১০ এপ্রিল, ২০২২ ১৪:২৫

বরিশালে শুরু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ

আলম রায়হান

বরিশালে শুরু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ

জিয়া উদ্দিন আহমেদ বাবলু

বরিশাল আমার নিজের শহর। শহর থেকে পাচঁ কিলোমিটার পশ্চিমের গ্রাম ধর্মাদীতে আমার জন্ম। শহরে আসতে হতো শুকনো মৌসুমে রিকশায় বা পায়ে হেঁটে। বর্ষা কালে প্রায় এক হাঁটু কাঁদা-জল মাড়িয়ে। সেচের পানির যোগান, মাছের উৎস এবং মালামাল পরিবহনের জন্য ছিলো স্বচ্ছ জলের খরস্রোতা খাল। কেবল গ্রামে নয়, বরিশাল শহরের মধ্যে দিয়েও প্রবহমান ছিলো অন্তত অর্ধশত খাল। শহরের সেই খালগুলো এখন ড্রেনেরও অধম। এই শহরকে আমি চিনি ক্লাস থ্রিতে পড়াকাল থেকেই। কিন্তু রাজধানী ঢাকা দেখেছি ইন্টারমেডিয়েট পাস করার পর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার সময়। এই ভর্তির সুযোগ পাওয়া যত না আমার যোগ্যতায়, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিলো সেই সময়ে ভর্তির সহজ শর্ত ও শিথিলতা।

আমি এটাস্ট ছিলাম মহসিন হলে। কিন্তু প্রথম দিকে থাকতাম সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে। আমার এক স্বজন থাকতো জহিরুল আলম নান্নার রুমে। রুম নম্বর সম্ভবত ২০০৭। সে সময় জহুরুল হকের ভিপি ছিলেন মো. খলিলুর রহমান মোহন। তিনি পরপর দুইবার ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন। ছাত্রজীবন শেষে রাজনীতিতে দীর্ঘ সময় অবহেলিত ছিলেন। জীবনের গোধূলি বেলায় পটুয়াখালী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। জহুরুল হক হলে তাঁর প্যানেলে প্রথমবার জিএস ছিলেন মনিরুজ্জামান মনির। দ্বিতীয়বার লিয়াকত আলী মন্ডল। ভিপি হিসেবে খলিলুর রহমান মোহন খুবই প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় ছিলেন। ছাত্রসংসদ ও হল রাজনীতি বরিশাল-ফরিদপুর ‘জোটের’ একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে ছিলো। ভিপি-জিএস দুজনই আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। সব মিলিয়ে জহুরুল হক হলে আমার প্রভাব ছিলো। নিরাপত্তাও ছিলো নিশ্চিত। জহিরুল হক হলের ভিপি হিসেবেই ডাকসুর ভিপি হয়েছেন তোফায়েল আহমেদ। সেই সময়কার বিধানে বাইরোটেশন হলের নির্বাচিত ভিপিই ডাকসুর ভিপি হতেন। পরে সরাসরি নির্বাচন ব্যবস্থা চালু হয়।

জহুরুল হক হল আওয়ামী ছাত্রলীগের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিলো। এদিকে আমি জাসদ ছাত্রলীগের, এটাস্ট মহসীন হলে। এরপরও জহুরুল হক হলে বেশ দাপটের সঙ্গে ছিলাম বরিশালের হওয়ার কারণে। তবে এ হলের রাজনীতি বা অন্য কোন বিষয়ে মোটেই জড়াতাম না। আমার রাজনীতির পুরোটাই ছিলো ক্যাম্পাস ও আমার নিজের মহসীন হল কেন্দ্রিক। সকাল বেলা মহসীন হলের ক্যান্টিনে নাস্তা দিয়ে শুরু হতো আমার দিন। সে দিন যত না ছাত্রত্বের তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক। ক্যান্টিনে পরোটা ২৫ পয়সা, ডিমপোচ ১ টাকা। কিন্তু পোচ করার আগে ডিমের সাদা অংশের বেশ খানিকটা কৌশলে রেখে দেয়া হতো। যা ব্যবহার করা হলো ডিমের মামলেটে। যে কারলে ডিম পোস হতো ছোট সাইজের আর মামলেট হতো সাদাটে। ডাইনিং হলের অবস্থা ছিলো আরও নিদারুণ। এক বেলার খাবার খরচ দুই টাকা। কিন্তু ভাত রান্না করা হতো প্রায় অচল চাল দিয়ে। অধুনা ‘প্লাস্টিকের’ চালের চেয়েও অধম। আর সবজি তখনই হলের ডাইনিং-এ আসতো, সিজন শেষে যখন তা গোখাদ্যের পর্যায়ে নামতো। আর জেলখানার মতো মিষ্টি কুমড়া ছিলো সারা বছরের সবজি। এদিকে মাছ এমন পাতলা এবং মাংস এতো ছোট করে কাটা হতো যা কেবল বিশেষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব। আর ডাল? জেনো গঙ্গাজল! আমার এক কাজিন আনসার আলী খাবার প্লেট ধুয়ে ডালের গামলায় ফেলেছিলো। রং দেখে সে ভেবেছিলো, নোংরা পানি।

তখন আবু হেনা মোস্তফা কামাল ছিলেন মহসীন হলের প্রভোস্ট। তিনি খাবারের মান উন্নয়নের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সফল হয়েছেন- এমন প্রমাণ ৮৫ সালে হল ছাড়া পর্যন্ত পাইনি। এর আগেই পরের প্রভোস্ট এসে খাবারের মান বৃদ্ধির পরিবর্তে মিল চার্জ পঞ্চাশ পয়সা বাড়িয়ে আড়াই টাকা করার চেষ্টা করেছিলেন। এ ঘটনায় আমরা তার বাসার ড্রইং রুমে ভাংচুর করেছিলাম। টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছিলো। এসব কাণ্ড হয়েছে তার উপস্থিতিতেই। তবু তিনি অনমনীয় ছিলেন। আমাদের দাবির মুখে তিনি বারবার বলছিলেন, ‘আই ক্যান্ট, আই ক্যান্ট।’ তবে শেষতক সেবার মিলচার্জ বাড়াতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। আমাদের আন্দোলনের নেতা ছিলেন নাজমুল ভাই। তিনিই ছিলেন হল সংসদ নির্বাচনে আমার প্যানেলের ভিপি প্রার্থী। সে সময় হলের প্রভাবশালী বড় ভাইরা প্রায় সবাই জাসদ ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এই বড় ভাইদের মধ্যে সর্বপ্রথম চিনেছি নূর মোহাম্মকে। তিনি হল সংসদের ভিপি ছিলেন। হাসি-খুশি সুদর্শন মানুষ বলে কেবল নয়, ভিপি ছিলেন বলেই শুরুতেই চিনতাম নূর মোহাম্মদকে। এই চেনার বিষয়টি ছিলো এক তরফা। তিনি আমাকে চিনতেন না। তবে শীঘ্রই চিনেছিলেন ঘটনাচক্রে।

ডাইনিং হলের খাবারে মান ও শৃংখলা দেখার জন্য মাঝেমধ্যে হল সংসদের নেতারা দুপুরে ডাইনিং হলে উপস্থিত থাকতেন। এটি ছিলো রুটিন ওয়ার্কের মতো মামুলি ঘটনা। এই মামুলি ঘটনার সূত্রেই একদিন গুরুতর অঘটন ঘটার অবস্থা হয়ে দাঁড়ালো। ওই দিন দুপুরে মাহফুজুর রহমান খোকন, শামসুল হক এবং আরও কয়েকজন ক্লাস মেইট ও রাজনীতির সতীর্থ এক টেবিলে খাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম, নূর মোহাম্মদ ভাইকে একজন ধাক্কা দিয়েছে। হঠাৎ আমার মাথায় রক্ত উঠে গেলো। ভাবখানা এই, ‘আমার ভিপিকে ধাক্কা দেয়,  এত্ত বড় সাহস!’ ভুলেই গেছিলাম, বরিশালে নয়, ঢাকায় আছি।

খাওয়া ছেড়ে উঠে গিয়ে ধাক্কা প্রদানকারীকে দিলাম কষিয়ে এক চড়! তখন জানি না তিনি আমার ডিপার্টমেন্টের বড় ভাই। মাস্টার্স-এর ছাত্র। আর আমার কেবল সূচনা, ফাস্ট ইয়ার। যাকে চড় মেরেছি তিনি ছিলেন হল ছাত্রদলের প্রভাবশালী নেতা, নাম কামাল। ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও রাজনীতিক শফি আহমেদের কাছে সম্প্রতি শুনেছি, ‘ফাউল’ হিসেবে কামাল ভাইর কুখ্যাতি ছিলো। এরপরও আমার চড় খেয়ে কামাল ভাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলেন। মারমুখী প্রতিক্রিয়া দেখানোর বোধ হারিয়ে ফেলেছিলেন। হতে পারে, তিনি আমাকে বিশাল ক্যাডার মনে করেছিলেন। ভেবেছিলেন হয়তো, চড় খাবার প্রতিক্রিয়া দেখালে গুলি খেতে হবে। অথচ বিষয়টি মোটেই সেরকম ছিলো না। আমি তখন হল বা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির কিছুই না।

চড় খেয়ে কামাল ভাই প্রতিক্রিয়া না দেখালেও নিশ্চিতভাবে তার প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো। কিন্তু আমার কোনো ভাবান্তর ছিলো না। তখনও আমি বরিশাল এবং ঢাকার মধ্যে ব্যবধান অনুধাবন করতে পারিনি। যে কারণে হয়তো আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসীন হলকে বরিশাল শহরের বটতলা এলাকা ভেবেছিলাম। যেখানে উঠতি যৌবনের চার বছর কাটিয়ে বার্ধক্যে আবার ফিরে এসেছি প্রিয় শহর বরিশালের বটতলায়। এযেনো বৃত্তের শুরুর বিন্দুতে ফিরে আসা। আগের স্থানে ফিরে আসলেও কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। পুলিশের তৎপরতার ও জনসম্পৃক্ততার কারণে আগিলা তরিকার শহরে সন্ত্রাস ও মহল্লা ভিত্তিক মারারির ঘটনা আর ঘটে না। কিন্তু মাদকের আগ্রাসন যেন নিয়ন্ত্রণহীন। এই মাদক বাণিজ্যকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট। এরা এখন নগরীর সকল অপরাধের হোতা। এই চক্র আইন-শৃংখলা বাহিনীর এক শ্রেণির সদস্যের সাথে সখ্যতা রক্ষা করে। আর মাদক কারবারীদের ঐক্য অনেকটা সর্বদলীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামায়াত বিভাজন নেই। আর এরা খুবই ঐক্যবদ্ধ। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের সাইনবোর্ডধারীরা বেশি প্রভাবশালী। কারণ তাদের কাছ থেকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও অন্যান্য বাহিনীর তোলাবাজরা বখরাটা পুরো আদায় করতে পারেন, সেরের উপর সোয়া সের। সরকারি দলের সাথে সম্পৃক্তদের কাছ থেকে যা আদায়ে কিছুটা অসুবিধা হয়। অনেক সময় তামাদিও হয়ে যায়।

চড় খেয়ে কামাল ভাই ডাইনিং রুমে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া না দেখালেও বাইরে গিয়ে মহা ঘোট পাঁকিয়েছিলেন। ডাইনিং হল থেকে বের হবার সময় লক্ষ করলাম, কলাপসিবল গেটের দুই ধারে দুটি বেশ বড় জটলা। সবাই চুপচাপ। একটু খটকা লাগলো। তবে এ নিয়ে তেমন ভাবিনি। খোকনের সঙ্গে ছয় তলায় তার রুমে গেলাম। আড্ডা ছিলো লক্ষ্য। কিন্তু আড্ডা শিকেয় উঠলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে ৬/ক রুমে ডেকে নেয়া হলো। ছয় তলার এই রুম পরিচিত ছিলো হল ছাত্রলীগের ‘কন্ট্রোল রুম’। শুধু তাই নয়, তখন ক্যাম্পাস ও কয়েকটি হলেরও অনেক কিছু নিয়ন্ত্রিত হতো মহসীন হলের এই রুম থেকে। নিয়ন্ত্রক মোশতাক ভাই, মোশতাক আহম্মদ। ছোটখাটো শরীরের তখন বিশাল মানুষ; মেধা-মনন-ক্ষমতার। বললেন, কি করেছো! এখানে থাকো। রুম থেকে বের হবা না! এই বলে তিনি বের হয়ে গেলেন। ততক্ষণে আমার বেশ হুঁশ হয়েছিলো। তবে ভয়ে বেহুশ হবার অবস্থায় যাইনি। ভয়টা চিরকালই আমার একটু কম।

পরে জেনেছি, আমার এক চড়ে মহাজটিলতা সৃষ্টি হয়েছিলো। বারুদের গুদামে জ্বলন্ত সিগারেট ছুঁড়ে দেবার মতো। হলে রণসজ্জায় মুখোমুখি হয়েছিলো ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল। বন্দুকযুদ্ধ হবার অবস্থা! পরিস্থিতি সামলে ছিলেন মোশতাক ভাই। এ খবর রটে যায় জহুরুল হক হল ও সূর্য সেন হলেও। এ পরিস্থিতি আমাকে বেশ পরিচিতি যেমন দেয়, তেমনই বিপদগ্রস্তও করে। তবে বেশ পুলক বোধ করছিলাম। এক রকম অর্বাচীন হিরোইজম। বলা বাহুল্য, কেবল আমি নই; জাসদ ছাত্রলীগের সকলেই এ ধরনের হিরোইজমে আক্রান্ত ছিলেন। যা ছিলো জাসদ রাজনীতির মূল পূঁজি। কিন্তু হতাশ পথে হাঁটতে শুরু করলাম মান্না-আক্তারকে বহিস্কারের মধ্য দিয়ে জাসদ ছাত্রলীগে বিশাল ভাঙনের পর। ভাবলাম, যারা নিজেদের ঐক্যই ধরে রাখতে পারে না, তারা কিসের সমাজতন্ত্র, কিসের কী করবে!

এরমধ্যে ডাকসু ও হল সংসদগুলোর নির্বাচন এলো। ডাকসুতে প্রার্থী যথারীতি ছাত্রলীগ থেকে বহিস্কৃত মান্না-আক্তার এবং মূলধারার মুনির-হাসিব। মহসীন হল সংসদে বহিস্কৃত গ্রুপের ভিপি প্রার্থী ছিলেন গোলাম কুদ্দুস। মূল ধারার প্যানেলের এজিএস প্রার্থী ছিলাম আমি। নির্বাচনের ফলাফলে জাসদ ছাত্রলীগ থেকে বহিস্কৃত গ্রুপের জয়জয়কার এবং মূল ধারার নিদারুণ পরাজয়। একই সময় সূচিত হলো সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের পেটোয়া বাহিনী ছাত্রদলের বিজয়ের ধারা। মহসীন হলের জিএস পদে বিজয়ী হলেন ছাত্রদলের জাকিরুল ইসলাম। চিরকালই তিনি মাথা গরম লোক হিসেবে পরিচিত। ছাত্র জীবন এবং সরকারি চাকরি জীবন- সমান ধারায় কেটেছে। ছাত্রজীবনে খালিদ মাহমুদ নামে এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ও খণ্ডকালীন সাংবাদিককে মহসীন হলের দোতলা থেকে ফেলে দিয়েছিলেন। চাকরি জীবনের শুরুর দিকে গাজীপুরে কর্মরত থাকাকালে ক্ষমতাসীন জাতীয় পার্টির নেতা হাসানউদ্দিন সরকারকে হেনস্থা করার ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। নির্দেশ মতো গুলি করতে অস্বীকৃতি জানালে পুলিশের হাত থেকে রাইফেল ছিনিয়ে নিয়ে জাকিরুল ইসলাম নিজেই গুলি করেছিলেন ম্যাজিস্ট্রেটকে। বেগম খালেদা জিয়া সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা থাকাকালে তিনি একান্ত সচিব ছিলেন। তখনও তিনি নানান কারণে আলোচিত হয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি আলাচিত হয়েছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন) থাকাকালে।

সেবার জাকিরুল ইসলাম ছিলো মহসীন হল সংসদে ছাত্র দল থেকে একমাত্র বিজয়ী প্রার্থী। এ নির্বাচনে বরিশাল গ্রুপসহ আরও অনেকে প্যানেল বিবেচনার বাইরে আমাকে ভোট দিয়েছিলো। এরপরও নির্বাচনে আমার হয়েছে নিদারুণ পরাজয়। কারণ আমার সংগঠনের ছিলো ভাঙ্গা হাট। তখন থেকেই হাড়েহাড়ে অনুধাবন করতে শুরু করেছি, ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা থাকলেও সংগঠন বেশি দুর্বল হলে সুষ্ঠু নির্বাচনে বিজয় লাভ সাধারণত সম্ভব হয় না। তবে অতি জনপ্রিয় হলে ভিন্ন কথা। এ অভিজ্ঞতা আমার আছে। অবিভক্ত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সর্বশেষ নির্বাচনে আমার প্যানেল ছিলো আওয়ামী লীগ ঘেঁষা এবং সঙ্গত কারণেই দুর্বল। তখন রমরমাভাব ছিলো ক্ষমসীন বিএনপি ঘেঁষা প্যানেলের। নির্বাচনে শক্তিশালী বিএনপি-জামায়াত কানেকশনের প্যানেলের বিপুল বিজয় হলেও দুর্বল প্যানেল থেকে মাত্র কয়েকজন যারা বিজয়ী হয়েছেন তাদের মধ্যে আমি একজন। তবে নির্বাচনী ধারায় এটি ব্যতিক্রম। সাধারণত নির্বাচনে বিজয়ী হতে হলে শক্তিশালী দল প্রয়োজন হয়। আবার দল হলেই সবার ক্ষেত্রে বিজয় অনিবার্য হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। যেমন ড. কামাল হোসেন। তিনি বারবার প্রমাণ করেছেন, নিজে জনবিচ্ছিন্ন হলে কেবল দলীয় ভোটে নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়া সম্ভব নয়। সমারসেট মমের গল্পের প্যাকেলস টাইলস টাইগার গল্পের নখ-দন্তহীন বাঘের মতো বৃদ্ধ বিচারপতি আবদুস সাত্তারের সাথে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েও অন্তত এক কোটি ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন ড. কামাল হোসেন। শুধু তাই নয় সংসদ নির্বাচনে মিরপুরের এস এ খালেকের সঙ্গে হেরেছেন, হারার নিদারুণ অভিজ্ঞতা আছে অখ্যাত প্রার্থীর সঙ্গে ডেমরায়ও।

ভোটে জেতার জন্য দল এবং নিজস্ব গ্রহণযোগ্যতার যোগসূত্র অনিবার্য। এর কোন একটির বেশি ঘাটতি হলে নির্বাচনে জেতা প্রায় অসম্ভব। নির্বাচনের সাধারণ এই ধারার আওতায়ই ভাঙ্গনের পর জাসদ ছাত্রলীগের মূল ধারা যে মাজুল দশায় পড়েছিলো তারই প্রকট ছবি মিলেছে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে। আবার দল ছিলো না বলেই বহিস্কৃত মান্না-আক্তার গ্রুপের জনপ্রিয়তা ও নির্বাচনে বিপুল বিজয় রংধনুর মতো সুন্দর হয়েছে, কিন্তু স্থায়ী হয়নি। আর এ ঘটনায় শক্ত ভিত্তি পায় সামরিক শাসক জেনারেল জিয়ার ছাত্রদল। আবার এর ছিটেফোঁটা সুবিধা পেয়েছিলেন আর এক সামরিক শাসক জেনালের এরশাদ। জাসদ ছাত্রলীগ ভেঙে যাওয়ায় যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিলো তার ধারায় ছাত্রদল যেমন শক্ত ভিত্তি পায় তেমনই পরবর্তীতে এরশাদের ছাত্র সমাজ গঠনও সহজতর হয়েছিলো। এক্ষেত্রে জেনারেল এরশাদের জন্য বাড়তি সুযোগ সৃষ্টি হয় আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে পুনরায় বাকশাল-এর সাইবোর্ড নিয়ে আলাদা হলে ছাত্রলীগের এক অংশ জাতীয় ছাত্রলীগ গঠন করায়। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, আ স ম রবের কারসাজিতে জাসদ ছাত্রলীগে ভাঙ্গনের ফলে সুবিধা হয়েছে জেনারেল জিয়াউর রহমানের। আর আবদুর রাজ্জাকের নেতেৃত্বে আওয়ামী ছাত্রলীগে ভাঙ্গনের ফলে সুবিধা হয়েছে জেনালের এরশাদের।

শুধু তাই নয়, জেনারেল এরশাদ ডাকসুর সিটিং জিএস জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে ভাগিয়ে অনন্য রেকর্ড সৃষ্টি করেছিলেন। ডাকসু জিএসকে করা হয়েছিলো প্রেসিডেন্টের ছাত্র বিষয়ক উপদেষ্টা। অফিস দেয়া হয়েছিলো গণভবনের পাশে যেখানে এখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। ওই কম্পাউন্ডে আরও দপ্তর ছিল।

জেনালের এরশাদের ফাঁদে পা দেবার কারণে জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর প্রতি আমার প্রচণ্ড রাগ ছিলো। ফলে তার সাথে যোগাযোগ করার কোনো আগ্রহ ছিলো না। তিনি দায়িত্ব নেবার মাস খানেক পর আবু হাসান শাহরিয়ার দেখা করতে বললেন। তিনি বাবলু ভাইর সাথে সংযুক্ত এবং সরকারি ব্যবস্থাপনায় একটি পত্রিকা প্রকাশের দায়িত্বে নিয়োজিত। রেজা রায়হানের মাধ্যমে তার সাথে আমার সম্পর্ক হয়েছিলো। হল সংসদে নির্বাচনের সময় তিনি আমার নির্বাচনী লিফলেট ড্রাফট করে দিয়েছিলেন। অসাধারণ এক লিফলেট, যেন কবিতা। উল্লেখ্য, আবু হাসান শাহরিয়ার দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় কবি।

আমি আবু হাসান শাহরিয়ারের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। রুমে ঢোকার সাথে সাথে বললেন, চলেন। এই বলে তিনি আমাকে অন্য একটি রুমে নিয়ে গেলেন। দেখলাম আবু আলম শহীদ খান বসা। অবিভক্ত জাসদ ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক, প্রভাবশালী নেতা ও দরদি বড় ভাই। চাকুরি জীবনে তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। খালেদা সরকারের সময় চরম হয়রানির শিকার হয়েছেন। শেখ হাসিনা সরকারের সময় চাকরি ফিরে পেয়েছেন আদালতের রায়ে। সচিব হিসেবে স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্ব পালন করেছেন। কোন সময়ই তাকে কেউ পাল্টে যেতে দেখেননি। তিনি বরাবরই ছিলেন জনসম্পৃক্ত দাপটের আমলা হিসেবে পরিচিত। তিনি আমলা শ্রেণির মধ্যে আলাদা এক বৈশিষ্ট্যের মানুষ। তিনি আরও একটি বিষয়ে আলাদা ছিলেন। আমলাদের চাকরির শুরুর দিকে কারও একান্ত সচিব হবার প্রবণতা থাকে। যা মোটেই ছিলো না আবু আলম শহীদ খানের। চাকরি জীবনে তিনি কখনো কারও একান্ত সচিব ছিলেন না।

আবু আলম শহীদ খান বিসিএস পাস করে সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েছেন- এটি জানতাম। কিন্তু তিনি ডেপুটেশনে স্টুডেন্ট রিলেশনস অফিসার হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন- তা জানতাম না। আমি একটু ঘোরের মধ্যে পড়লাম। এ ঘোর কাটলো তার কথায়। বললেন, কী তোমার খবর কি? তিনি আমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে বললেন, আমার সাথে আসো। আগের রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত আনুগত্য নিয়েই আবু আলম ভাইর অনুগামী হলাম। তার পিছু পিছু ঢুকলাম বিশাল এক রুমে। সেখানে বসা ছিলেন জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। তিনি খুবই আন্তরিকভাবে স্বাগত জানালেন। ইনবিল্ড প্রবণতায়ই বাবলু ভাই বিনয়ী ও আন্তরিক ব্যবহারের লোক হিসেবে পরিচিত। প্রায় ঘণ্টাখানেক ছিলাম তার রুমে। আমরা ছবিও তুললাম। আসার সময় তিনি আমাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। এবং বললেন, ‘যোগাযোগ রাখবা, জাসদ দিয়ে আর কিছু হবে না।’ একই কথা এর আগের ঘণ্টাখানেকের আলোচনায় তিনি অন্তত পাঁচ বার বলেছেন। কিন্তু মজ্জাগত স্বভাবের কারণে আমি তার সাথে যোগাযোগ রাখিনি। তবে তাঁর সাথে আবার দেখা হয়েছে যখন তিনি প্রতিমন্ত্রী হিসেবে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। তাও বিদ্যুৎ খাতের ব্যবসায়ী ও সাপ্তাহিক সুগন্ধার মালিক সৈয়দ মোয়াজ্জেমের পীড়াপীড়িতে। তখন আমি, সচিবালয় বিটের দাপুটে রিপোর্টার হিসেবে পরিচিত।

জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর উপর আমার রাগ কিছু দিনের মধ্যে কমে গেলো। এ ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের হলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবদুস সাত্তার মিয়াজী। তখন সে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে জনসংযোগ কর্মকর্তা। জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর উপর রাগ কমলেও একেবারে চলে যায়নি। আমার মনের ভিতর এক ধরনের রক্তক্ষরণ হতো। সামরিক শাসকের সঙ্গে ডাকসু নেতার যাবার বিষয়টি কোন অবস্থাতেই মানতে পারছিলাম না। কারণ, তিনি যে ছাত্রদের আবেগ ধারণ করে ডাকসু জিএস হবার সুযোগ পেয়েছেন সেই ছাত্ররা চিরকালই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে, রক্ত দিয়েছে; দিয়েছে জীবন। যারা আইয়ুব-ইয়াহিয়া শুরু করে সকল সামরিক শাসকের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে অসীম সাহসে। আর তাদেরই নির্বাচিত নেতা সামরিক শাসকের পদতলে নিজেকে সমর্পণ করলেন! চরণে অঞ্জলি দেবার মতো।

আবু আলম শহীদ খানের কাছে জেনেছি, ডাকসু জিএস জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু এবং সাবেক ছাত্রনেতা ও সদ্য বিসিএস পাশ করা তিন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত ছাত্র সংসদগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে কাউন্সিল গঠন করার পরিকল্পনার আওতায়। অফিসের নাম সম্ভবত ছিল ন্যাশনাল স্টুডেন্ট কাউন্সিল। এটি প্রথমে তৎকালীন সিএমএলএ কার্যালয়ে অফিস চালু হয়েছিল। জেনারেল আতিক সুপারভাইজ করতেন। পরে গণভবনের পাশের কমপ্লেক্সে আনা হয়। কিন্তু সবাই জানে, এই কাউন্সিলের ঘোষিত লক্ষ্যে স্থির থাকেননি সিএমএলএ জেনারেল এরশাদ। এমনকি পত্রিকাটিও নিয়মিত প্রকাশিত হতো না। পোস্টার এবং সাময়িকী বের হতো।  তাও নিয়মিত নয়। শুধু তাই নয়, এক পর্যায়ে ছাত্রদের ট্যাস্কি ক্যাব দিয়ে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করেছে জেনারেলের এরশাদের সামরিক সরকার।

ডাকসু জিএস জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর কেবলা বদলের প্রাক্কালে এ বিষয়ে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছিলো। শুরুতে তিনি এ অভিযোগকে গুজব বলে অস্বীকার করার চেষ্টা করলেন। এ সময় হলে হলে গিয়ে মিটিং করে বলেছেন, ‘এ খবর একেবারেই গুজব।’ কয়েকটি মিটিং-এ আমাকে সাথে নিয়ে গেছেন। মহসিন হলে মিটিং করতে গিয়ে প্রথমেই আমাকে খুঁজেছিলেন। হয়তো ধাওয়া খাওয়ার আতঙ্কে ছিলেন। এর আগে ডাকসু জিএস থাকাকালেই সূর্যসেন হলে তাঁর উপর ছাত্র দলের ক্যাডার সানাউল হক নিরু যে হামলা চালিয়েছিলো তা প্রতিরোধ করেছিলাম আমি। ফলে তিনি অক্ষত ছিলেন। কিন্তু রক্তাক্ত হয়েছিলাম আমি। যা তিনি প্রেসিডেন্টের ছাত্র বিষয়ক উপদেষ্টা ও মন্ত্রী হবার পরও মনে রেখেছেন। এবং আমার সামনেই এ ঘটনা বলেছেন সাপ্তাহিত সুগন্ধার মালিক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসাইনকে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালে তাঁর কাছে অনেক দায় ছিলো সৈয়দ মোয়াজ্জেমের।

জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর আগেও ডাকসু নেতা ভাগানোর চেষ্টা ছিলো সামরিক শাসক জেনালের জিয়ারও। মাহমুদুর রহমান মান্নাকে কেন্দ্র করে গুঞ্জনও ছড়িয়ে পড়েছিলো। এ অবস্থায় মাহমুদুর রহমান মান্না মধুর কেন্টিনে এক সমাবেশে বলেছিলেন, ‘৪২ বছরের মেজরের সঙ্গে রাজনীতি করার ইচ্ছা নেই!’ কিন্তু এই ডাকসুর জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু ঠিকই পরের সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের সঙ্গে গিয়েছিলেন। আর ডাকসুকেন্দ্রিক ছাত্র রাজনীতির কলঙ্কের এই দুর্যোগের সৃষ্টি হয়েছিলো জাসদ ছাত্রলীগের ভাঙ্গনের ফলশ্রুতিতে।

কথিত আছে, ছাত্র রাজনীতি ধবংস করার এসাইনমেন্ট নিয়েই জেনালের জিয়ার সঙ্গে একটি রফার পরিপ্রেক্ষিতেই জার্মানি থেকে ‘সুস্থ’ হয়ে জাসদ সাধারণ সম্পাদক আ স ম আবদুর রব দেশে ফিরেছিলেন। গোপন দায়িত্ব পালনের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ছাত্রলীগ থেকে মান্না-আক্তারকে বহিস্কারের ব্যবস্থা করে ছাত্রলীগকে ধ্বংসের পথে নিয়ে গিয়েছিলেন। এই ধ্বংসস্তুপের উপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েছিলো সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের ছাত্রদল। অথচ এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে গিয়ে জেনারেল জিয়া প্রচণ্ড বাধার মুখে পড়েছিলেন। অপদস্থ হয়েছেন। তিনি ঠাণ্ডা মস্তিষ্কের মানুষ ছিলেন বলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সেদিন রক্তগঙ্গা বয়ে যায়নি। ওইদিন জাসদ ছাত্রলীগ নেতা মিয়া মোহাম্মদ ফেরদৌস যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন সেই দুর্বিনিত শক্তির মূল উৎপাটন করা হয়েছে জাসদ ছাত্রলীগে আরোপিত ভাঙ্গনের মধ্য দিয়ে। আর এ ধারাবাহিকতায় আমার রাজনীতি জীবনের অবসান ঘটে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর