিত্তি।

’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ নিছক একটি ভূখণ্ড লাভ কিংবা পতাকা বদলের জন্য হয়নি। নয় মাসব্যাপী এই যুদ্ধ ছিল প্রকৃত অর্থেই মুক্তিযুদ্ধ। দেশের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতী মানুষ এই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন সার্বিক মুক্তির আশায়। জনগণের এই আকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়েছিল ’৭২-এর সংবিধানে।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের দর্পণ ’৭২-এর সংবিধান। এই সংবিধান কার্যকর থাকলে বাংলাদেশে আজ ধর্মের নামে এত নির্যাতন, হানাহানি, সন্ত্রাস, আগুন, রক্তপাত হতো না। বাংলাদেশের ৫০ বছর এবং পাকিস্তানের ৭৪ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যাবতীয় গণহত্যা, নির্যাতন ও ধ্বংসের জন্য দায়ী জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সমগোত্রীয় মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক দলগুলো, যা তারা করছে ধর্মের দোহাই দিয়ে।

সাপকে বিশ্বাস করা যায় কিন্তু হেফাজতকে নয়। এরা আবার নতুন মোড়কে ফিরে আসবে না তার কি নিশ্চয়তা আছে? লোহা গরম থাকতে থাকতেই বাঁকাতে হয়। এখন সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে-বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন/দর্শন নাকি অন্ধকারের পথে হাঁটা ?

সরকারের কাছে বিনীত অনুরোধ রইলো, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বা ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধ করার এটাই মোক্ষম সময়। দেশকে উলটোপথে নিয়ে যাওয়ার সকল রাস্তা বন্ধ করার উদ্যোগ নিন। ‘৭২ এর সংবিধান ফিরিয়ে আনুন।

আর কমিটি বিলুপ্তির ঘোষণা ভন্ড ধর্ম ব্যবসায়ীদের নতুন কৌশল। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলুক। থেমে গেলে চলবে না। বিষধর সাপকে যতই দুধ কলা খাওয়ান ছোবল মারবেই। তাই কমিটি বাতিল হলেও অপরাধীদের শাস্তি মওকুফ করা যাবে না। 

গত কয়েকদিন ধরে মূলত দায় এড়াতে হেফাজতের বিভিন্ন জেলা ইউনিটের নেতারা পদত্যাগ করছিল। এটা জামাতী কৌশল।
জ্বালাও পোড়াওয়ের মাধ্যমে যারা দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলেছিল, তাদের প্রত্যেককেই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। কোন ছাড় দেয়া চলবে না।

কমিটি বিলুপ্ত করে হেফাজত প্রমাণ করলো তাদের বিরূদ্ধে আনীত সব অভিযোগ সত্য। তারা ধর্ম ব্যবসায়ী। তারা ধর্মের নামে এতদিন অপরাজনীতি করেছে। দেশী বিদেশী অপশক্তির ইন্ধন এবং অর্থায়নে তারা দেশকে অস্থিতিশীল এবং সরকারকে ক্ষমতাচ্যূত করতে মাদ্রাসার ছাত্রদের মাঠে নামিয়ে ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র করেছে। রাষ্ট্রের সম্পদ বিনষ্ট এবং মানুষ হত্যা করেছে। কাজেই এসব অভিযোগে হেফাজতকে আইন করে নিষিদ্ধ করা হোক।

হেফাজতের কমিটি বিলুপ্তির খবরে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার মত কিছু নেই। কমিটি বিলুপ্তির ষোষণার পাশাপাশি বাবুনগরী এটাও ঘোষণা করেছেন, নতুন একটি আহ্বায়ক কমিটির মাধ্যমে হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে। নতুন বোতলে পুরোনো মদ এই আর কি। হেফাজতের এটি একটি কৌশলমাত্র। অনেক সময় চার পা আগানোর জন্য দুই পা পেছাতে হয়। ব্যাপারটা এমনই আর কি। ভবিষ্যতে তারা আরো বিষধর হয়ে ফেরত আসবে। তাই যতটা সম্ভব বিষদাঁত ভেঙে দেওয়া হোক।

হেফাজতে ইসলাম যেকোন কৌশলে আগে ওহাবীবাদকে বাঁচাতে চাইছে। এরপর আসবে সব কওমী হেফাজত নয় এই থিওরী। সরকার, আওয়ামী লীগ এবং প্রশাসনে হেফাজতের যে বড় একটা অনুসারী গোষ্ঠী রয়েছে এটা সম্ভবত তাদের দেওয়া প্রেসক্রিপশন। এখানে বাবুনগরী জাস্ট নিউজ প্রেজেন্টারের ভূমিকায় !

২৪ মার্চে কেউ কিন্তু আন্দাজও করতে পারেনি হায়েনার দল ২৫ মার্চের কালো রাতে কি অঘটন ঘটাতে যাচ্ছে। ১৪ ই আগস্টও কারো কল্পনায়ও ছিল না এত বড় আঘাত বাঙ্গালির জন্য অপেক্ষা করছে। 

কমিটি বিলুপ্তির এই নাটক চূড়ান্ত সহিংসতার আগের শেষ ছদ্মবেশ। হুজি, হিযবুত তাহরীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, জেএমবিতে ভাগ হয়ে সবাই মিলে একসাথে তালেবানী প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার সুবিধার্থে এই কৌশল নিলো এরা। আনুষ্ঠানিক কমিটি না রেখে এখন অঞ্চলভেদে মিশন সেট করবে এরা। তাহলে কেন্দ্রীয়ভাবে কাউকে ধরার সুযোগ থাকবে না। ইউনিট হবে অনেকগুলো। জঙ্গিবাদি কার্যক্রম চালাতে সুবিধা হবে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য কঠিন হবে এদের ওপর নজরদারি চালানো।

তাই এদের ফাঁদে পা না দিয়ে, সব সহিংসতার স্থায়ী মূলোৎপাটনের দিকে আরো গভীরভাবে নজর দেওয়া প্রয়োজন এখন। নতুন বছরের শুরুর আগেই মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিক করা হোক; ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য বাধ্যতামূলক করা হোক। পাশাপাশি জাতীয় সংগীত গাওয়া এবং জাতীয় পতাকা উত্তোলন বাধ্যতামূলক করা হোক। বলাৎকার বন্ধে মাদ্রাসা পরিচালনা ব্যবস্থায় আমূল সংস্কার আনা হোক এখনই। সাপের লেজ পর্যন্ত বিনাশ নিশ্চিত করা হোক।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাছে গত একমাসে একটা পরিস্কার বার্তা দিয়েছে সংগঠনের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তারা হেফাজতের সাথে নতুন কোন আপোষ মেনে নেবে না। আওয়ামী লীগের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা হেফাজত লীগের ব্যাপারেও তারা সমান ভাবে সোচ্চার ছিলেন। ‌অনেকে মনে করেন তৃণমূলের চাপের কারণে কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকের হেফাজত প্রীতি থাকলেও সেটা নিয়ে নেগোসিয়েশনের সাহস করেননি। মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলের সাথে ‘আপোষ’ শব্দটা ঠিক যায় না। কর্মীদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। বরং আপোষহীন আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্যতা বেশি। সকল প্রকার ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে অবস্থান অসাম্প্রদায়িক মানবিক বোধ সম্পন্ন মানুষের মধ্যে আওয়ামী লীগকে জনপ্রিয় করবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা কোন আপোষ চান না।

লেখক: সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট।

বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর